বিশ্বের অন্যতম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। পৃথিবীর সর্বাধিক একক লবণাক্ততা জলাভ‚মি, দেশের একক বনভ‚মি সুন্দরবন। এ বনের সৌন্দর্য আকৃতি-প্রকৃতি অবস্থান, জীববৈচিত্র্য কমবেশি আমাদের সবার জানা। অর্থনীতিতে এ বনের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে সুন্দরবনের অবদান বছরে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তবে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য এখন সঙ্কটাপন্ন। জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, অনিয়ত্রিতভাবে গাছকাটা, সচেতনতার অভাব এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় হারিয়ে যাচ্ছে বনের মূল্যবান প্রাণিসম্পদ। একসময় এ বনে বাস করত ৪০০ প্রজাতির পাখি। কমতে কমতে এখন দাঁড়িয়েছে ২৭০ প্রজাতিতে। বিলুপ্ত হয়েছে ১৩০ প্রজাতির পাখি।
বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের প্রায় ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এক হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জলভাগ। এ বিস্তীর্ণ নদী ও খালে রয়েছে ১২০ প্রজাতির মাছ। জাহাজের প্রপেলারের আঘাতে ডলফিনের মৃত্যু ঘটছে প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া রাতে চলাচলের সময় টর্চ লাইটের তীব্র আলো ও শব্দ হরিণ এবং নিশাচর প্রাণীসহ সুন্দরবনের পশু-পাখির জীবনচক্রের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফলেছে।
সারা বিশ্বে বিপন্ন ৩১ প্রজাতির প্রাণী এখনো সুন্দরবনে টিকে আছে। এর মধ্যে ১২ প্রজাতির প্রাণী সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এ বনে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় বাংলাদেশের উপক‚লের মানুষের প্রাকৃতিক ঢাল সুন্দরবন। বিপন্ন প্রাণীর আবাস। বিপন্ন প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মেছো বাঘ, ছোট মদন টাক, গ্রেট নট পাখি, রাজগোখরা, জলপাই রঙের কাছিম, দুই প্রজাতির ডলফিন (ইরাবতী ও গাঙেয়), দুই প্রজাতির উদবিড়াল ও লোনা পানির কুমির ইত্যাদি। প্রকৃতি সংরক্ষণ-বিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন, বাংলাদেশের একাধিক প্রতিবেদনে বিশ্বের অন্যতম জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা হিসেবে সুন্দরবনের কথা বলা হয়েছে। প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা সুন্দরবনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য সৃষ্টির প্রধান কারণ হিসেবে এর সৃষ্টিপ্রক্রিয়া ও ভৌগোলিক অবস্থানের কথা বলেছেন। হিমালয় থেকে নেমে আসা মিষ্টি পানির প্রবাহের সাথে বঙ্গোপসাগরের লবণ পানির মিশ্রণের ফলে এ বনে বিশেষ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কাদামাটিতে গড়ে ওঠা এ বনের ৫২ শতাংশই সংরক্ষিত বন। ফলে নানা হুমকি ও সমস্যা সত্তে¡ও এ বন বন্যপ্রাণীর জন্য, বিশ্বের প্রাণিসম্পদের অন্যতম আধার হিসেবে টিকে আছে।
১৯৭৭ সালে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে ইউনেস্কো। পৃথিবীজুড়ে যে ৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে, তার ৩৫ প্রজাতিই পাওয়া যায় সুন্দরবনে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, অবৈধ বসতি স্থাপন ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাছ কাটায় গত ৩৭ বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমেছে ১৪০ বর্গকিলোমিটার। সৌন্দর্যের প্রতীক সুন্দরীগাছ কমে গেছে প্রায় ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০০২ সালে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে সুন্দরবনে তেল দূষণের ওপর একটি গবেষণা চালানো হয়। ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়, তেল দূষণে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করে ওই গবেষণায় উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ও উপকরণ সংগ্রহের সুপারিশ করা হয়েছিল; কিন্তু দীর্ঘ ১৮ বছর পরও সে সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। এসব ঝুঁকির অন্যতম হলো, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর মিঠা পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়া। ফলে বাংলাদেশে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ও নদ-নদীতে সমুদ্রের পানি ঢুকে লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়েছে। এ সমাস্যার সমাধান অথবা এর সাথে খাপ খাওয়ানোর উপায় খুঁজে বের করে তা কাজে লাগানো জাতীয় স্বার্থেই খুব জরুরি। আশাব্যঞ্জক তথ্য হলো, কেওড়াগাছ প্রচুর পরিমাণে জন্মে। নতুন সৃষ্ট চরে এ ম্যানগ্রোভ গাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকে। লবণসহিষ্ণুু এ গাছে প্রচুর ফল হয়, যা কেওড়া ফল হিসেবে পরিচিত। সুন্দরবন-সংলগ্ন উপক‚লীয় জেলাগুলোর লোকজন কেওড়া ফলের সাথে ছোট চিংড়ি মাছ ও মসুরের ডাল রান্না করে খেয়ে থাকে। তা ছাড়া কেওড়া ফল দিয়ে আচার ও চাটনি তৈরি করা হয়। এ ফল পেটের অসুখের চিকিৎসায় বিশেষত, বদহজমে কার্যকর। অন্য দিকে সুন্দরবনের মধুর একটি বড় অংশ আসে কেওড়া ফুল থেকে। তাই গাছটি হয়ে উঠতে পারে লবণাক্ততায় আক্রান্ত কর্দমাক্ত জমির বিশেষ ফসল। গাছটি উপক‚লীয় মাটির ক্ষয়রোধ করে। এ ছাড়া মাটিকে দেয় দৃঢ়তা ও উর্বরতা।
বিভিন্ন সময় ভয়াবহ সব ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যেমন, ১৯৮৮ সালের ২৯ নভেম্বরের হারিকেন, ২০০৭ সালের ১৫ নভেন্বর সিডর, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলায় উপক‚লীয় এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। অন্য দিকে, বঙ্গোপসাগরে চর পড়ায় জোয়ারের পানিতে উচ্চতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আগেকার দিনে পাঁচ-ছয় ফুট উঁচু রাস্তা দিয়ে জোয়ারের পানি থেকে লোকালয় রক্ষা করা যেত। তবে উপক‚লীয় অধিবাসীদের আগলে রেখেছে সুন্দরবন। মংলা বন্দরের চলাচলকারী নৌযানের পোড়া তেল-মবিলের কালো কালো দাগ সুন্দরবনের গাছপালার দিকে তাকালে নজরে পড়ে। সুন্দরবনের ভেতরের জাহাজসহ নানা রকম নৌযানের মেশিনের শব্দ রাতের বেলা সেগুলোর আলো এবং এর সার্চলাইট বণ্যপ্রাণীর স্বাভাবিক পরিবেশে বিঘœ ঘটায়। সিমেন্ট কারখানাসহ বড় ধরনের কারখানা গড়ে উঠেছে মংলায়। সেগুলো পরিবেশদূষণ ঘটাচ্ছে। সুন্দরবনের পুরো পরিবেশ এখন হুমকিতে। আর বনের ভেতর চলাচলকারী রাসায়নিকবাহী জাহাজ বা বন্দরের আশপাশ এলাকার কারখানার দুর্ঘটনা ঘটলে তা বনের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনে।
বিশ্ব সংস্থা জাতিসঙ্ঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো বলেছে, সুন্দরবন হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র শ্বাসমূলীয় বন, যেখানে এখনো পলি পড়ে পড়ে নতুন ভ‚মির গঠন হচ্ছে। এসব ভ‚মিতে প্রাকৃতিকভাবে শ্বাসমূলীয় বনভ‚মি গড়ে উঠেছে। সুন্দরবনের অন্য অঞ্চলগুলো থেকে সেখানে হরিণ, সাপ ও বাঘের মতো প্রাণীরা এসে বসতি গড়ছে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে সুন্দরবনের জন্য ১০টি হুমকি চিহ্নিত করা হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, দূষণ, অবৈধ তৎপরতা ও পশুর নদের খননকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ জন্য বলা যায়, ইউনেস্কোর উল্লিøখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সুন্দরবন রক্ষায় আমাদের ব্যাপকভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
rahimkhulna8@gmail.com