ঘরে বিদ্যুৎ না থাকলে জনজীবনে যে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি হয়, গত মঙ্গলবার দুপুর-পরবর্তী বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ফলে সে কথাটি আরও একবার প্রমাণিত হয়ে গেল।
ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় বড় শহরসহ দেশের পূর্বাংশের সমগ্র এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ায় সেসব এলাকার জনগণ ঘরে টিকতে না পেরে ঘরের বাইরে এসে অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় তারা পানিসহ আলো-বাতাসের অসুবিধায় সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছিলেন।
অতঃপর কোনো কোনো এলাকা ৪-৫ ঘণ্টা বা ৬-৭ ঘণ্টার মধ্যে সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসায় সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। আর ঘটনাটি যেহেতু আকস্মিক, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং কারও ইচ্ছাকৃত দোষত্রুটিতে ঘটেছিল বলে আপাতত প্রমাণিত নয় বিধায় অসহনীয় হলেও জনসাধারণ বিষয়টি মেনে নিয়েছিলেন। এখানে ‘আপাতত প্রমাণিত নয়’ বলার কারণ হলো, বিষয়টি তদন্তাধীন।
যা হোক, সমগ্র দেশের পূর্বাংশজুড়ে ঘটে যাওয়া বিদ্যুতের এমন মহাবিপর্যয়ের ফলে সেসব অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও যে বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সে কথাটিও উল্লেখযোগ্য। সুতরাং বিষয়টি খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ টেলিফোন, ইন্টারনেট, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রই বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের শিকারে পরিণত হয়।
বিদ্যুতের অভাবে লাইট, ফ্যান বন্ধ থাকায় অন্ধকারসহ ভ্যাপসা গরমে জনজীবন যেমন অসহনীয় হয়ে ওঠে; পাশাপাশি পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেসব কষ্ট আরও চরম আকার ধারণ করে। আর মঙ্গলবারের ঘটনায় সেসব দুঃখ-কষ্টই সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণকে ভোগ করতে হয়েছে।
আগেই বলেছি, সেদিনের ঘটনা কারও ইচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটির কারণে ঘটেছে কিনা সে বিষয়টি এখন তদন্তাধীন। তবে সারা দেশের মফস্বল এলাকায় একশ্রেণির বিদ্যুৎকর্তা যে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের খেয়াল খুশিমতো যখন যে এলাকায় খুশি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ করে রেখে মুখচেনা ব্যক্তিদের ঘরবাড়িতে সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সেবা প্রদান করেন; সে কথাটি বলাই বাহুল্য।
আর সাক্ষ্যপ্রমাণসহ সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করাই আজকের লেখাটির মূল উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য, আমি নিজে ঘুরেফিরে বছরের অর্ধেকটা সময় ঢাকায় এবং বাকি অর্ধেক সময় আমার পাবনার বাড়িতে অবস্থান করি। আর পাবনার বাড়িটি আগে পৌর এলাকার বাইরে অবস্থিত থাকলেও, বর্তমানে তা পৌর এলাকার অন্তর্ভুক্ত এবং সে দৃষ্টিকোণ থেকে বছরের অর্ধেক সময় আমি পাবনার শহরতলিতে অবস্থান করি। এ অবস্থায়, বর্তমানে ঢাকার বিদ্যুৎ ব্যবস্থাসহ মফস্বল জেলার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সম্পর্কে আমার মোটামুটি একটি ধারণার সৃষ্টি হয়েছে।
এর আগে বগুড়া শহরে বসবাসকারী আমার একজন ফেসবুক বন্ধুর পোস্টিং থেকে জেনেছিলাম, বর্তমান অবস্থায় তার জেলার মানুষ দৈনিক ১২-১৪ ঘণ্টাই বিদ্যুৎবঞ্চিত থাকেন। সেদিন তার বক্তব্যটি পাশ কাটিয়ে গেলেও আজ এখন মনে হচ্ছে, সেদিন তিনি ঠিকই বলেছিলেন। কারণ, গতবার এবং এবার দু’দফায় পাবনা এসে যা বুঝলাম, তাতে প্রশ্ন জাগল, ‘লোডশেডিং কাহাকে বলে, উহা কত প্রকার ও কী কী?’ সে বিষয়টি পাবনার নেসকো কর্তারা বেশ ভালোভাবেই পাবনার মানুষকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
বিশেষ করে শহরতলিসহ একটু ভেতরের বা একটু দূরের মানুষকে তারা বিদ্যুৎ ব্যবহারের উপযোগী মানুষ বলে বিবেচনা করেন কিনা সে বিষয়ে আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ শহরতলি বা একটু ভেতরের এলাকায় টানা ৩-৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ করে রাখার বিষয়টিকে তারা কোনো ব্যাপার বলেই মনে করেন না। অথচ এ বিষয়ে শহরে বসবাসকারী আমার আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবকে জিজ্ঞেস করায় তারা বলেছেন, তাদের এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ মোটামুটি ভালো।
কখনো বিদ্যুৎ চলে গেলেও তাড়াতাড়িই আবার চলে আসে। তাদের এসব কথায় বেশ বোঝা যায়, তাদের সংযোগগুলো কোনো না কোনো ভিআইপি বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একই লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত। আর এসব বিষয়ে আরও খোঁজখবর করে যা জানা গেল তা-ও বেশ বিস্ময়কর! শহর এলাকার প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ ভিআইপি বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সবার বাড়িতেই একাধিক লাইন থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া আছে।
ফলে এক লাইনের বিদ্যুৎ চলে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তারা অন্য লাইন থেকে বিদ্যুৎ পেয়ে যান। এমনকি নেসকোর কর্মকর্তারা যেসব বাড়িতে ভাড়া থাকেন, সেসব ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে শহরতলিসহ শহরের বাইরের বিদ্যুৎ গ্রাহকদের বঞ্চিত করে তেলে মাথায় তেল দেওয়ার নীতি গ্রহণ করা হয়। আর বর্তমানে বিদ্যুৎ বিতরণের ক্ষেত্রে যে শহরতলিসহ শহরের বাইরের মানুষের সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বা গ্রাহকের মতো আচরণ করা হচ্ছে, আমার কাছে সেসব ঘটনার বিস্তর প্রমাণ আছে।
তাছাড়া নেসকো পাবনার বিদ্যুৎ বিতরণের যদি কোনো শিডিউল রেজিস্টার বা রেকর্ড থাকে সেখানেও এসব ঘটনার প্রমাণ থাকার কথা। এ অবস্থায়, বিদ্যুৎ বিতরণে গ্রাহকদের দুই ভাগে ভাগ করে ফেলায় সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ এ ক্ষেত্রে একটি শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি করে ফেলেছেন। ঢাকা, পাবনা- এ দুটি স্থানের বিদ্যুৎ বিতরণে অনিয়মের চিত্রটি আমার কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হওয়ায় এ বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই যে, বিদ্যুৎ ঘাটতির সময়ে বিদ্যুৎ বিভাগ মুখচেনা এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রেখে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সৃষ্টির মাধ্যমে তারা সাধারণ মানুষের প্রতি অবিচার করে চলেছেন।
আর এসব ঘটনা সরকারের উচ্চতর মহলেরও জানা উচিত বলে মনে করি। দেশের সাধারণ মানুষও সরকারকে ট্যাক্স প্রদান করেন। একটি বিড়ি-সিগারেট ফুঁকতে বা একটি মোবাইল কল করতেও সরকারি কোষাগারে তাদের ট্যাক্স জমা করতে হয়। সুতরাং বিদ্যুৎ বিতরণের ক্ষেত্রে এসব নিরীহ সাধারণ মানুষকে দুই বা তিন নম্বর কাতারে ফেলে ‘আগে আমি বা আমরা খাব তারপর যদি কিছু বাঁচে তাহলে সেই উচ্ছিষ্টটুকু তুমি বা তোমরা পাবে’-এ নীতি গ্রহণ অত্যন্ত নিন্দনীয় ব্যাপার বলেই বিবেচিত হওয়া উচিত।
আর বিদ্যুৎ বিভাগ তথা সরকারেরও এ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। অন্যথায় বিদ্যুৎ বিতরণেও শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি করে এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করলে সাধারণ মানুষও তলে তলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন। কারণ আজকাল সবাই সবকিছু জানতে ও বুঝতে শিখে গেছেন। সাধারণ মানুষ তাদের চোখের সামনে ভিআইপি বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বাড়িতে বিরামহীন বিদ্যুতের আলো জ্বলতে দেখবেন, আর নিজেরা ২৪ ঘণ্টার ১২-১৪ ঘণ্টাই বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় লাইট, ফ্যান কিছুই ব্যবহার করতে পারবেন না, পানি পাবেন না, অন্ধকারে মশার কামড় খাবেন, তেমন ঘটনা বোধহয় সরকারের জন্যও সুখকর হবে না। সামনের নির্বাচনেও কিন্তু এসবের প্রভাব পড়তে পারে।
উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ বিতরণে অব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমি পাবনায় এসে যা দেখলাম বা দেখছি, তাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিষয়টি জানা দরকার বলেই কথাগুলো সরাসরিই বলে ফেললাম। কারণ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এসব বিষয়ে ভ্রূক্ষেপ করেন বলে মনে হয় না।
অন্যথায় পাবনার শহরতলিসহ ভেতরের এলাকাগুলো একনাগাড়ে ৪-৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ রাখাসহ এভাবে ২৪ ঘণ্টার ১২-১৪ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা বা প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টার মধ্যে ৩-৪ বার বিদ্যুৎ আসা-যাওয়াসহ, দিনে ১০-১২ বার আসা-যাওয়ায় অনেকের ফ্রিজের খাবার পচে নষ্ট হলে, ব্যবহার্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেলে এসব ঘটনায় জনপ্রতিনিধিদের টনক নড়ত।
যা হোক, এ বিষয়ে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, ‘পাবনার নেসকো কর্তৃপক্ষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গড়ে প্রতিদিন ১০-১২ বার বিদ্যুতের আসা-যাওয়া ঘটানোয় সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠায় শহরতলিসহ শহরের বাইরের এলাকার জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আর এ বিষয়ে কেউ তদন্ত করে ঘটনার সত্যাসত্য প্রমাণ করতে চাইলে ‘বাজিতপুর রোডের’ গত এক মাসের তথ্য যাচাই করলেই আশা করি তা প্রমাণিত হয়ে যাবে। এখন কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে নেসকো পাবনার এসব অনিয়মের বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে পারে।
কারণ গত মঙ্গলবারের ঘটনায় দেশের পূর্বাঞ্চলের মানুষ বিদ্যুতের অভাবে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে যেমন ঘর ছেড়ে রাস্তাঘাটে বেরিয়ে এসেছিলেন, আমাদের পাবনার মানুষও এলাকাভিত্তিক বিদ্যুতের অভাবে ঠিক একইভাবে যন্ত্রণায় ছটফট করেন। পার্থক্য শুধু এটুকু-যেসব এলাকায় একনাগাড়ে ৪-৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়, সেসব এলাকায় ৪০-৫০ হাজারের মতো মানুষ ভোগান্তি পোহান।
আর এভাবে চাতুর্যতার সঙ্গে ঘুরেফিরে শহরের বাইরের সব এলাকার মানুষকেই ভোগান্তিতে ফেলা হয়। তাই মঙ্গলবারের ঘটনাটি সারা দেশের মানুষ জানতে পারলেও পাবনাসহ মফস্বল জেলাগুলোর শহরবহির্ভূত এলাকার জনগণের বিদ্যুৎসংক্রান্ত ভোগান্তির চিত্রগুলো আড়ালে আবডালেই পড়ে থাকে।
আমার পাবনা শহরসংলগ্ন ‘বাজিতপুর রোডের’ বিদ্যুতের অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছি আরও একটু ভেতরের অবস্থাটা কেমন। সেদিনের সেই ফেসবুক বন্ধুর মন্তব্য পড়েও এখন বুঝতে পারছি তার কথাটিও সঠিক। অথচ বিদ্যুৎ খাতে আমার এবং তারসহ আমাদের সবার ঘাড়েই ঋণের বোঝা! প্রশ্ন হলো, তাহলে এসব ঋণের টাকা কোথায় যায়, কে খায়? নাকি সড়কপথ নির্মাণের মতো বিদ্যুতের লাইন নির্মাণের টাকাও হাওয়া হয়ে যায়।
মফস্বলে বসে শুনতে পারলাম রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় প্রচুর অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কই, কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না। শেষমেশ হয়তো দেখা যাবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের মতো এ ক্ষেত্রেও ব্যয় বাড়ানোর জন্য সময় বাড়িয়ে নিয়ে ছয় মাস বা এক বছরের কাজ পাঁচ বছরে করা হবে। কে জানে কত টাকার কাজ কত টাকায় করা হবে। কারণ, সড়কের কাজ মাটিতে হলেও বিদ্যুতের কাজ উপর দিয়ে হয়।
ফলে এ ক্ষেত্রে দুর্নীতির খবরও তেমন চাউর হয় না! যাক সে কথা। সবশেষে বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে অনুরোধ জানিয়ে বলতে চাই, বিদ্যুৎ বরাদ্দ এবং বিতরণের ক্ষেত্রে মফস্বল অঞ্চলকেও গুরুত্ব দেওয়া হোক। কারণ, দেশের ক্ষমতার উৎস জনগণ; আর মফস্বলের মানুষও জনগণেরই অংশ।
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট