ঋণখেলাপি হওয়ার পর থেকে এক টাকাও পরিশোধ করেননি প্রায় চার হাজার ৬০০ ঋণখেলাপি ও তাদের প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যাংকগুলো পাওনা রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকগুলো অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। এতে ব্যাংকের নগদ আদায়ের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
জানা গেছে, ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান, তাদের খেলাপি ঋণ ও আদায়ের পরস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য চাওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আট হাজার ২৪০টি ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চার হাজার ৫৬৮টি প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হওয়ার পর থেকে এক টাকাও পরিশোধ করেননি। শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের কাছেই আটকা রয়েছে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রিমেক্স ফুটওয়্যারের কাছে এক হাজার ৭০৮ কোটি টাকা, বহুল আলোচিত ক্রিসেন্ট লেদারের কাছে প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা, রূপালী কম্পোজিট লেদারের কাছে এক হাজার ২৩৯ কোটি টাকা, লেক্সো লিমিটেডের কাছে ৫১৪ কোটি টাকা, বেল কনস্ট্রাকশনের কাছে প্রায় ৪৭০ কোটি টাকা, জ্যাকওয়্যার্ড নিটওয়্যার লিমিটেডের কাছে ৪৪১ কোটি টাকা, শাহরিশ কম্পোজিট টাওয়ালের কাছে ৩১৪ কোটি টাকা, এসকে স্টিলের কাছে ২৭১ কোটি টাকা, হেল্পলাইন রিসোর্স লিমিটেডের কাছে ২৫৮ কোটি টাকা, নূরানী ডাইং অ্যান্ড সুয়েটারের কাছে ২৫০ কোটি টাকা আটকা রয়েছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব ঋণ মন্দমানের খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু মামলাও নিষ্পত্তি হচ্ছে না, তাদের কাছ থেকে অর্থও আদায় হচ্ছে না। এভাবেই ব্যাংকগুলোর নগদ টাকা আদায়ের ওপর প্রভাব পড়েছে। অর্থ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে চলছে। এতে ঋণের সুদ হারের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার এক অঙ্কের ঘরে নামাতে পারছে না।
এ দিকে ব্যাংকগুলোর আমানতও কমে গেছে। আমানত কমে যাওয়ার পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকগুলো পড়েছে মহাবিপাকে। এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ার তালিকার মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোতেই বেশি। কারণ বেশির ভাগ সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দেয়া হয় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বিবেচনা করা হয় না। এর ফলে ঋণ নেয়ার পর সঠিক ব্যবহার না হওয়ায় ওই ঋণ আর পরিশোধ হয় না। এভাবেই বছরের পর বছর আটকে পড়ে এসব ঋণ। ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকগুলোও পড়েছে মহাবিপাকে।
ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকাই আটকে পড়েছে ১০০টি প্রতিষ্ঠানের কাছে, সর্বোচ্চ এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা থেকে ৭০০ কোটি টাকা রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে। এর মধ্যে ৫০টি প্রতিষ্ঠানের কাছেই পাওনা ১৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় রয়েছে এমন ১০ প্রতিষ্ঠানের পাঁচটিই রয়েছে জনতা ব্যাংকের। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে বড় অঙ্কের ঋণ আটকে পড়ায় জনতা ব্যাংকের পরিস্থিতি দিন দিন অবনতিতে চলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির শীর্ষপর্যায়ের এক কর্মকর্তা। অথচ এসব ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে কারা জড়িত, কারা এসব ঋণের জন্য সুপারিশ করেছিলেন এসব তথ্য বের হলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বে। তিনি জানান, এখন ঘুরে ফিরে ওই চক্রটিই ঋণের সুদ মওকুফ, নিয়মবহির্ভূত ঋণ নবায়ন, ঋণ অনুমোদন ইত্যাদি অনিয়ম করে আসছে। কিন্তু এসব চক্র প্রতিহত করতে সে দিকে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। তিনি জানান, এর ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের মতো আরো প্রতিষ্ঠানেই ঋণ দেয়ার চাপ কমছে না। প্রকৃত হোতাদের শনাক্ত করা হলে ব্যাংকগুলোর ভঙ্গুর অবস্থা অনেকাংশেই কেটে যেত।