জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ‘ভুল’ করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইউক্রেনের বিমানকে বিধ্বস্ত করেছে ইরান। ইরানের এ ‘ভুল’ মেনে নিতে পারছেন না অনেক ইরানিই, তারা শুরু করেছেন সরকারবিরোধী আন্দোলন।
এ আন্দোলনকারীরা ও ইরানের বিরোধী দলগুলো কতটা শক্তিশালী, সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
কাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হচ্ছে?
ইউক্রেনের বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে শুরু করে ইস্পাহানের মতো আরও কয়েকটি শহরে সাম্প্রতিক সময়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ মানুষ। আন্দোলনকারীদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ।
আন্দোলনকারীরা ১৭৬ যাত্রী নিয়ে বিমান বিধ্বস্তে সত্য গোপন করা ইরান সরকারের সমালোচনা করেন। তারা ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও ইসলামী শাসনের বিরুদ্ধেও স্লোগান দেন।
বিবিসির সংবাদকর্মী রানা রহিমপুর বলেছেন, ‘আন্দোলনকারীদের অনেকেই বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের চেনেন। যেহেতু তাদের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ছিল এবং বিদেশে ভ্রমণের সামর্থ্য ছিল।’
তবে খামেনি, ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ দানা বেঁধেছে কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না।
পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানি অধ্যাপক ফাতেমেহ শামস বলছেন, ‘এটা বলা কঠিন যে, এখানে এমন কোন ব্যক্তি আছে, যাকে ঘিরে মানুষ এখন ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।’
ইরানের বিরোধী রাজনীতির অবস্থা
ইরানে নির্বাচনী ব্যবস্থা রয়েছে, তবে দেশটির সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে ইসলামিক শাসনের কাঠামোর মধ্যে থাকতে হয়। ২০১৬ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রায় অর্ধেক প্রার্থীকে অযোগ্য করে ইরানের ‘গার্ডিয়ান কাউন্সিল’। এ কমিটি দেখভাল করে কোন প্রার্থী ইসলামিক নিয়ম-কানুন মেনে চলেন এবং ইসলামিক নিয়ম-কানুন রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এদিকে আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য পার্লামেন্ট নির্বাচনের জন্য হাজার হাজার সম্ভাব্য প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে ‘গার্ডিয়ান কাউন্সিল’, যার মধ্যে ৯০ জন আইনপ্রণেতাও রয়েছেন। যারা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরোধিতা করেন তাদের কোনো ক্রমেই প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় না।
শুধু পার্লামেন্টেরিয়ান নন, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর ওপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে ‘গার্ডিয়ান কাউন্সিল’।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ‘গার্ডিয়ান কাউন্সিলের’ অর্ধেক সংখ্যক সদস্য নিযুক্ত করে থাকেন। তিনিই দেশটির সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তিনিই ইরানের সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ এবং সুরক্ষা, প্রতিরক্ষা এবং প্রধান বৈদেশিক নীতি সম্পর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন।
ইরানের ভেতরে কুর্দি, আরব, বালুচিস এবং আজারবাইজানিদের মতো জাতিগত সংখ্যালঘুরা রয়েছেন, তাদের জন্য বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতেও আন্দোলন হয়। এসব বিরোধীদলের মধ্যে রয়েছে- ইরানিয়ান কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি। এ সশস্ত্র সংগঠনটি ইরান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে লড়াই করে আসছে।
ইরানের বিরোধী নেতা কারা?
ইরানে বহু বছর ধরে একটি সংস্কারবাদী আন্দোলন চলছে। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামিকে এ সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্রধান ব্যক্তিত্ব ধরা হয়।
১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন খাতামি কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে এসেছিলেন এবং পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কিছু প্রস্তাব রেখেছিলেন। তবে রক্ষণশীল স্বার্থরক্ষার কারণে আরও বড় ধরনের পরিবর্তনগুলো আটকে দেওয়া হয় এবং খাতামির গতিবিধি ও গণমাধ্যমের সামনে তার হাজির হওয়া সীমিত করার মাধ্যমে তাকে কোণঠাসা করা হয়।
২০০৯ সালে এক বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন মাহমুদ আহমাদিনেজাদ। তার কাছে পরাজিত মীর হোসেইন মুসাভি এবং মেহেদী কারুবি ভোটের ওই ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ জানান এবং তারা গ্রিন মুভমেন্ট হিসেবে পরিচিতি একটি দলের নেতা হয়ে ওঠেন। সে সময় পুনরায় নির্বাচনের দাবিতে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসলেও আয়াতুল্লাহ খামেনি জোর দিয়ে বলেন নির্বাচনের এই ফল যথাযথ।
প্রতিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া
২০০৯ সালে শুরু হওয়া বিক্ষোভ থামাতে তাণ্ডব শুরু হয় এবং বেশ কয়েকজন বিরোধী সমর্থক নিহত হন বলে জানা যায়। তখন দেশটির বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় অনেক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। মুসাভি এবং মিস্টার কারুবি এক দশক পরেও গৃহবন্দী রয়েছেন।
অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি নিয়ে ২০১৭ সালের শেষে এবং ২০১৮ সালের শুরুতে বিক্ষোভ শুরু হয়। বেকারত্বের মাত্রা বাড়তে থাকায় তরুণ জনগোষ্ঠী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষও উদারপন্থী হিসেবে বিবেচিত প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সরকারের অর্থনীতি পরিচালনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হন।
বিক্ষোভকারীরা দেশটির নেতাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন এবং ১৯৭৯ সালে পতন হওয়া রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানান। এই অস্থিরতার কারণে দেশটিতে রক্তাক্ত বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দাবি করেছে, ওই সহিংসতায় ৩০৪ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, তবে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে নিহতের সংখ্যা ১৫০০ জন বলে দাবি করা হয়। তবে ইরান সরকার দুটি পরিসংখ্যান অস্বীকার করেছে।
সাম্প্রতিককালে বিক্ষোভগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য হলো- এগুলো প্রায়ই নেতৃত্বহীন ছিল এবং মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব এবং বৈষম্যকে আরও প্রশ্রয় দিয়ে তৃণমূলকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তীব্র অস্থিরতা সত্ত্বেও বিরোধীদের বিরুদ্ধে দমনমূলক পদক্ষেপ সেইসঙ্গে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের মধ্যে দিয়ে সরকার নিয়ন্ত্রণে থাকতে পেরেছে।