বাংলাদেশের বিপক্ষে ভারতের ক্রিকেট ম্যাচে বরাবরই উত্তেজনা থাকে, থাকে রোমাঞ্চ আর দু’দেশের সমর্থকদের আবেগ। তবে এর সাথেই চলে কিছু বিতর্ক, যা নিয়ে দু’দেশের সমর্থকদের অনেকেই সোশাল মিডিয়ায় বিতর্কে মেতে ওঠেন।
বুধবার এডিলেইডে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভ পর্বের একটি ম্যাচে ভারত বাংলাদেশকে ৫ রানে হারিয়েছে। ম্যাচের এই ফলাফল নির্ধারণ হয়েছে ক্রিকেটের বৃষ্টি সংক্রান্ত আইন প্রয়োগের পর।
ম্যাচে ৫ রানের এই হার বাংলাদেশের সমর্থকদের অনেকেই মানতে পারেননি। অনেকের অভিযোগ, মাঠের আম্পায়াররা এমন কিছু সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, যা শেষ পর্যন্ত ভারতের পক্ষে দেয়া হয়েছে বলে মনে হয়েছে। ফলে ম্যাচের ভারসাম্য খানিকটা হলেও ভারতের পক্ষে হেলে গিয়েছিল।
বিরাট কোহলির ‘ফেক ফিল্ডিং’
উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান নুরুল হাসান সোহান ম্যাচের পর গণমাধ্যমে বলেন, ‘একটা ফেক থ্রোয়ের ঘটনা ঘটেছিল। সেটা ৫ রানের পেনাল্টি হতে পারতো। আমরা যদি সেটা পেতাম আমাদের জন্য ভালো হতো। কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত হয়নি।’
এই ফেক ফিল্ডিং নিয়ে আজও সমর্থকেরা আলোচনা করছেন।
ক্রিকেট বিশ্লেষক হারশা ভোগলে টুইটারে লিখেছেন, ‘মূলত কেউ খেয়ালই করেনি বিষয়টি। আম্পায়াররা না, ব্যাটসম্যানরাও না, এমনকি আমরাও (ধারাভাষ্যকাররা) না। ৪১.৫ আইনে আছে যে, ফেক ফিল্ডিং হলে আপনাকে পেনাল্টি রান দেবেন আম্পায়াররা। কিন্তু কেউ তো দেখেইনি। এখন আপনার কী করার আছে।’
পাকিস্তানের ক্রিকেট সাংবাদিক ফরিদ খান টুইটে বলেন, ‘এটা চেক করা দরকার ছিল। এটাকে আসলেই গুরুতর ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে। এর আগে (দক্ষিণ আফ্রিকার) কুইন্টন ডি কক পাকিস্তানের সাথে এমন করেছিলেন এবং আমি মনে করি এই ঘটনা শাস্তির আওতায় আনা দরকার।’
ঘটনাটি ছিল এ রকম- এডিলেডের ম্যাচের সপ্তম ওভারে লিটন দাস অফ সাইডে বল ঠেলে দিয়ে রান নেন। তখন বিরাট কোহলি ভান করেন যে তিনি আরশদীপ সিংয়ের করা একটি থ্রো থেকে বল ধরেছেন এবং বলটি তিনি আবার থ্রো করছেন। ততক্ষণে কিন্তু বল উইকেটকিপার দিনেশ কার্তিকের হাতে চলে গিয়েছিল।
মাঠে থাকা দু‘আম্পায়ার মারাইস ইরাসমাস ও ক্রিস ব্রাউন বিষয়টি খেয়াল করেননি। এমনকি মাঠে থাকা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাও বিষয়টি খেয়াল করেননি তখন।
ক্রিকেট আইনের ৪১.৫ ধারায় বলা আছে, ‘ফিল্ডিংয়ের সময় ব্যাটসম্যানকে ইচ্ছা করে ভুল বোঝানো, ধোকা দেয়া কিংবা যদি বাধা দেয়া হয়, তবে তা আইনের পরিপন্থী। এক্ষেত্রে আম্পায়াররা বলটিকে ডেড ঘোষণা করতে পারেন এবং ব্যাটিং দলকে পাঁচ রান পুরস্কার দিতে পারেন।’
টেলিভিশন রিপ্লেতে অবশ্য দেখা যাচ্ছিল যে বিরাট কোহলি থ্রো করার ভান করছেন।
ইএসপিএনক্রিকইনফোর প্রতিবেদক মোহাম্মদ ইসামের মতে, ‘এটা তাৎক্ষণিক আম্পায়ারদের নেয়ার মতো একটি সিদ্ধান্ত যে, কোহলি যে কাজটা করেন, তাতে ব্যাটসম্যানদের সমস্যা হয়েছে নাকি এটি কেবল একটি চেষ্টা ছিল।’
বিরাট কোহলির আপিল এবং নো বল
ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ ঠিক পাঁচ রানেই হেরেছে। আর এই ম্যাচে আম্পায়ারিং নিয়ে মাঠেই ভিন্ন ধরনের এক ঘটনার জন্ম দেন সাকিব আল হাসান ও বিরাট কোহলি।
ভারতের ইনিংসের ১৬তম ওভারে বাংলাদেশের ফাস্ট বোলার হাসান মাহমুদ দু’টি বাউন্সার ডেলিভারি দেন। দ্বিতীয় বাউন্সারের পর আম্পায়ারের কোনো ঈশারার আগেই ভিরাট কোহলি হাত উঠিয়ে দেখান ‘নো বল’, এবং এরপর আম্পায়ার ইরাসমাস সেটিকে নো বল ডাকেন।
সাকিব তখন ভিরাটের কাছে যান, হাসিমুখে কথা বলেন এবং তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন।
ক্রিকেট উপস্থাপক হারশা ভোগলে তখন টেলিভিশন ধারাভাষ্যে বলেন, ‘আমার মনে হয় না সাকিব বিষয়টি পছন্দ করেছেন।’
এই নো বলের ফলে পাওয়া ফ্রি হিট দিনেশ কার্তিক কাজে লাগাতে পারেননি- মাত্র এক রান আসে ওই বল থেকে। তবু হারজিতের ব্যবধান যখন মাত্র পাঁচ রানের, তখন নো বল থেকে পাওয়া একটি রান এবং ফ্রিহিটে নেয়া এক রানও অনেক তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এর আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচেও ভারতের এই তারকা ব্যাটসম্যান কোমর সমান উচ্চতার বলে আম্পায়ারের দিকে ঈশারা করেছিলেন ‘নো বল’ এর জন্য। এ নিয়ে পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা মাঠেই আম্পায়ারের কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
লিটন দাস এডিলেইডে ব্যাট করতে নেমে ৩টি ছক্কা ও ৭টি চারে সাজানো ইনিংসে ২৭ বলে ৬০ রান তোলেন।
বৃষ্টি সংক্রান্ত আইনে রানের হিসেব নিয়ে বিতর্ক
বাংলাদেশের সমর্থকদের কেউ কেউ গতকালের ম্যাচের ফলাফলে ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন মেথডে দলের জন্য যে লক্ষ্য দাঁড়িয়েছিল, সেটি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
বৃষ্টি আইন নামে বহুল পরিচিতি ডিএলএস মেথডে কত রান, কতো উইকেট এবং কতো ওভার থাকলে নির্ধারিত লক্ষ্য পরিবর্তন হয়ে কতো দাঁড়ায়, সে ব্যাপারে একটি চার্ট গতকালই সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।
ওই চার্টে দেখানো হয়েছিল যে ১৬ ওভারে বাংলাদেশের লক্ষ্য হওয়ার কথা ১৩৩ রান।
তবে ক্রীড়া ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রিয়ম মজুমদারের মতে, ওই চার্ট মূলত একটা পার স্কোরের হিসাব। এটা এমন নয় যে, এই ম্যাচে এভাবে গণনা করা হয়েছে, তাই সবক্ষেত্রে এমন ভাবেই গণনা করা হবে। এটা একেক ম্যাচে একেকভাবে হিসেব করা হয়।
বিষযটি তিনি ব্যাখ্যা করেন এভাবে : ‘যেহেতু ৭ ওভার খেলা শেষ হবার পর ৪ ওভার খেলা কমেছে, তাই এই শিট থেকে ৮-১১ ওভার অর্থাৎ এই ৪ ওভারের রান বাদ দেয়া হবে, মানে শিটের ডেটা অনুযায়ী ১১ ওভারের রান (৮৩) থেকে ৭ ওভারের রান (৪৯) বাদ দেয়া হবে।’
‘অর্থাৎ ৮৩-৪৯=৩৪ রান বাদ দেয়া হবে টোটাল টার্গেট থেকে। অর্থাৎ ভারতের রান যেহেতু ছিল ১৮৪, তাই সেখান থেকে ৩৪ বাদ দিয়ে ১৫০ রান হল ডিএলএস পার স্কোর। আর জিততে হলে ১ রান বেশি করতে হবে বাংলাদেশকে। তাই রিভাইজড টার্গেট দেয়া হয়েছে ১৫১।’
প্রিয়ম মজুমদার বলেন, ‘এখানে মনগড়া হিসেব করার কোনো সুযোগই নেই। ডিএলএস সফটওয়্যার আছে। সেটা দিয়ে একদম খাটি অঙ্ক কষে এই হিসেব করা হয়।’
ভেজা মাঠ নিয়ে বাংলাদেশের অজুহাত নেই
বাংলাদেশের গতকাল স্টার পারফর্মার ছিলেন লিটন দাস- বৃষ্টি নামার আগে চার ছক্কার ডালি সাজিয়েছিলেন তিনি। ভুবনেশ্বর কুমার, আরশদীপ সিং, মোহাম্মদ শামীর মতো বোলাররা পাওয়ার প্লেতে বল করেছিলেন। লিটন সাতটি চার ও তিনটি ছক্কা হাঁকান ওই সময়ে।
ভারত আর পাকিস্তানের সমর্থকেরাও লিটনের এই ২৭ বলে ৬০ রানের ইনিংসের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন টুইটারে।
বৃষ্টি নামার সময় বাংলাদেশের স্কোর ছিল সাত ওভারে ৬৬ রান। কিন্তু বৃষ্টির পর মোট ১৬ ওভারে ১৫১ রানের নতুন লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমেই লিটন দাসের উইকেটটি হারায়। দুই রান নিতে গিয়ে লিটন দাস পা পিছলে মাঝপথে পড়ে গিয়েছিলেন। আর ওই সময়ে লোকেশ রাহুল বল নিয়ে ডিরেক্ট থ্রো করে স্ট্যাম্প ভাঙ্গেন। মাঠেই লিটন দাসকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছিল।
এর আগের বলেই লিটন এক রান নিতে গিয়ে স্লিপ করেছিলেন এবং তাকে চিকিৎসা সেবা নিতে হয়েছিল।
বাংলাদেশের সমর্থকেরা এটা মানতে পারেনি। ‘এমন অনুপযুক্ত মাঠে তাড়াহুড়ো করে খেলা শুরু করা কেন?’- অভিযোগ করছিলেন ক্রিকেট সমর্থক আমিনুল ইসলাম।
তবে ভেজা মাঠ নিয়ে অভিযোগ করতে রাজি নন বাংলাদেশের অধিনায়ক। সংবাদ সম্মেলনে সাকিব আল হাসান বলেন, ‘মাঠ ভেজা থাকলে সব সময় ব্যাটিং দল সুবিধা পায়। তাই এটাকে আমি অজুহাত হিসেবে দেখাতে চাই না।’
লিটন দাস ছাড়া অবশ্য অন্য ব্যাটসম্যানদের দৌড়ে রান নিতে তেমন সমস্যায় পড়তে দেখা যায়নি। তবুও ম্যাচের পরে প্রেস কনফারেন্সে ভেজা মাঠের বিষয়টিই বারবার উঠে এসেছিল।
ভারতের একজন সাংবাদিক সাকিব আল হাসানকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা কি মাঠে নামতে চাইছিলেন না?’ সাকিব তখন পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আমাদের কি এমন অপশন ছিল?’
সাংবাদিক আবারো প্রশ্ন করেন, ‘না সেটা না, মানলাম। কিন্তু আপনি কি তাদের কিছু মানানোর চেষ্টা করছিলেন?’ সাকিবের পাল্টা প্রশ্ন, ‘কাকে মানাবো?
সাংবাদিক বলেন, ‘আম্পায়ারদের?’ সাকিব এবারে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘আম্পায়ারদের মানানো কি আমার সামর্থ্যের মধ্যে আছে?’
এবারে সাংবাদিক মজা করে প্রশ্ন করেন, ‘তবে কি আপনারা বাংলাদেশের নদী নিয়ে আলোচনা করছিলেন?‘ সাকিব এই প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে হাসেন।
সাংবাদিক আবারো প্রশ্ন করেন, ‘তবে কী নিয়ে আপনারা এতো আলোচনা করছিলেন?’ সাকিবের উত্তর ছিল এমন : ‘এবার আপনি সঠিক প্রশ্ন করেছেন। আম্পায়াররা আমাদের ডেকেছিলেন- আমাকে আর রোহিতকে। আমাদের টার্গেট ও বোলাররা কত ওভার বল করতে পারবে, সেটা জানিয়েছেন।’
সাংবাদিক আবারও জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি সেটা মেনে নিয়েছেন?’ সাকিব বলেন, ‘হ্যাঁ।’
ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ মানেই বিতর্ক এবং খেলার পর সাকিব আল হাসান বিতর্ক এড়িয়েছেন।
তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ক্রিকেট অপারেশন্সের চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস জানালেন যে, ‘যথাযথ ফোরাম’ পেলে ফেক থ্রোর বিষয়টি তারা উত্থাপন করতে চান। ‘যা হয়েছে তা তো আপনারা টিভিতেই দেখেছেন,’ সাংবাদিকদের বলেছেন তিনি। ‘আম্পায়ারদের সাথে এটা নিয়ে কথা বলেছে সাকিব। কিন্তু আম্পায়াররা বলেছেন তারা খেয়াল করেনি। সাকিব মাঠ আরেকটু শুকানোর কথাও বলেছেন। কিন্তু মাঠে আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’
সূত্র : বিবিসি