গত ৩ জানুয়ারি বাগদাদ বিমানবন্দরে হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র হত্যা করেছে ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে। তিনি ছিলেন ইরানের রেভ্যুলিউশনারি গার্ডের ‘অভিজাত’ কুদস বাহিনীর কমান্ডার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে এই নজিরবিহীন হতাকাণ্ড ঘটানো হয়। ওই দিন ভোররাতে বাগদাদের বিমানবন্দরে সোলাইমানির গাড়িবহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এটা করা হয় অত্যাধুনিক মার্কিন ড্রোন ‘এমকিউ-নাইন রিপার ড্রোন’ দিয়ে। এ হামলায় সোলাইমানিসহ ১০ জন নিহত হন। পাঁচজন ইরানের আর পাঁচজন ইরাকের। ইরাকের পাঁচজনের মধ্যে রয়েছেন আবু মাহদি আল-মুহানদিস, যিনি ইরানের সমর্থনপুষ্ট ‘খাতিব হেজবুল্লাহ’ গ্রুপের কমান্ডার এবং ইরাকি মিলিশিয়াদের একটি জোট পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিটের নেতা। এ ঘটনার পরপরই তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতিতে। এরই মধ্যে বেড়েছে তেলের দাম, পড়ে গেছে অর্থের মূল্য।
ট্রাম্প এই হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেছেন, ‘কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছে যুদ্ধ থামাতে, আরেকটি যুদ্ধ শুরু করতে নয়।’ তবে এই হত্যাকাণ্ডে গোটা দুনিয়ায় যেন বিরাট ঝাঁকুনি সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনা সম্ভবত নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের এবং দেশ দু’টির মিত্রদের মধ্যে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হতে পারে। আবার কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, এ ঘটনাই কি বিশ্বকে এনে দাঁড় করিয়েছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুয়ার প্রান্তে? কারণ অনেকে এ ঘটনাকে মিলাতে চাইছেন বসনিয়ার সারায়েভোতে সেই অস্ট্রিয়ান ক্রাউন প্রিন্স ডিউক ফ্র্যাঞ্জ ফার্ডিন্যান্ডের হত্যাকাণ্ডের সাথে, যা কার্যত ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পথ খুলে দিয়েছিল। হতে পারে বিংশ শতাব্দীর এই প্রথম দিককার ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ পরিস্থিতিতে এই অনুমান একটি অতিরঞ্জিত বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। নিশ্চিতভাবে সোলাইমানির হত্যা-পরবর্তী পরিণাম এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে, যা গোটা বিশ্বকে বড় ধরনের সঙ্কটে ফেলে দেবে। বিগত কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সম্পর্কের যে, চরম অবনতি ঘটেছে তা থেকে এটা স্পষ্ট, সোলাইমানির হত্যা কোনো আকস্মিক অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। বরং তা এই দুই দেশের মধ্যকার বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে চরমে পৌঁছানোর লক্ষ্যে পরিচালিত একটি পরিকল্পিত পদক্ষেপ। এ ঘটনার পর ইরানের শীর্ষনেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির দেয়া বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ইরান এ ঘটনার ‘চরম প্রতিশোধ’ নেবে। তবে এটি বিতর্কের বিষয় যে, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার মেশিনারির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সে ধরনের কোনো চরম প্রতিশোধ পদক্ষেপ নেবে কি না। কেননা সে রকম কিছু ঘটলে তা ইরানের গোটা জাতিকে ঠেলে দিতে পারে এক মহাবিপর্যয়ের মুখে। তা সত্ত্বেও সন্দেহাতীতভাবে এটি সত্য- ইরান শক্তিশালী ওয়ার মেশিনারিসমৃদ্ধ একটি আঞ্চলিক শক্তি, যা বহু বছরের চেষ্টায় গড়ে তোলা হয়েছে যেকোনো সামরিক আক্রমণ প্রতিরোধের লক্ষ্য নিয়ে। এর সামরিক ও প্রাযুক্তিক শক্তিমত্তা ইরানকে করেছে অনন্য এক দেশ। ইরান অন্য সেসব দেশ থেকে আলাদা এক উদাহরণ, যে দেশগুলোর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছে। কিন্তু মনে হয়, ইরান সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে না গিয়ে ছোটখাটো গোষ্ঠীর মাধ্যমে আক্রমণের মধ্যে সীমিত থেকেই আমেরিকাকে থামাতে চাইবে। এ পর্যন্ত ইরানের তৎপরতায় এমনটি মনে হচ্ছে।
