উত্তরপ্রদেশ এখন এমন এক চরম যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা অর্জন করছে, যা মানবতাবিরোধী দণ্ডনীয় অপরাধের পরিণাম। এটি অত্যুক্তি হবে না যে, মুখ্যমন্ত্রী তার প্রদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। এ জন্য তাদের ওপর বেআইনি ও বর্বরোচিত সন্ত্রাসের রাজত্ব চাপিয়ে দিতে পুলিশবাহিনীকে উসকানি জুগিয়েছেন তিনি।
সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষপাতিত্ব এবং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা নতুন নয়। এর বিপরীতে, যা প্রায়ই বলে থাকি- রাষ্ট্র ও পুলিশের মদদ ছাড়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অল্প কয়েক ঘণ্টার বেশি চলতে পারে না। প্রায় সময় পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলি ছোড়ে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিক সংখ্যক লোকজনকে মারাত্মকভাবে আহত করে থাকে।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বেলায় আমরা যা প্রত্যক্ষ করছি, তা হলো- পুলিশবাহিনী নিজেই দাঙ্গাবাজ ও খুনিতে পরিণত হচ্ছে। জেলা কর্মকর্তা হিসেবে নিজে ১৯৮৪ সালে মোকাবেলা করেছি শিখবিরোধী হত্যাযজ্ঞ আর সহিংস কর্মকাণ্ড। ভারতের সিভিল সার্ভিস ত্যাগ করার পরে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি গুজরাট ও মুজাফফরনগর (উত্তরপ্রদেশ) এবং নেলি (আসাম) ও ভাগলপুর (বিহার) হত্যাযজ্ঞের কবল থেকে যারা বেঁচেছিলেন, তাদের সাথে। তবে উত্তরপ্রদেশে এখন যা হচ্ছে, তা ভয়াবহতার মাত্রা এবং ইচ্ছাকৃত পরিকল্পনার দিক দিয়ে এমন যে, আমি এটা এযাবৎ দেখিনি কাশ্মির কিংবা উত্তর-পূর্ব ভারতের বাইরে কোথাও। পরিস্থিতির অবনতি এত বেশি যে, তা অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠেছে।
কয়েক মিনিটেই বিধ্বস্ত
উত্তরপ্রদেশে মুসলমানদের অনেক বাড়িঘরের মধ্য দিয়ে হেঁটেছি। তখন চোখ দুটো হয়ে পড়েছিল অশ্রুর বাষ্পাচ্ছন্ন; আর হৃদয় হয়ে উঠেছিল বেদনার্ত। কারণ, ইউনিফর্মধারী লোকেরা ঘৃণাত্মক অভিযানে মুসলমানদের সহায়সম্পদ ধ্বংস করে দিয়েছে। কার ও স্কুটারগুলো ছিল উল্টানো ও পুড়িয়ে দেয়া। ভেঙেচুরে ফেলা হলো টিভির পর্দা আর ওয়াশিং মেশিন। লুটে নেয়া হলো নগদ অর্থ ও অলঙ্কার। ভেঙে দেয়া হয়েছে (কাচ বা চিনামাটির) থালাবাটি- এমনকি খেলনা পর্যন্ত। পরিবারের জীবনযাত্রার জন্য যা অপরিহার্য, কয়েক মিনিটেই সেসব কিছু বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এমন দৃশ্য দেখার বেদনা উপলব্ধি করেছি বহুবার। ১৯৮৪, ২০০২ ও ২০১৩ সালেও তা হয়েছে। উত্তরপ্রদেশে বিশেষ করে যা ঘটেছে, তা হলো- সেখানে উন্মত্ত জনতা নির্দয়ভাবে বাড়ির পর বাড়ি শেষ করে দিয়েছে; তারা ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশের লোকজন।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলো এ ঘটনার যে বিবরণ দিয়েছে, তা গা শিউরে ওঠার মতো। অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারগুলো ছিল পুলিশি তাণ্ডবের প্রধান টার্গেট। সম্ভবত পুলিশের ইনফর্মাররাই এ বাহিনীকে সেখানে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে। পুলিশরা দলে দলে ঘরবাড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, কোনো কোনো সময় এদের সংখ্যা ছিল ৪০ থেকে ৬০। কখনো বা সাথে ছিল বেসামরিক লোকজন। তারা ঘরের দরজায় আঘাত হেনে তা ভেঙে ফেলেছে। ঘরের বৃদ্ধ, নারী, এমনকি শিশুদেরও পুলিশ পিটিয়েছে। মাফ চেয়ে যখন তারা সামনে দাঁড়াত, তখনই প্রহার করা হতো। পুলিশ তাদের অকথ্য গালাগালি করেছে। প্রায় সময় পুলিশ এ কথা বলে মুসলমানদের মনে কষ্ট দিয়েছে, ‘নাও, তোমাদের আজাদি, যা চেয়েছ।’
