ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশে ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আরও ১০৮ জন (৩ ডিসেম্বরের খবর)। দায়ী এডিস ও কিউলেক্স মশা। ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডে মশা মারতে ওষুধের জন্য স্থানীয় সরকার প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে থাকে। তার পরও অধিদফতরের হিসাবে দেখা যায়, ‘চলতি বছরের শুরু থেকে আজ (৫ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী ২৪ হাজার ৩৮০ জন। এ বছর ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৯৫ জন। মোট আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ২০ হাজার ৮১৬ ঢাকার।’ কর্মকর্তা আমিন উল্লাহ নূরী বলেছেন, মশা নিধনের চার পদ্ধতির মধ্যে একটি- খাল, জলাশয়, নালাসহ বিভিন্ন বদ্ধ জলাশয়ে অন্য প্রাণী যারা ছোটখাটো পোকামাকড় খেয়ে জীবন ধারণ করে এদের বিচরণের ব্যবস্থা করা।
সর্বভুক ব্যাঙের প্রধান খাদ্য পোকামাকড়। তাই, মশা মারতে এবার ঢাকার জলাশয়ে ব্যাঙ ছাড়তে শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে ১০টি জলাশয়ে হাজার দশেক ব্যাঙাচি ছাড়া হয়েছে। …মূল পরিকল্পনা হচ্ছে এই ব্যাঙাচি পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙ হবে, বংশবিস্তার করবে এবং মশার লার্ভা খেয়ে ক্রমে এরা মশার বিস্তার ঠেকিয়ে দেবে’ (খবর বিবিসি)। বিষে ভরা রাজধানীর বাতাস, জলাশয়ের পানিও যদি তাই হয়! ব্যাঙাচিগুলো বাঁচবে তো? যদি বাঁচে তাহলে, শহরবাসী আবার শুনতে পাবে ব্যাঙের ডাক।
জলাশয়ে ব্যাঙ ছাড়ার কথা শুনে মনে পড়ে আমেরিকার ইয়েলোস্টোন পার্কের ঘটনা। আট হাজার ৯৮০ বর্গকিলোমিটার বিশিষ্ট পার্কটি জীববৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। প্রাকৃতিকভাবে জীববৈচিত্র্যের মধ্যে ছিল বাইসন, কালো ভল্লুক, বিশেষ ধরনের নেকড়ে, অ্যান্টিলোপ (এক ধরনের হরিণ), এল্ক বা বাঁকানো লম্বা শিংওয়ালা হরিণ, বড় শিংওয়ালা ভেড়া, মেঠো কাঠবিড়ালি, পালকহীন ঈগল, ব্যাজার, লাল শিয়াল, গলজাতীয় পক্ষী, ছাই বর্ণের ঘুঘু। এরা দল বেঁধে থাকত এবং পার্কের চারপাশে অবাধে ঘুরে বেড়াত। অসহায় এল্ক ও হরিণ নিরাপদ করতে গিয়ে নেকড়েসহ মাংসাশী পশু কমানো শুরু করতেই ভারসাম্য হারাতে শুরু করে ইয়েলোস্টোন পার্ক। নেকড়ের অবর্তমানে হু হু করে বেড়ে যায় এল্ক, হরিণ ইত্যাদি তৃণভোজী পশু। এরা চড়াও হয় অরণ্যের পত্রবহুল উদ্ভিদগুলোর ওপর। দ্রুত কমতে থাকে বৃক্ষরাজি। ফলে খাদ্যের খোঁজে সে অরণ্য থেকে পালাতে শুরু করে অন্য সব পশু-পাখি। বিরানভ‚মি হয়ে ওঠে অরণ্য। ১৯২০ সালে ইয়েলোস্টোনকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘জাতীয়’ উদ্যান’ ঘোষণা করা হয়। পরিকল্পিতভাবে ফিরিয়ে আনা শুরু হয় নেকড়ে। ক্রমেই সজীব হয় বৃক্ষরাজি, ফিরে আসতে শুরু করে পশু-পাখি। নতুন জীবন ফিরে পায় ইয়েলোস্টোন। ওলেনবেনের কথায়, ‘প্রকৃতির রক্ষক হিসেবে কখনো কখনো মানুষের চেয়ে নেকড়ে অনেক বেশি যোগ্য।’ ঠিক একইভাবে বলা চলে, ‘প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষক হিসেবে কখনো কখনো মানুষের চেয়ে ব্যাঙ অনেক বেশি যোগ্য।
আমার জন্ম পাড়াগাঁয়ে। শৈশবে মশার নাম শুনলেও চোখে দেখিনি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ-বিজ্ঞান বইয়ে প্রথম মশার ছবি দেখি। গাঁয়ে বাস করে মশা দেখব কী করে? সূর্য ডোবার পরপরই আহারের সন্ধানে বের হতো কুনো ব্যাঙ। ঘরের কোণ ছেড়ে ধূসর বর্ণের ব্যাঙগুলো ‘কট্ কট্ কট্’ শব্দে কণ্ঠ মেলায় অন্যদের সাথে। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত বাড়ির আনাচে-কানাচে, উঠানে-পাঁচিলে তন্ন তন্ন করে মশাসহ কীটপতঙ্গ খুঁজত। লম্ফ মেরে ঠোঁটের মাথায় বসানো জিহ্বা মেলে বাতাস থেকে উড়ন্ত মশা ধরে পাঠিয়ে দিত পেটে। দেহের ওজনের দ্বিগুণ ভোজন করে ভোরের আলোর আগেই ঢুকে পড়ে ঘরের কোণে। গাঁয়ের উত্তর দিকে খাল আর দক্ষিণে ডোবা-নালা। ডোবা-নালা ছাড়াও দক্ষিণের মাঠে ছিল কিছু নিচু এলাকা। চৈত্রের খরার পর আকাশে মেঘ করে বৃষ্টি নামতে না নামতেই খাল-বিল ও ডোবা-নালায় নেমে আসত কোলা ব্যাঙ। নানা আকারের নানা প্রকারের নানা রঙের হাজার হাজার ব্যাঙ যখন সমানে ‘ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাং’ ‘ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাং’ শুরু করত তখন বাড়িঘরে থাকা দায় হয়ে যেত। নানা জাতের ব্যাঙের সম্মিলিত কণ্ঠের ডাকে অস্থির পাড়া-প্রতিবেশী।
পাড়া মাতানো ’ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাং’ শব্দে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হলেও খুশি হতেন অসাধারণ লোক। ব্যাঙের ভাষা বুঝতে পারতেন খনা। ব্যাঙ যে বৃষ্টি আসার বার্তা ছড়িয়ে দেয় তিনি তার বচনে বলে গেছেন। প্রাচীনকাল থেকে ব্যাঙের ডাক অনুসরণ করে বৃষ্টির আগাম বার্তা গ্রহণ করে আসছেন কৃষকরাও। ব্যাঙের আরেক নাম ‘দাদুরি’। মত্ত দাদুরির মিলন ও আনন্দ কোলাহল কবির চোখের ঘুম নষ্ট করে দেয়। তাই, মত্ত দাদুরির মাতলামিতে গভীর রাতে কবিসাহিত্যিকের ঘুম ভাঙলেই বিরহযন্ত্রণায় লিখতেন-
‘কুলিশ শত শত পাত মুদিত
ময়ূর নাচত মাতিয়া
মত্ত দাদুরি ডাকে ডাহুকি
ফাটি যাওত ছাতিয়া…
বিদ্যাপতি কয়ে কৈছে গোঙায়বি
হরি বিনে দিন রাতিয়া।’
শৈশবে আমাদের কাজ ছিল, অস্থির পাড়া-প্রতিবেশীকে ’ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাং’-এর উৎপাত থেকে বাঁচানোসহ হাতের নিশানা ঠিক করা। হাতের নিশানা ঠিক করার জন্য আগেভাগেই বাঁশের কঞ্চি দিয়ে সূচালো তীর-বর্শা বানিয়ে রাখতাম। স্কুলজীবনে ‘ঞযব ইড়ুং ্ ঃযব ঋৎড়মং’ শিরোনামে ঈশপের গল্পটি পড়তে পাই। গল্পের সারমর্ম, এক ডোবায় বাস করত এক ব্যাঙ পরিবার। ডোবার পাশে খেলছিল একদল ছেলে। ছেলেরা পুকুরে পাথর নিক্ষেপ করছিল। ফলে, ব্যাঙ পরিবারে যাদের মাথা পানির উপরে, তারা মরছিল। এতে ব্যাঙ পরিবারের বয়স্ক এক ব্যাঙ সাহস করে পানির উপর মাথা তুলে বালকদের অনুগ্রহ করে বলল, ‘ঙয, ঢ়ষবধংব, ফবধৎ পযরষফৎবহ, ংঃড়ঢ় ুড়ঁৎ পৎঁবষ ঢ়ষধু! ঞযড়ঁময রঃ সধু নব ভঁহ ভড়ৎ ুড়ঁ, রঃ সবধহং ফবধঃয ঃড় ঁং!’ (হে প্রিয় বৎসগণ! তোমাদের নৃশংস খেলা থেকে বিরত হও। তোমাদের জন্য যা খেলা আমাদের জন্য তা মরণ)।
ঈশপের গল্পটি পড়ার পর নৃশংস খেলা থেকে বিরত হই। আমরা শিশুরা বিরত হলেও ব্যাঙ নিধন শুরু করে বয়স্করা। ব্যাঙের পা খুবই সুস্বাদু। ব্যাঙের পা অপ্রচলিত পণ্য। অপ্রচলিত পণ্য রফতানিতে লাভও বেশি। আর পায় কে, শুরু হয় ব্যাঙ ধরা। অল্প কয়েক বছরেই খাল-বিল ও ডোবা-নালার ব্যাঙ ধরা শেষ। যেসব ব্যাঙ ঝোপ-ঝাড়, বাড়ির ঢাল ও কচুগাছের তলায় মাটির নিচে আশ্রয় নিয়েছিল, রাতের আঁধারে টর্চ জ্বেলে জ্বেলে সেসব ব্যাঙও ধরে নেয়া শুরু হয়। যেদিন থেকে ব্যাঙ উচ্চবিত্তের প্রিয় হোটেল চাইনিজের ডাইনিংয়ে আশ্রয় পেয়েছে সেদিন থেকে ব্যাঙ উজাড় হওয়া শুরু। একদিকে আবাসন সমস্যা দূর করতে গিয়ে ভরাট করে ফেলা হয় ডোবা-নালা ও খাল-বিল, অপরদিকে খাদ্য হিসেবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্যাঙের পা দেশের বাইরে চলে গেছে। ব্যাঙের পা রফতানির এক হিসাব থেকে দেখা গেছে, ১৯৮৮-৮৯ ও ১৯৯২-৯৩ সালে যথাক্রমে মোট ৩৩, ০৭, ২৮১ ও ১৫, ৩২০ কেজি ব্যাঙের পা রফতানি করা হয় বাংলাদেশ থেকে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে ব্যাঙ। পরিবেশের ভারসাম্য বিপর্যয়ের সাথে মানবজাতির বিপর্যয় জড়িত। মানুষ বিষয়টি যখন বুঝতে পেরেছে তখন অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ব্যাঙ সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরতে প্রতি বছর এপ্রিল মাসের শেষ শনিবার পালিত হয় বিশ্ব ব্যাঙ রক্ষা দিবস। ২০১২ সালে করা হয় বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন। এই আইন হওয়ার বহু আগেই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী জীববৈচিত্র্য হারিয়ে গেছে। বিজ্ঞান ও পরিবেশবাদীদের কথায় উঠে আসে, মানুষের মতো ব্যাঙও প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। স্থলজ এবং জলজ উভয় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এবং খাদ্যশৃঙ্খলে ব্যাঙের গুরুত্ব অপরিসীম। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ ফিরোজ জামান বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী ব্যাঙ যেমন নানা হুমকির সম্মুখীন, তেমনি বাংলাদেশেও মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে যেমন- কৃষিকাজ, রাস্তাঘাট, কলকারখানা, বসতির জন্য প্রাকৃতিক বিভিন্ন বন-জঙ্গল ও জলাশয় ধ্বংস করার কারণে ব্যাঙ হারিয়ে যাচ্ছে।’ বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. গুলশান আরা লতিফা স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ‘অণুজীব থেকে শুরু করে বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিটি প্রাণীই আমাদের বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ বন্যপ্রাণী (সরীসৃপ ও উভচর) গবেষক আবদুর রাজ্জাক বলেন, জলায় ও ডাঙায় উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাঙের অবাধ বিচরণের কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এদের ভ‚মিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’
১৯৮৮ সালে অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে ৩৩ লাখ কেজি ব্যাঙের পা রফতানি করে দেশ কত টাকা লাভ করেছে জানি না- তবে এটা জানি, স্থানীয় সরকার প্রতি বছর মশার পেছনে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করে থাকে। এ ছাড়াও লোকসানের পরিমাণটা দেখিয়েছেন প্রাণিবিদ্যা প্রভাষক মো: মাহবুব আলম। তিনি দেখিয়েছেন, ব্যাঙ একজীবনে চার লাখ ২০ হাজার টাকার ফসল রক্ষা করে। মো: মাহবুব আলম বলেন, ‘যদি একটি ওহফরধহ ইঁষষ ঋৎড়ম-এর ওজন ২০০ গ্রাম হয় এবং জীবনকাল সাত বছর, যদি সে দৈনিক তার দেহের ওজনের দ্বিগুণ পোকামাকড় খায় তা হলে তার পুরো জীবনে যে পরিমাণ পোকামাকড় খায় সে পরিমাণ পোকামাকড় দ্বারা ১৪ হাজার কেজি ফসল নষ্ট হয়। গড়ে এক কেজি ফসলের দাম ৩০ টাকা হলে ১৪ হাজার ী ৩০= চার লাখ ২০ হাজার টাকার ফসল একটি ব্যাঙ তার পুরো জীবনে রক্ষা করে।
শুধু ব্যাঙ নয়, ‘এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত বাংলাদেশে ছিল প্রায় ২২ প্রজাতির উভচর, ১০৯ প্রজাতির অভ্যন্তরীণ ও ১৭ প্রজাতির সামুদ্রিক সরীসৃপ, ৩৮৮ প্রজাতির আবাসিক ও ২৪০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি এবং ১১০ প্রজাতির আন্তদেশীয় ও তিন প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী (বাংলা পিডিয়া)’। এসব পরিচিত জীববৈচিত্র্য প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া শুরু করতেই শুরু হয় অপরিচিত অণুজীবের আগমন। প্রকৃতির প্রেরিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অচেনা অণুজীব বুঝিয়ে দেয়, মানুষের আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি কত অসহায়। সর্বশেষ আসমানি কিতাবে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, ‘সৃষ্টিজগতের কোনো কিছুই অকারণ নয়, আমিই তাদের মাঝে জীবিকা বণ্টন করি এবং পার্থিব জীবনে একজনকে আরেকজনের ওপর সমুন্নত করি- যাতে একে অপরের দ্বারা সেবা নিতে পারে।’ (সূরা-৪৩, আয়াত-৩২)
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক