পাঁচ বছরের শিশু জুম্মান। তীব্র শীতে জবুথবু হয়ে আছে শিশুটি। চোখেমুখে অনিশ্চয়তার ছাপ। তুবও আগুনে পোড়া ধ্বংসস্তূপে শেষ সম্বল হাতড়াচ্ছে। বাবা-মায়ের সাথে পুড়ে যাওয়া কয়লার মাঝেই নিজেদের পুড়ে যাওয়া জিনিস খুঁজছে জুম্মান। কিন্তু মধ্যরাতের আগুন সব যে কেড়ে নিয়েছে ওদের। দেখলে মনে হবে আগুনে সব হারানো জুম্মনদের অসহায়ত্বের কাছে ডিসেম্বরের এ তীব্র শীতও যেন হার মেনেছে।
জুম্মানদের পাশেই পুড়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে রুটিরুজির একমাত্র অবলম্বন রিকশাটি তুলে আনছেন রফিক, অন্তত লোহালক্কর হিসেবে বিক্রর জন্য। নদী ভাঙনে সব হারিয়ে নতুন জীবনের আশায় ঘর বেঁধেছিলেন কালশীর বাউনিয়া বাঁধ বস্তিতে। ভয়াবহ আগুন মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু কেড়ে নিয়েছে। জুম্মান ও রফিকের মতোই একই অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত বাকি বস্তিবাসীদের। এক রাতের ব্যবধানেই খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই হয়েছে হতভাগ্য এসব মানুষের। কষ্টে অর্জিত সহায়-সম্বল হারিয়ে কেউ কেউ বাকরুদ্ধ, চোখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ছাপ।
রাজধানীর মিরপুরের কালশীর বাউনিয়া বাঁধ বস্তিতে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আগুন লাগে। শীতের রাতে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। আগুন আগুন, বাঁচাও বাঁচাও বলে ঘুমন্ত শিশুসন্তানদের পরিবার-পরিজনদের নিয়ে বস্তির খুপড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন নিম্ন আয়ের মানুষগুলো। নিজেদের মতো করে প্রাণন্তর চেষ্টা চালান আগুন নেভানোর। কিন্তুওই আগুনের কাছে তারা যে বড়ই অসহায়।
জানা গেছে, রাত সাড়ে ১২টার দিকে কালশীর বাউনিয়া বাঁধ বস্তিতে আগুন লাগে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। সময় মতো পৌঁছলেও পানির উৎস খুঁজে না পাওয়ায় আগুন নেভাতে বেশ বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। রাত সোয়া ২টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। তাদের ধারণা, অবৈধ বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে গভীর রাতে কান্নার রোল পড়ে যায় বস্তিবাসীর মধ্যে। এক কাপড়ে বের হয়ে আসা বস্তিবাসী এই শীতের মধ্যে কোথায় আশ্রয় পাবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তারা। মাঝারি শৈত্যপ্রবাহে নগরবাসীর একটু উষ্ণতার জন্য চেষ্টার কমতি নেই। এমন তীব্র শীতে সব হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই মিলেছে শত শত বস্তিবাসীর। কারো সমস্যা গরম কাপড়, কারো আবার খাবারের অভাব। বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শিশুদের কষ্ট অসহনীয়।
বস্তিবাসী জানান, বস্তিটিতে ৮০টির মতো দোকানসহ তিন শতাধিক ঘর রয়েছে। পাশেই খাল। খালের ওপর বেশির ভাগই কাঠের টংঘর ও টিনের ঘর বানানো। ছোট ছোট প্রতিটি ঘরে বসবাস ছিল দুইজনের বেশি বাসিন্দা। বাসিন্দাদের বেশির ভাগই রিকশা-ভ্যানচালক। কেউবা ভাঙ্গারির ব্যবসা করেন, ফেরি করে প্লাস্টিকসামগ্রী ও পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করেন। ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সবাই নি¤œ আয়ের মানুষ।
ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বলছে, আগুনে শতাধিক বস্তিঘর ও দোকানঘর পুড়ে গেছে। তবে বস্তিবাসীর দাবি, প্রায় দুই শতাধিক বস্তিঘর আগুনে পুড়ে গেছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক সালেহ হোসেন জানান, আগুন দ্রুত চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ধোঁয়ায় এক ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের বিষয়ে তিনি বলেন, বস্তিতে অবৈধ অনেক বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস সিলিন্ডার থাকে, বিদ্যুতের লুস ওয়্যারিং যদি থেকে থাকে সেখান থেকেও শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে আগুন লাগতে পারে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তবে বস্তির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। এ দিকে ওই রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকার আশ^াস দিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াছ মোল্লা।
বস্তির বাসিন্দা রফিক জানান, পুড়ে যাওয়া কয়লার মাঝে পাওয়ার মতো কিছুই নেই, সবই পুড়ে গেছে। রিকশাটিও পুড়ে গেছে। লোহাগুলো ভাঙ্গারিতে বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। কষ্ট করে এখন কোনো মতে ঘর তুলে এখানেই থাকতে হবে বলে জানান রফিক।
রবিউল নামে বস্তির এক বাসিন্দা বলেন, ‘সামনেই ছিলাম। আগুন দেখার পর বাইরে আসছি। কিন্তু কিচ্ছু আনতে পারি নাই। শুধু জানডা নিয়া দৌড় দিছি।’
সুমন নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘কে কখন কিভাবে বের হইছে ঠিক নাই। সব হারায়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির রাতে এখন খোলা আকাশে নিচে থাকতে হয়েছে। এখন সবাই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকের গরম কাপড় নেই। এই শীত আর বৃষ্টির মধ্যে শিশুদের কষ্ট সবচেয়ে বেশি।’
নান্নু মিয়া নামে আরেকজন বলেন, ‘রাতে ঘুমাইছিলাম। হঠাৎ দোকানদার আকতার মিয়ার চিৎকার। আগুন আর ধোঁয়া দেইখা দৌড় দিছি। আগুনে পুড়ে সব শ্যাষ। এখন কোথায় যাব, কই থাকব কিচ্ছু জানি না।’
বস্তিবাসীরা জানান, বিদ্যুৎ সংযোগ অবৈধ ছিল। প্রায় এক ঘণ্টা দেরিতে আগুন নির্বাপণে আসে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এমনটাই দাবি করেছেন বস্তিবাসী।
মিরপুর বিভাগের পুলিশের উপকমিশনার মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘আগুন লাগার খবর পেয়ে পুলিশও ঘটনাস্থলে যায়। তারা ফায়ার সার্ভিসকে সহায়তা করে। আগুন লেগে বস্তিবাসীদের দু’টি গরু পুড়ে মারা গেছে।’
স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা বলেন, বস্তিটিতে লাগা আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে।