গতকালও টাকার সঙ্কটে আমানত সংগ্রহ করেছেন দুই অঙ্কে সুদহারে। ১০০ টাকা আমানত পেতে এখন সাড়ে ১০ শতাংশ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় করছেন তারা। কিন্তু ঋণের সুদহার এক অঙ্ক তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। বুঝতেই পারছেন ব্যাংক খাতের অবস্থা কেমন হবে। কারা এর সুবিধাভোগী হচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে। কিন্তু তাদের চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
অনেকটা ক্ষোভ ও হতাশা নিয়ে আক্ষেপ করে কথাগুলো বলেন দেশের তৃতীয় প্রজন্মের একটি ব্যাংকের এমডি। বেশির ভাগ ব্যাংকারেরই এখন এক অঙ্কের সুদহার নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকও টের পাচ্ছে।
কিন্তু যেহেতু অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ১ জানুয়ারি থেকে এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়ন করতে হবে এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও একটি উপায় বের করার চেষ্টা করছে। এ নিয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশও বাংলাদেশ ব্যাংক হাতে পেয়েছে। এটা বাস্তবায়ন হলে ব্যাংকিং খাতের সম্ভাব্য পরিস্থিতির দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের একক কোনো ব্যক্তি নিতে চাচ্ছেন না।
এ কারণেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে জরুরি পর্ষদ বৈঠক ডেকেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আজ বিকেল ৪টায় বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে।
সুদহার নিয়ে গঠিত কমিটির একজন সদস্য গতকাল এ বিষয়ে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, যেহেতু ব্যাংকগুলো গড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। এ কারণে ৯ অঙ্কে ঋণ দিলে ব্যাংকগুলোর সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে। সঙ্কট কাটাতে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে কম সুদে আমানত প্রাপ্তির নিশ্চয়তা চাওয়া হয়েছিল। সাধারণ আমানতে সুদহার কমানো হলে আমানত আরো কমে যাবে।
এ কারণে সরকারি আমানত কম সুদে পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে কম সুদে আমানত পাওয়ার উপায় বলে দেয়া হয়েছে। সাধারণত এসব প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে মেয়াদি আমানত রাখে। ব্যাংকগুলো এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৬ থেকে ক্ষেত্র বিশেষ ৯ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করে।
কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান ব্যাংকে আর মেয়াদি আমানত রাখতে পারবে না। তারা চলতি হিসেবে টাকা রাখবে। সাধারণত চলতি হিসাবে তেমন কোনো সুদ দিতে হয় না ব্যাংকগুলোর। গড়ে বড়জোর ২ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় হয় চলতি আমানতের ক্ষেত্রে। এসব প্রতিষ্ঠানের আমানত কম সুদে পাওয়া গেলে এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়ন করা সহজ হবে।
কমিটির সদস্য এমন এক ব্যাংকার জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলো এমনিতেই নানা সমস্যায় ভুগছে। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে খেলাপি ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়ায় ব্যাংকে নগদ আদায় কমে গেছে। ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এতে ব্যাংক বর্ধিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হিমশিম খাচ্ছে।
এরওপর বিদ্যমান ঋণের সুদহার কমালে তারা আরো সমস্যায় পড়বে। এ কারণে এক অঙ্কের সুদহার চাপিয়ে দিলে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। আর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে গেলে সরাসরি প্রভাব পড়বে মুনাফায়। বেশির ভাগ ব্যাংকই লোকসানের সম্মুখীন হবে। এ পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য শুধু নতুন ঋণের ক্ষেত্রে এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়ন করলে কিছুটা রক্ষা হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, সুদহার নিয়ে গঠিত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। আগামী ১ জানুয়ারি থেকে এক অঙ্কের সুদহার কার্যকর করা হবে। এ সংক্রান্ত খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে সার্কুলার দেয়ার আগে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন।
এ ছাড়া এটা কার্যকর করতে গিয়ে ব্যাংকিং খাতে সম্ভাব্য পরিস্থিতির দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের একক কোনো ব্যক্তি নিতে চাচ্ছেন না। এ কারণে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে। পর্ষদ যে সিদ্ধান্ত দেবে তাই বাস্তবায়ন করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিলে তা পরিপালনের জন্য আজ অথবা আগামীকাল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর জন্য সার্কুলার জারি করা হবে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সিদ্ধান্তের ওপর। এ কারণে পর্ষদের জরুরি সভা ডেকেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।