এ দিকে খবর আসছে, এ হামলার পর ইরান যে চরম প্রতিশোধ নেয়ার কথা ঘোষণা করেছিল, তা বাস্তবায়নের আলামত কিছুটা হলেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এরই মধ্যে ইরাকে দুই মার্কিন বিমানঘাঁটিতে রকেট হামলা চালিয়েছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এর সত্যতা নিশ্চিত করেছে। তবে এর ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করেনি। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আইআরএনএ এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সেসব মিত্রকে সতর্ক করছি, যারা এই সন্ত্রাসী বাহিনীকে নিজেদের ঘাঁটি ব্যবহার করার সুযোগ দিচ্ছে। যেসব এলাকা ও অঞ্চল থেকে ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হামলা চালানো হবে, সেগুলোকে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হবে।’
আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সামরিক অভিযান শুরু হলে রাশিয়া ইরানের পক্ষ নেবে কি না। আর পক্ষ নিলেও কোন মাত্রায় নেবে? এ ক্ষেত্রে একটি মৌলিক আন্দাজ-অনুমান হচ্ছে, তখন রাশিয়া শর্তহীনভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইরানের পক্ষই নেবে। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া ও ইরানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পর্যালোচনা করলে এই অভিমতের পক্ষে জোরালো অবস্থানই যৌক্তিক বলে মনে হয়। কারণ, আমরা লক্ষ করেছি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেহরান ও রাশিয়ার মধ্যকার রাজনৈতিক সাযুজ্য বেশ সুদৃঢ় ছিল। বিশেষ করে, গত বছরের মে মাসে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানকে হুমকি দিয়েছিলেন, তখন মস্কো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে তেহরানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। তা ছাড়া রাশিয়া স্পষ্টতই সতর্ক ছিল, বাইরের শক্তির প্রভাবে যাতে ইরানে সরকার বদল না হয় সে ব্যাপারে মস্কোকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ রাশিয়া ভালো করেই জানে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা থামাতে ইরানের স্থিতিশীলতা রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, মস্কো ও তেহরান উভয়ের স্বার্থে সিরিয়ার আসাদ সরকারকে রক্ষায় একসাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। অধিকন্তু সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের সময় রাশিয়া ছিল বিশ্ব রাজনীতিতে অনেকটা নিষ্ক্রিয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া বিশ্ব রাজনীতিতে তুলনামূলকভাবে অধিকতর সংশ্লিষ্ট। এ বিষয়টি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, রাশিয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্য নিজেকে একটি ‘গ্লোবাল প্লেয়ারে’ পরিণত করা। এই অ্যাজেন্ডা ২০০৭ সালে নিয়ে আসেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, তার মিউনিখ ভাষণের মাধ্যমে। সেখানে ‘ইউনিপোলার ওয়ার্ল্ড’-এর ব্যাপারে তিনি তার ‘অ্যান্টিপ্যাথি’র কথা প্রকাশ করেছিলেন। সোজা কথায়, তিনি বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের একক প্রাধান্য প্রত্যাখ্যান করেছেন। রাশিয়া মনে করে, একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে ইরানের দুর্দমনীয় ও দুঃসাহসী আচরণ এবং এর সামরিক কৌশল রাশিয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে একটি অন্যতম প্রধান সহায়ক। রাশিয়া তা হারাতে নারাজ। আমরা দেখেছি, এবার সোলাইমানিকে হত্যার কিছু দিন আগে ইরানি, রুশ ও চীনা নৌবাহিনী ওমান উপসাগরে বড় ধরনের সামরিক নৌমহড়া প্রদর্শন করেছে। মস্কো কাসেম সোলাইমানিকে বিবেচনা করত একজন ‘বিচক্ষণ স্ট্র্যাটেজিস্ট’ হিসেবে। রাশিয়া মনে করে, ১৯১৫ সালে যখন সিরিয়ান সেনাবাহিনী শক্তিহীন হয়ে পড়ছিল তখন সেখানে তিনি সিরিয়ান বাহিনীর সাথে রুশ সামরিক বাহিনীর উপস্থিতির ব্যাপারে অপরিহার্য এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। রুশ বিমান হামলাই শেষ পর্যন্ত গেম পাল্টে দেয় সে দেশে। সোলাইমানি ২০১৭ সালে আবার মস্কো সফরে যান। তখন প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল, তখনকার আলোচনার বিষয় ছিল পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে সুন্নি রাজতন্ত্রের সম্পর্কের বিষয়টি। এই প্রেক্ষাপট ভালোভাবেই নির্দেশ করে, সোলাইমানির এই হত্যা রাশিয়ার জন্য একটি বড় ধরনের আঘাত। কারণ তাকে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যসংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের প্রক্সি হিসেবে কাজে লাগাতে পারত।
তা সত্ত্বেও মস্কো সরাসরি নিজের সামরিক বাহিনীকে ইরানের সমর্থনে ব্যবহার করবে, অথবা মার্কিন-ইরান সামরিক দ্বন্দ্বকে উৎসাহিত করবে- এমন ভাবনায় কিছুটা অতিশয়োক্তি আছে বৈ কি। সোলাইমানিকে হত্যার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনকে সরব সমালোচনা করলেও, মস্কো এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে আসলেই কী করবে, সে ব্যাপারে নীরবতাই পালন করছে। পুরনো পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়া শর্তহীনভাবে ইরানকে সামরিক সমর্থন দেবে, তেমনটি ভাবা খুব জোরালো নয়, ঠিক যেমনটি দেশটি সুরক্ষা দিয়েছিল কমিউনিস্ট কিউবাকে। এর পরেও বলতে হয়, রাজনৈতিক বাস্তবতা মস্কোকে কিছুটা তিক্ত করে তুলেছে। মস্কো মনে করে, তেহরান যদি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বড় ধরনের সামরিক বিরোধে জড়িয়ে পড়ে, তবে তা তেহরান সরকারকে আরো দুর্বল করে তুলবে। তা ছাড়া তখন আসাদ সরকারকে সমর্থনের ক্ষেত্রে ইরানের ভূমিকা দুর্বল হয়ে পড়বে। অধিকন্তু এর ফলে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে ইরানবিরোধী দেশগুলোর সাথে, যেমন সৌদি আরব, আরব আমিরাত এবং এমনকি ইসরাইলের সাথে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কারণ এমন কথাও চালু আছে, পুতিনের একটি গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে- ‘মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার মিত্রদেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলা।’
এমনি এক বাস্তবতায় বলা মুশকিল, ইরান-মার্কিন চলমান দ্বন্দ্বে মস্কোর সুস্পষ্ট ভূমিকা কী হবে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য নিয়ামকের উদ্ভব ঘটেছে সোলাইমানিকে হত্যার পর। দ্রুত বেড়ে গেছে জ্বালানি তেলের দাম। ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ২ শতাংশের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯ ডলার, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের পরবর্তী সময়ে সর্বোচ্চ। একটি প্রধান তেল উৎপাদক দেশ হিসেবে এই পরিস্থিতি রাশিয়ার জন্য হঠাৎ করেই আর্থিক মুনাফা বয়ে এনেছে। সব কিছু বিবেচনায় নিলে ধরে নয়া যায়, মস্কো ‘ব্রাদার ইন আর্মস’ হিসেবে তেহরানকে খোলাখুলি সর্বাত্মক সামরিক সহায়তা দেবে না। কিন্তু সম্ভবত রাশিয়া এমন কূটনৈতিক পদক্ষেপই নেবে, যাতে তার মিত্র ইরানের জন্য কোনো ক্ষতিকর সঙ্কট সৃষ্টি না হয়।
সোলাইমানির হত্যার ঘটনাটিকে দেখতে হবে ২০১৮ সালে ইরান এবং ছয় জাতির মধ্যকার পারমাণবিক চুক্তি থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেয়ার পর দেশ দু’টির সম্পর্কের অবনতিশীল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে। এর পর থেকে ট্রাম্প জোরদার করে তোলেন ইরানের ওপর নানামুখী চাপ। ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার তীব্রতা বাড়িয়ে তোলা হয় কয়েক গুণ। ইরানি ভূখণ্ডের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন-নজরদারি হয়ে ওঠে বহুল আলোচিত এক বিষয়। অভিযোগ ওঠে, গত বছর ২০ জানুয়ারি একটি মার্কিন ড্রোন ইরানি আকাশসীমা অতিক্রম করলে, ইরান সেটিকে গুলি করে ভূপাতিত করে। এরপর ইরাকের মাটিতে মার্কিন-ইরান দ্বন্দ্ব রূপ নেয় ‘ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়’ ধরনের দ্বান্দ্বিক পরিবেশে। যেমন, গত বছর ২৯ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে মিলিশিয়া ঘাঁটির ওপর হামলা চালায়। এর প্রতিশোধ হিসেবে ইরানের সমর্থক ইরাকিরা ৩১ ডিসেম্বর বাগদাদে মার্কিন দূতাবাস দখল করে নেয়। অনেক সময় এ ধরনের পাল্টাপাল্টি হামলা সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে যাওয়ার মতো চরম পরিস্থিতির সৃষ্টি করে থাকে। তবে যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের বেলায় সে ধরনের সর্বাত্মক যুদ্ধ বাধা নিয়ে এখনো সংশয় আছে। তবে পরিস্থিতি বিপজ্জনক নয়, তেমনটি নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
হতে পারে, এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির সূচনা হয়েছে পশ্চিম এশিয়ায় ক্ষমতার রশি টানাটানি থেকেও। সৌদি আরব তেল সম্পদের বলে এবং মুসলমানদের পবিত্র স্থান মক্কা ও মদিনার অবস্থান সৌদি আরবে হওয়ার বিশেষ মর্যাদার কারণে মনে করে, তারা মুসলিম দুনিয়ার নেতৃস্থানীয় দেশ। ইরানে ১৯৭৯ সালের ‘ইসলামী বিপ্লব’কে দেখা হয় সৌদি আরবের এই মর্যাদার প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে। এর আংশিক কারণ, ইরান এই বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত করেছে সেখানকার রাজতান্ত্রিক শাসনকাঠামোর। সেই সাথে অবসান ঘটিয়েছে সে এলাকায় মার্কিন আধিপত্যের। তা ছাড়া ধর্মীয় দিক থেকে ইরানের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া জনগোষ্ঠীর মাঝে আছে সৌদি আরবের অনুসৃত ওয়াহাবি মতবাদের বিরোধিতা। দেশ দুটির এই বিরোধ ২০০৩ সালে ইরাকে অ্যাংলো-আমেরিকান অনুপ্রবেশের আগের সময়ে ততটা বড় সমস্যা ছিল না। এরপর ইরাকে ব্যালটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া জনগোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। ইরাকে শিয়াদের ক্ষমতায়ন এবং তাদের সাথে ইরানের শিয়াদের সংযোগের বিষয়টিকে সৌদি আরবের অভিজাতরা নিজেদের মর্যাদাপূর্ণ রাজতান্ত্রিক অবস্থানের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। একই সাথে তারা লক্ষ করল, সিরিয়ার সংখ্যালঘিষ্ঠ শিয়ারা শক্তিশালী হয়ে উঠছে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত, এর আঞ্চলিক মিত্রদের আরোপিত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
এসব কারণে শিয়ারা ও ইরান পশ্চিম এশিয়ায় অধিকতর প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। ইরানের এই ক্রমবর্ধমান প্রভাব ইসরাইলকেও ক্ষুব্ধ করে তোলে। ১৯৭৯ সালের ‘ইসলামী’ বিপ্লবের পর থেকে যখন ইরানের নেতারা সুস্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলে আসছিলেন, তখন থেকেই ইসরাইল ইরানকে ‘ঘোর শত্রু’ হিসেবে দেখে আসছে। ফলে ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে ইরানকে অবদমিত করার যাবতীয় প্রয়াস চালিয়ে আসছে। এখন এ কাজে ওরা সহযোগী হিসেবে পেয়েছে সৌদি আরবকে।
