দেশের উন্নয়নে হাতে নেওয়া হয়েছে বড় বড় অনেক প্রকল্প। কিন্তু রাজস্ব ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ প্রয়োজনের তুলনায় কম। ঘাটতি পূরণে তাই বাড়ছে বৈদেশিক ঋণের বোঝা। ‘অস্বাভাবিকভাবে’ বৈদেশিক ঋণ নেওয়ায় গত সাত বছরে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ ২৫৭ ডলার থেকে ১১৮ শতাংশ বেড়ে ৫৬১ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আর এই সাত বছরে মোট বিদেশি ঋণ বেড়েছে ১৩৩ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে সরকারি-বেসরকারি বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৬০০ কোটি ডলারে।
এদিকে বিদেশি ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর সুদ-আসল পরিশোধের চাপও বাড়ছে। বিগত অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধের অংক ছিল ২০০ কোটি ডলার, যা ২০২৪ অর্থবছরে ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান বৈদেশিক ঋণ আমাদের সমকক্ষ দেশের তুলনায় কম। আমরা তো বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, জাইকা, চীন, ভারত ও রাশিয়ার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকি। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, জাইকার সঙ্গে লেনদেন বেশ পুরনো। তাদের ঋণ তুলনামূলক সহজ শর্তে এবং দীর্ঘমেয়াদে পাওয়া যায়। তবে দ্বিপক্ষীয় ঋণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। কেনাকাটার ক্ষেত্রে নানা রকম কথা শোনা যায়। এ ছাড়া তা স্বল্পমেয়াদি। ফলে এসব ঋণ নিয়ে বর্তমানে সমস্যা না হলেও ভবিষ্যতে সমস্যা তৈরি হবে।
বিদেশি ঋণ-পরিস্থিতির অবনতি শুধু অংকেই ঘটেনি, অর্থনীতির মৌলিক সূচকগুলোর অনুপাতেও ঝুঁঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে মোট জিডিপির সাড়ে ১৫ শতাংশ ছিল বিদেশি ঋণ। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৬ শতাংশে। একই সময়ে জাতীয় আয়ের অনুপাতে বিদেশি ঋণ ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৯ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ সময় বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের হারও কমে গেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট ঋণের ৭৩ দশমিক ৭ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে নেমে এসেছে ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশে।
সাধারণভাবে ঋণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে কিনা, তা বিবেচনার জন্য বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের চলতি হিসাবের প্রাপ্তির সঙ্গে বৈদেশিক ঋণের অনুপাত গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হিসেবে দেখা হয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চলতি হিসাবে প্রাপ্তির ৭৮ দশমিক ২ শতাংশ ছিল বিদেশি ঋণ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১৭ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হয়। রপ্তানি আয়ের বিপরীতে বিদেশি ঋণ পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয়ের ১২২ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল বিদেশি মোট ঋণ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৮৭ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এটি অবশ্য আগের অর্থবছরে ছিল রেকর্ড ২১৩ দশমিক ১ শতাংশ। গত অর্থবছরে রপ্তানির বিপুল প্রবৃদ্ধিতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
বিদেশি ঋণের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ লেনদেনের ভারসাম্যে বেশি চাপ সৃষ্টি করে। এ কারণে বাংলাদেশ এক সময় স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ গ্রহণকে উৎসাহিত করত না। কিন্তু সাত বছরে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অনুপাতে ২৩ শতাংশ ছিল স্বল্পমেয়াদি ঋণ, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ দাঁড়ায় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ৪৯ দশমিক ৪ শতাংশে। একই সময়ে মোট ঋণের চেয়ে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ ১৭ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ২১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
সাত বছরের ব্যবধানে সরকারি খাতে ঋণের অনুপাত কিছুটা কমলেও বেসরকারি ঋণের অনুপাত বেড়েছে। বেসরকারি ঋণ সাত বছর আগে ছিল মোট ঋণের ২১ দশমিক ৪ শতাংশ। এখন তা ২৭ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বেসরকারি বিদেশি ঋণে সরকারের সার্বভৌম গ্যারান্টি থাকায় ঋণগ্রহীতা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে দায় শোধ করতে হবে সরকারকে। বেসরকারি খাতের ঋণ গ্রহণ সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরের বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ১৯ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ৯ মাস পরে গত জুনে এই স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ২৫.৯৫ বিলিয়ন ডলারে।
এদিকে দেশি-বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকায় সুদ পরিশোধের চাপও বাড়ছে। বিগত অর্থবছরে ২ বিলিয়ন ডলার সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয়েছে বাংলাদেশকে, যা চলতি অর্থবছরে ২ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এটি ৩ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার এবং পরের বছর ৪ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হবে ৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।