মাত্র তিন মাসের মধ্যে চারশো কোটি গাছ লাগানোর উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নিয়ে ইথিওপিয়া চলতি বছর জাতীয় বন পুনরুদ্ধার কর্মসূচি গ্রহণ করে। বৃহত্তর এই কর্মসূচির বিষয়টি নজরে আসে চলতি বছরের জুলাই মাসের একটি দিনে। যে দিন সারা দেশের মানুষ সাড়ে তিনশ কোটি গাছের চারা রোপণে এগিয়ে আসে।
আগস্টের শেষের দিকে, সরকার দাবি করে যে তারা এই লক্ষ্য অনেকটাই অর্জন করেছে।
তবে এত অল্প সময়ে এতোগুলো গাছ রোপণ করা কি সম্ভব এবং সরকারের যে সামগ্রিক লক্ষ্য পূরণ হয়েছে এমন কোন প্রমাণ কি রয়েছে? গ্রিন লিগ্যাসি ইনিশিয়েটিভ নামে পরিচিত এই প্রচারণাটি পরিচালনা করেছেন দেশটির নোবেলে শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ।
বিশ্বজুড়ে রাজনীতিবিদরা তাদের দেশের বন পুনরুদ্ধারের জন্য ইথিওপিয়াকে উদাহরণ হিসেবে নিয়েছেন।
এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন এবং কৃষিকাজের যে ক্ষতিকারক প্রভাব রয়েছে তার বিপরীতে কী করা যেতে পারে, ইথিওপিয়া সেই শিক্ষাও দিয়েছে বলে মনে করেন বিশ্বনেতারা।
যুক্তরাজ্যের সাম্প্রতিক নির্বাচনী প্রচারণার সময়, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো আরও লাখ লাখ গাছ লাগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং উদাহরণ হিসেবে তারা ইথিওপিয়ার উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেন।
লেবার পার্টি ২০৪০ সালের মধ্যে ২০০ কোটি গাছ, কনজারভেটিভরা প্রতি বছর কমপক্ষে তিন কোটির বেশি গাছ এবং গ্রিন পার্টি ২০৩০ সালের মধ্যে ৭০ কোটি গাছ লাগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কানাডাও ১০ বছরের মধ্যে দুইশ কোটি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করছে।
রেকর্ড ভাঙা প্রচেষ্টা
ইথিওপিয়া চলতি বছরের ২৯ জুলাই একদিনব্যাপী বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সারা দেশে ২০ কোটি গাছের চারা রোপণ করা।
পরে সরকার ঘোষণা করে জানায় যে এই লক্ষ্য আরও প্রসারিত করা হয়েছে, তারা এখন ১২ ঘণ্টার মধ্যে ৩৫ কোটির বেশি গাছের চারা রোপণ করার লক্ষ্য স্থির করেছে।
ওইদিন ইথিওপিয়া জুড়ে মোট ৩৫ কোটি ৩৬ লাখ ৩৩ হাজার ৬৬০টি গাছ রোপণ করা হয় বলে জানানো হয়।
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে (জিডব্লিউআর) আনুষ্ঠানিকভাবে নাম লেখানোর জন্য দেশটির সরকার এই দিনটিকে ঘিরে নানা প্রচারণা চালায়।
তবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড জানিয়েছে, তারা এখনো এতোগুলো গাছ লাগানোর কোন প্রমাণ পায়নি।
“আমরা আয়োজকদের উৎসাহিত করব তারা যেন বিষয়টিকে পর্যালোচনার করতে আমাদের রেকর্ড পরিচালনাকারী দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন,” বলেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের মুখপাত্র জেসিকা স্পিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় রোপণ করা গাছের মোট সংখ্যা নিয়ে এবং রেকর্ডের সত্যতা যাচাই সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তারা বলছে যে, গাছ লাগানোকে ঘিরে তার দেশ ইতিমধ্যে বেশিরভাগ প্রশ্নের জবাব দিয়েছে।
চারশো কোটি গাছ লাগানো কি সম্ভব?
তিন মাসের মধ্যে চারশো কোটি গাছ লাগানোর মানে হল প্রতিদিন কমপক্ষে সাড়ে চার কোটি গাছের চারা রোপণ করতে হয়েছে।
যদি বাম্পার রোপণের দিনটির কথা ধরা হয় যেদিন ৩৫ কোটি গাছের চারা রোপণ করা হয়েছিল বলে দাবি করা হচ্ছে।
তারপরও তিন মাসের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য অন্যান্য প্রতিটি দিনে ৪০ লাখেরও বেশি গাছ রোপণ করতে হয়েছে। ইথিওপিয়ার সরকারের পরিকল্পনা ছিল তার দেশের ৬৫ লাখ হেক্টর গ্রামীণ জমিতে এই গাছ লাগানো।
প্রতি হেক্টরে গড়ে আনুমানিক ১,৫০০ গাছও যদি লাগানো হয়, তাহলে চারশো কোটি গাছ লাগানোর জন্য ওই বিশাল পরিমাণ জমি অবশ্যই যথেষ্ট।
তবে কী ধরণের চারাগাছ রোপণ করা হয়েছিল সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। বিবিসির কাছে বৃক্ষ রোপণের এই একমাত্র হিসাবটি ইথিওপিয়ার সরকারই সরবরাহ করেছে।
সেই হিসাব অনুযায়ী, জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিন মাসে সাড়ে তিনশ কোটি গাছ লাগানো হয়েছে। আরও ১৩০ কোটি গাছের চারা জন্মালেও রোপণ করা হয়নি।
আপনি এত গাছ গুনবেন কিভাবে?
এগুলো কারও পক্ষে গুনে গুনে বের করা সম্ভব না। তবে আনুমানিক ধারণা নিতে বিবিসি একটি নতুন বৃক্ষ রোপণ অঞ্চলে গিয়ে কিছু চারাগাছের ছবি তুলে আনেন। ওই সংবাদদাতাকে দেশটির উত্তরাঞ্চলের শুষ্ক আবহাওয়ার টাইগ্রে অঞ্চলে পাঠানো হয়েছিল।
বিবিসি একটি স্যাটেলাইট ইমেজিং সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে, যারা হাই-রেজোলিউশনের ছবি নিয়ে কাজ করে।
তারা বিবিসিকে জানায় যে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নতুন রোপণ করা চারাগুলি সনাক্ত করা কঠিন হবে। চারাগুলোর মাথা ছোট এবং কাণ্ড সরু হওয়ায় এগুলোকে ঝোপঝাড় বা অন্যান্য আবাদি জমি থেকে আলাদা করা যায় না।
জাতিসংঘের বনাঞ্চল বিশেষজ্ঞ টিম ক্রিস্টোফারসন বিবিসিকে জানান, ইথিওপিয়ার এই বন পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি তাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছে, কিন্তু তিনি গাছ লাগানোর চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে কোন রায় দিতে পারেননি।
“ইথিওপিয়া গাছ লাগানোর পাশাপাশি ওই গাছগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও লালনপালনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সহায়তা চেয়েছিল।”
ক্রিস্টোফারসন আরো বলেন, “বিশ্বব্যাপী বন উজাড় মোকাবেলার অংশ হিসেবে ইথিওপিয়া সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেড় কোটি হেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত বন ও প্রকৃতি পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।”
ইথিওপিয়ার কোটি কোটি গাছ লাগানোর উচ্চাভিলাষী প্রকল্পটি নিয়ে পরিবেশবিদরা প্রশংসা করলেও এ বছর ঠিক কতগুলো গাছ লাগানো হয়েছে তা মূল্যায়নে তেমন কোন কাজ করা হয়নি।
এই গাছগুলো রোপণের জন্য যেভাবে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছিল সেটাও এই সমস্যার আরেক কারণ হতে পারে।
ইথিওপিয়াকে আরো সবুজ করে তুলতে সহায়তার জন্য এ বছরের জুলাইয়ে, ইইউ এবং ইথিওপিয়ার সরকারের মধ্যে চার কোটি ডলার অর্থায়নের একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
ইথিওপিয়ার স্থানীয় সব সংস্থাগুলোকে নির্দিষ্ট সংখ্যক গাছ লাগানোর জন্য তহবিল সরবরাহ করা হয় এবং এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই যে তারা আসলে যে পরিমাণ গাছের চারা রোপণ করেছে তার চাইতে বেশি গাছ রোপণের কথা স্থানীয় কর্মকর্তাদের জানিয়েছে। ওই কর্মকর্তারাই এই সংখ্যাগুলো যোগ করে জাতীয় পর্যায়ের পরিসংখ্যানটি তৈরি করেছে।
আসন্ন পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ
প্রকৃত সংখ্যা যাই হোক না কেন, এতে কোন সন্দেহ নেই যে ইথিওপিয়ার সরকার তার দেশের মারাত্মক বন উজাড়ের সমস্যা মোকাবেলায় খুব বড় একটি প্রচেষ্টা চালিয়েছে।
পঞ্চাশ বছর আগেও, ইথিওপিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ বনাঞ্চল ছিল। আজ সেই সংখ্যা ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
সাম্প্রতিক বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচিটি যদি এই সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য হয় তবে রোপণ করা চারাগুলোয় নিয়মিতভাবে পানি দিতে হবে।
এতোগুলো গাছের রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল পরিমাণ পানির প্রয়োজন। অথচ ইথিওপিয়ায় এই পানিই অনেক মূল্যবান। কারণ সেখানে প্রয়োজন অনুপাতে পানির ঘাটতি রয়েছে।
তবে গাছ লাগানোর মাধ্যমে দেশটি বেশি পরিমাণে পানি ধরে রাখার মতো উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবে। বিবিসি।