ক্ষমতার এই লড়াইয়ে সৌদি ও ইসরাইলি এলিটরা এক দিকে, অন্য দিকে রয়েছে ইরান এবং এর মিত্ররা। এর ফলে এই অঞ্চলে আরো বড় ধরনের দ্বন্দ্বের শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। বলাবাহুল্য, এই ক্ষমতার লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা হচ্ছে ইরানের বিরুদ্ধে, ইসরাইল ও সৌদি আরবের প্রটেক্টর ও ডিফেন্ডার হিসেবে। এর ফলে এ অঞ্চলে এখন যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বর্ণিত বিষয়গুলোর বাইরে রয়েছে আরো কিছু নিয়ামক, যেগুলো সম্পৃক্ত রয়েছে সম্ভাব্য এই যুদ্ধের সাথে। এগুলো সংশ্লিষ্ট বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথে। আমরা লক্ষ করেছি, বৈশ্বিক ক্ষমতা অনেকটা অপরিবর্তনীয়ভাবে চলে গেছে চীনের ও আরো সুনির্দিষ্ট কিছু দেশের কাছে। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এবং আরো কয়েকটি দেশের ‘মাথাব্যথা’র কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টির ইঙ্গিত পাওয়া যায় পাশ্চাত্যের প্রাধান্যের পতনমুখী প্রবণতার। একটি যুদ্ধ বাধিয়ে তা কি ঠেকানো সম্ভব?
যুদ্ধের বিপদ সম্পর্কে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জানা আছে। যুদ্ধে সব পক্ষের ক্ষতি, কারো কোনো লাভ নেই। যুদ্ধ মানেই শুধু ক্ষতি আর ক্ষতি। তাই বিশ্ব জনগোষ্ঠীর কেউই কোনো যুদ্ধ চায় না। বেশির ভাগ দেশের সরকার সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে, বলেছে এটি আন্তর্জাতিক আইনের নির্লজ্জ লঙ্ঘন। যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ এবং সিনেটের কয়েকজন সদস্য বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ডে মার্কিন প্রেসিডেন্টের অনুমোদন দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের আইনের চরম লঙ্ঘন।’ আমরা যদি মানবিক হই, তবে বলতেই হবে ট্রাম্পের এই হত্যাকাণ্ডের অনুমোদনে অনুসৃত হয়েছে ও অবলম্বিত হয়েছে ‘জঙ্গলের আইন’। সভ্য জগতের আইন-কানুন ও নিয়মনীতির বিন্দুমাত্র উপস্থিতি এখানে নেই। এখন আমেরিকার জনগণের বিরাট দায়িত্ব হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র কি এই জঙ্গলের আইনই অনুসরণ অব্যাহত রাখবে, না সভ্য জগতের আইনের শাসনে ফিরে যাবে, তা নির্ধারণ করা। সুখের কথা, ইরানের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যাতে নিজের ইচ্ছামতো যুদ্ধ ঘোষণা করতে না পারেন, সে জন্য তার ক্ষমতা খর্ব করে গত বৃহস্পতিবার রাতে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ, প্রতিনিধি পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন শুধু এখানেই অমানবিক নয়, ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা আরোপেও চরম অমানবিক আচরণ করছে। সর্বসাম্প্রতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হয়, ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো আপাতত ইরানবিরোধী কোনো সামরিক অভিযানে না গিয়ে এহেন নিষেধাজ্ঞার তীব্রতাই বাড়িয়ে তুলবে। ইতোমধ্যেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় সীমহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ইরানের সাধারণ মানুষকে। এরপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরো জোরালো করে তুললে, তা এই দুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে তুলবে। তা ছাড়া ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান ও ইরাকসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে যুক্তরাষ্ট্র জারি রেখেছে ভয়াবহ অমানবিক থাবা। এতে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং হচ্ছে অগণিত মানুষ। এর অবসানের এখনই সঠিক সময়।