একই সাম্প্রদায়িক রণধ্বনি দিয়ে সশস্ত্র পুলিশরা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আক্রমণ করেছে। সেখানে তারা ভাঙচুর চালিয়েছে মসজিদে। পুলিশ মুজাফফরনগরে একটি মাদরাসায় হামলা করেছে। ওরা মুসলমানদের দোকানপাটে ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়েছে।
নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন-সূত্র
অনেক পরিবারের অভিযোগ, পুলিশের লোকেরা বলে দিয়েছে, “এসব বাড়িঘর এখন থেকে ‘আমাদের’। কারণ, আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে যে, ‘তোমরা’ পাকিস্তানে চলে যাবে।” এটা প্রমাণিত, পুলিশের লোকজন সবাই এ কথা বিশ্বাস করেছে, নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন ২০১৯, সে কাজটি সম্পূর্ণ করবে যাকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস বলে থাকে দেশ বিভাগের ‘অসমাপ্ত কাজ’। এর মানে হলো, ভারতের মুসলমানদের জোর করে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া। ক্যামেরায় ধরা পড়েছেন একজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা। দেখা গেছে, তিনি মুসলমানদের বলছেন পাকিস্তানে চলে যেতে এবং ভারতের প্রতি তাদের আনুগত্য নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলছেন।
নারী ও শিশুরা আমাদের দেখিয়েছে, কিভাবে লাঠির আঘাতে তাদের দেহে ক্ষতের সৃষ্টি করা হয়েছে। খুব বৃদ্ধ মানুষও এই নির্যাতন থেকে নিস্তার পাননি। ‘টিনএজ’ তরুণদের পুলিশ ধরে নিয়ে দিনের পর দিন আটকে রেখেছে বেআইনিভাবে। যদি হাসপাতালে জানানো হতো, পুলিশের হাতে আহত ব্যক্তিরা চিকিৎসা নিতে এসেছে, তাহলে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা আর চিকিৎসা করতে আগ্রহী হতেন না।
ভারতের বেশির ভাগ স্থানের মতো উত্তরপ্রদেশেও জনগণ রাস্তায় নেমেছিলেন নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীর বিরুদ্ধে। শুধু এই প্রদেশে এবং কর্নাটক প্রদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রতিবাদ সহিংস রূপ নিয়েছিল। এ লেখা তৈরি করা পর্যন্ত নাগরিকত্ব নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে উত্তরপ্রদেশে ২০ জন মারা গেছেন। বলা হয়েছে, কিছু এলাকায় প্রতিবাদকারীরা ‘সহিংস হয়ে উঠেছিলেন’। তবে তারা দাবি করেছেন, পুলিশের মনোভাব ও অ্যাকশনের প্রতিক্রিয়ায় এই সহিংস তাণ্ডব চলে। অবশ্য তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের সহিংসতা ছিল সম্পূর্ণ বাড়াবাড়ি। তখন পুলিশ সতর্ক করে দেয়ার নিয়মকানুন মানেনি। আর এমনটিও ঘটেনি যে, সহিংসতা ক্রমেই বেড়েছে। বরং ভিডিওতে দেখা গেছে- পুলিশ বিক্ষোভকারীদের দেহে কোমরের ওপরের অংশ গুলি করেছে। এটা প্রায় সময় করা হয়েছে কোনো প্রতিবাদ কিংবা জনতার উপস্থিতি ছাড়াই, সরু গলি দিয়ে মানুষকে উত্তেজিত অবস্থায় তাড়া করে।
যারা এসব হামলার শিকার, তাদের বেশির ভাগ খুবই গরিব আর মেহনতি শ্রেণীর মানুষ। তাদের পরিবার-পরিজনের অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানিয়েও তারা রেহাই পায়নি।
গভীর ক্ষত
মুসলিম জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য- এমন কয়েকটি শহরে পুলিশ হাজার হাজার মানুষকে ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামি বানিয়েছে। ইচ্ছামতো মুসলমানদের আটক রাখার জন্য এটা করা হয়েছে। এর আরেক উদ্দেশ্য, যারাই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে কিংবা সাক্ষ্য দেবে, তাদের ‘ঠাণ্ডা’ করে দেয়া। কারো হাতে ক্যামেরা দেখলেই মানুষ তাকে কোনো কিছু জানাতে ভয় পায়; আর ক্যামেরার সামনে কিছু বললেও তারা তখন নিজেদের মুখ ঢেকে রাখে। উত্তরপ্রদেশের শহরগুলোতে মুসলিম জনগোষ্ঠী চরমভাবে সন্ত্রস্ত। পুরুষদের আতঙ্কের কারণ, মারাত্মক অপরাধের আসামি বানিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হতে পারে। নারীদের আতঙ্কের কারণ, তাদের ঘরবাড়িতে হামলা চালানো হতে পারে। মুসলিম জনবসতির লোকজনের বিরাট অংশই বাড়িঘর ফেলে পালিয়েছে।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে ‘প্রতিশোধ’ নেয়ার হুঙ্কার দেয়া হচ্ছে। সে মোতাবেক, পুলিশ আরো নৃশংস হামলায় মেতে উঠেছে। সরকারি সম্পত্তির কথিত ধ্বংসের অভিযোগে মুসলমানদের প্রতি নোটিশ জারি করা হয়েছে বিরাট অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য (আর এই সম্পত্তির তালিকায় আছে পুলিশের ডাণ্ডাও, যেগুলো জনগণকে পেটানোর সময় ভেঙে গেছে)। আইন অনুসারে, বিচার বিভাগীয় তদন্তে প্রমাণিত হতে হবে, এ সম্পত্তি ধ্বংসের দায় মুসলমানদের। কিন্তু তা ছাড়াই তাদের নোটিশ দেয়া হচ্ছে।
দুঃখজনক দায়
উত্তরপ্রদেশে পুলিশের চরম তাণ্ডবের খবর যখন আসছিল, তখন এ জন্য কোনো অনুশোচনা না করে মুখ্যমন্ত্রী তার সরকারি টুইটার বার্তায় নিজেদেরই অভিনন্দন এবং বিজয়ের কথা জানান। এতে বললেন, ‘প্রত্যেক দাঙ্গাকারী চমকে উঠেছে। প্রতিটি বিক্ষোভকারী হতভম্ব হয়ে গেছে। যোগী আদিত্যনাথের সরকারকে কঠোর অ্যাকশন নিতে দেখে প্রত্যেক মানুষ চুপ হয়ে গেছে।’
উত্তরপ্রদেশ যা প্রত্যক্ষ করছে, তা হলো ঊর্ধ্বতন সরকারি দফতরের চরিত্রের চরম অবনতি। পুলিশবাহিনী এবং ম্যাজিস্ট্রেসির সিনিয়র সিভিল সার্ভেন্টরা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্বকে মুখ্যমন্ত্রীর ঘৃণার যুদ্ধের কাছে বিসর্জন দিয়েছেন। এটা চরম লজ্জার বিষয়। তিন দশক ধরে কাশ্মিরের মানুষ যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তার প্রতিফলন ঘটেছে উত্তরপ্রদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণাত্মক লড়াইয়ে। নিরাপত্তা বাহিনীগুলো তাদের বাড়িঘরে হামলা করে তাণ্ডব চালাচ্ছে এবং সেখানে নির্দোষ মানুষকে মারধর ও গ্রেফতার করছে। উত্তরপ্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে পছন্দ করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ভারতের সর্বাধিক জনবহুল রাজ্যের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। আর তিনি আবির্ভূত হচ্ছেন ঘৃণার প্রতীক হিসেবে। তার যে অপরাধ, তা মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছে। বেসামরিক জনগণের একটি নির্দিষ্ট অংশের বিরুদ্ধে সরকারের পরিকল্পিত ও ব্যাপক হামলার আওতায় ইচ্ছাকৃতভাবে এ অপরাধ করা হয়েছে।
ভারত দেশটির অন্যসব অঞ্চল এখন উত্তেজনায় পরিপূর্ণ। কারণ, ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদ সৃষ্টিকারী আইন ও নীতির বিরুদ্ধে জনগণ প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এ দিকে, উত্তরপ্রদেশের মুসলিমরা এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে যে, এর নিরাময় প্রায় অসম্ভব।
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত মানবাধিকার সংগঠক, লেখক ও শিক্ষক। এবার নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন।
ভাষান্তর : মীযানুল করীম