বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪০ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
ইসকন ইস্যুতে দেশি-বিদেশি ইন্ধন থাকতে পারে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যা, যে নির্দেশ দিলেন প্রধান উপদেষ্টা স্বৈরাচার পালিয়ে গেলেও তাদের লেজ রেখে গেছে : তারেক রহমান আইনজীবীকে ‘কুপিয়ে হত্যা করল’ ইসকন সদস্যরা অনির্দিষ্টকালের জন্য সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল বন্ধ ঘোষণা অহিংস গণঅভ্যুত্থানের আহ্বায়কসহ ১৮ জনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন রাষ্ট্রদ্রোহের ঘটনায় যুক্ত থাকলে ছাড় দেয়া হবে না : আসিফ মাহমুদ চিন্ময়কে গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়ে ভারতের বিবৃতি মানুষ কেন তাদের ওপর বিক্ষুব্ধ, গণমাধ্যমের তা স্পষ্ট করা উচিত : নাহিদ ইসলাম

শিক্ষার উদ্দেশ্য যেন মহৎ হয়

মুহাম্মদ মিজানুর রহমান
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২২
  • ৭২ বার

শিক্ষা হলো প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন ও আদর্শ মানবগঠনের একটি সঠিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় শামিল হতে হলে প্রত্যেককেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। হোক সেটি পদ্ধতিগত বা ব্যক্তিনির্ভর উপায়ে। শিক্ষা বলতে শুধু পুঁথিগত বিদ্যাকে বোঝানো হয় না। ব্যাপক অর্থে এটি, জীবনঘনিষ্ঠ বিভিন্ন বিষয় ও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের সমাহারকে বুঝিয়ে থাকে। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ আপন মর্যাদাকে বুঝতে শেখে। তার ভেতরকার সুপ্ত চেতনাবোধ জাগিয়ে তোলে এটা।

শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সব থেকে বেশি কার্যকর। এখানে একজন শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত গুণাবলি পূর্ণ বিকাশের সুযোগ পায়, অন্য কোথাও এত সহজে এটি সম্ভব নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন শিক্ষার্থীদের নতুন নতুন প্রেরণার সঞ্চার করে, অপরদিকে এটি প্রয়োগ করার সুযোগও তৈরি করে দেয়। ফলে সে দৃঢ়তার সাথে বেড়ে উঠতে পারছে। একজন শিক্ষার্থীর প্রদর্শিত সমূহ অ্যাক্টিভিটিজের মধ্য দিয়ে বিদ্যালয় তাকে মনিটরিং করছে, কাজে কোনো ধরনের ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে তারও একটি সঠিক সমাধান পেয়ে যাচ্ছে যা তার যোগ্য ও দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে বেড়ে ওঠার জন্য অত্যন্ত সহায়ক।

শিক্ষার লক্ষ্য যদি এভাবে নির্ধারণ করা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়, এটি শিক্ষার্থীর জন্য প্রত্যাশিত ফল বয়ে আনবে। প্রশ্ন হলো- ক’জন এ ধরনের দায়িত্বশীল চিন্তা নিয়ে কাজ করতে আসে? জাতির বৃহত্তর কল্যাণের কথা যদি আপনি চিন্তা করেন, নিজের মনুষ্যত্বের জায়গা থেকে যদি নিজেকে প্রশ্ন রাখেন, কম করে হলেও নতুন প্রজন্মের জন্য এইটুকু অবদান আপনাকে রাখতে হবে। জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, অনেকেই মানুষ হয়েও দায়িত্ব পালন করতে আসে না, আসে চাকরির মেয়াদ শেষ করতে। দায়িত্ব নিয়ে যদি আপনি মনে করেন, বড় একটি পদবি অর্জন করা আপনার লক্ষ্য ছিল, লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। এখন কোনোমতে সময়টা পার করতে পারলেই চলে। তাহলে বলব, আপনি ভুল করছেন।

এমন চিন্তা নিয়ে স্বার্থপর হওয়া যায়, কিন্তু মানুষের কল্যাণ করা যায় না। আর এটি যদি হয় কোনো শিক্ষকের ধারণা তাহলে আপনি অনেক বড় ভুলের মধ্যে আটকে পড়েছেন। নিজেকে এখান থেকে বের করে নিয়ে আসুন। যে শিক্ষা মানুষকে মানুষ বানিয়ে দিতে পারে না, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য শেখাতে পারে না, সে শিক্ষা তো আপনাকেই মানুষ করতে পারেনি। তার দেয়া শিক্ষা জাতির কী কল্যাণে আসতে পারে (?) হয়তো আমার এই কথা শুনে আপনি নিজেকে আমার প্রতিপক্ষ ভাবছেন, শত্রু বানিয়ে নিচ্ছেন। আপনি আমাকে আপনার বন্ধু বানাবেন নাকি শত্রু বানাবেন, সেটি নিজের বিবেককে প্রশ্ন করলেই উত্তর পেয়ে যাবেন।

এখন মানুষ মানুষকে মূল্যায়ন করতে শিখছে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়ে। মানুষ যখন জ্ঞান শূন্যের পথে এগিয়ে যায়, তার মূল্যায়নের মাপকাঠি তো সে ধরনেরই হবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তবুও আপনাকে মানুষের জন্য আশা জাগিয়ে রাখতে হবে। যার কাছে শক্তি রয়েছে সে অন্যায়কে ন্যায় বানিয়ে নিতে চাইছে। কখনো সে এ কাজে সফলও হচ্ছে। সত্য কথাটি আপনার সামনে পরিষ্কার থাকার পরও আপনি সত্য বলতে পারছেন না। কারণ আপনি দুর্বল। মজলুমকে চিনে নেয়ার পরও জালিমের সামনে চুপ করে থাকতে হচ্ছে, কারণ জালিমের ঐক্য থাকলেও সত্যনিষ্ঠ মানুষগুলো একতার প্ল্যাটফর্মে আসতে পারছে না। একজন বিবেকবান মানুষের জন্য এটি কত বেদনার তা কোনো বিবেকহীন মানুষ বুঝবে না।

জ্ঞানীর সাথে মূর্খের দ্বন্দ্ব সৃষ্টির আদিকাল থেকেই। যে মানুষ অন্যকে বিপদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সত্যের আহ্বান করে, সেই মানুষকে তারাই শত্রু বানিয়ে তার সামনে মৃত্যুর পয়গাম নিয়ে হাজির হয়। তবুও ন্যায়ের আহ্বান থেকে দূরে সরে থাকা যায় না। আপনি এমন এক সময় বসবাস করছেন, আপনার চারপাশে যখন চলছে হাজারো অন্যায়, আপনি নীরবে বসে থাকতে পারেন না। যদি ন্যায়ের দাবি এমনই হতো, তাহলে মানুষ নিজের জীবন বিপন্ন করে সমাজ পরিবর্তনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখত না। অন্যের কথা না ভেবে নিজের দায়িত্বের দিকে তাকান। হয়তো অন্যরা আপনাকে দেখে নিজের দায়িত্বের জায়গায় ফিরে যাবে।

শিক্ষিত হতে চাইলে সবাইকে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে, এটি শর্ত নয়। তবে বয়সভেদে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে জ্ঞানের সাথে সখ্য না থাকলে বা জ্ঞানার্জনের লক্ষ্য পূরণ না করলে কেউ জ্ঞানী হতে পারে না। এমন একজন জ্ঞানীকেও আপনি খুঁজে পাবেন না, যার সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক নেই। তবে এমন অনেক জ্ঞানী পাবেন, যারা কোনো দিন বা কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গমন করেননি। অথচ তারা আপন জ্ঞান, যুক্তিবাদী চেতনা ও মননশীলতায় মানুষের মধ্যে সমাদৃত হয়ে আছেন। এ কারণে স্বশিক্ষাকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।

শিক্ষিত হলে মানুষের ভেতরে উত্তম চেতনাবোধ জাগ্রত হবে, এটিই জ্ঞানের ধর্ম। কারণ শিক্ষার ধর্মই হলো, মানুষকে আলোকিত করা। সুন্দর সমাজ গঠনে অবদান রাখা। কিন্তু যখন আমরা এর বিপরীত বিষয় লক্ষ করি, তখন আমরা অভিভূত হয়ে যাই। এমন অনেক ব্যক্তি আছেন, যারা আদৌ কোনো অ্যাকাডেমিক শিক্ষার ধারেকাছেও যাননি, অথচ তাদের সততা, কর্মদক্ষতা, মেধা ও মননশীলতা দেখে কোনোভাবেই তাকে অশিক্ষিত বলতে পারি না।

শিক্ষা জীবননির্ভর না হলে তা কখনোই প্রত্যাশিত ফল বয়ে আনতে পারে না। আজ হরহামেশাই এ ধরনের প্রশ্ন চারদিকে ঘুরপাক খায়, বড় বড় কেতাবি ডিগ্রি নিয়ে মানুষ যা করছে, তা মানবতার সাথে কোনোভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল- আপনার মধ্যে এ ধরনের যত হীনম্মন্যতা থাকবে তা দূর করে আপনাকে একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে উপহার দেবে। নিজের চোখে আপনি বড় না হলেও সমাজের চোখে আপনি শ্রদ্ধার পাত্র বিবেচিত হবেন। আপনি অন্য আর দশটি মানুষের মতো নিজের ভালোর জন্য যাচ্ছেতাই করতে পারেন না। আপনার শিক্ষা, আপনার আদর্শ, মানুষের জন্য সেবাদানকারী হিসেবে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করবে।

যে আপনি বইপত্রে আদর্শের সবক নিলেন, সমাজকে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জীবনের পাঠ শুরু করলেন, সেই আপনিই অন্যের থেকে নিজেকে এগিয়ে রাখার জন্য অন্যায়ের রাস্তা ধরে একের পর এক বিচরণ করে চলেছেন। আপনার সামনে অন্যায় হচ্ছে, অথচ ন্যূনতম প্রতিবাদটুকু করছেন না। একবার বিবেকের কাঠ গড়ায় নিজেকে দাঁড় করান।

আপনি যদি একজন বাবা হয়ে থাকেন অথবা মা, এসব না হয়েও যদি আপনি একজন অভিভাবক বা শিক্ষকই হয়ে থাকেন, আপনার থেকে আগামী দিনে এ জাতি কী আশা করতে পারে? কারণ আপনি যা বলবেন, তার বেশির ভাগই মিথ্যা। আপনি যা করেন না, তা আপনি অন্যকে শিক্ষা দিতে যাবেন? আপনার শিক্ষা কখনোই ফলপ্রসূ হবে না। আপনার কথাগুলো তারা গুরুত্বহীন ভেবে উড়িয়ে দেবে। কারণ তারা বাস্তব জীবনে আপনার উপদেশের থেকে আপনাকে একজন ভিন্ন মানুষরূপে দেখতে পাচ্ছে। কখনোই নিজেকে উপহাসের পাত্র বানাবেন না। নিজেকে সেভাবে প্রেজেন্ট করার চেষ্টা করুন, যা একজন চরিত্রবান আদর্শ মানুষের বৈশিষ্ট্য। তাহলে অন্যরা আপনাকে দেখে অনুপ্রাণিত হবে।

শিক্ষার বিনিময় যদি আনন্দদায়ক না হয়, সেটি কখনোই টেকসই হয় না। এ কারণে যিনি শিক্ষা দেবেন, তাকে শিক্ষার্থীর ধারণক্ষমতা যাচাই করে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। তার সঠিক শিক্ষা গ্রহণের অন্তরায়গুলো শনাক্ত করে এর বাধাগুলো দূর করা শিক্ষকের কাজ। আর যিনি শিক্ষা নেবেন, তাকেও নিজের সমস্যা বুঝতে হবে। এর সমাধানকল্পে শিক্ষকের নসিহতকে আমলে নিয়ে কাজ করতে হবে। কম মেধা নিয়েও আপনি অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবেন, যদি আপনার মধ্যে জানার আগ্রহ থাকে। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির কারণে আপনি যে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন ক্রমেই তা আপনার অবোধগম্যতা দূর করে সব কিছুকে আপনার জন্য সহজ করে দেবে। এ কারণে আপনি কিছু না বুঝলে নিজেকে এমনভাবে জাহির করবেন না, যেন আপনি সব কিছু বুঝতে পেরেছেন; বরং আপনি না বোঝার জায়গাটিকে নির্বাচন করে সেই দুর্বোধ্যতা কোনো ওস্তাদ বা শায়েখের কাছে গিয়ে দূর করে ফেলুন। না বুঝে মুখস্থ করার মাধ্যমে আপনি কিন্তু নিজেকে অনেক বড় বিপদের মধ্যে ঠেলে দেবেন। এক সময় এই কাজটির প্রতি আপনার আর কোনো আগ্রহ থাকবে না।

আপনি সবসময় শিক্ষকের কাছে প্রিয় হওয়ার চেষ্টা করুন। শিক্ষককেও সবসময় চেষ্টা করতে হয় কিছু ভালো অনুরাগী তৈরি করার জন্য। কারণ শিক্ষকের রেখে যাওয়া শিক্ষা বেঁচে থাকে শিক্ষার্থীর মধ্যে। তারা যতই আপনাকে অনেস্টলি গ্রহণ করবে, আপনার গ্রহণযোগ্যতা ততই বাড়বে। শিক্ষকের অনুপ্রেরণা একজন শিক্ষার্থীর জন্য এতটা ফলপ্রসূ যে, শিক্ষাজীবন থেকে পালিয়ে বাঁচা একজন শিক্ষার্থী পুনরায় শিক্ষাজীবনে ফিরে আসতে একটুও কসুর করে না। এক সময় যে শিক্ষার্থীকে নিয়ে খুব একটা আশা পোষণ করা যেত না, সে-ও একদিন এমনভাবে ঘুরে দাঁড়ায় যে, অন্যদের জন্য সে উদাহরণ হয়ে যায়। শিক্ষকদের ভালোবাসা, তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা আপনার কঠিন থেকে কঠিনতর চলার পথকেও সহজ করে দিতে পারে। এ কারণে নিজের জন্য কে উপযুক্ত, তাকেই আপনার নির্বাচন করতে হবে। আপনি শিক্ষক বা অভিভাবক যা-ই হোন না কেন, পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে হবে। শিক্ষক বলে আপনি একেকজনের সাথে একেক ধরনের ব্যবহার করতে পারেন না। ন্যূনতম একটি ক্রাইটেরিয়া আপনাকে অনুসরণ করতে হবে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে কিছু ব্যতিক্রম সব সময়ই থাকে ও থাকবে। সেটি কখনো উদাহরণ হয় না।

হতে পারে, আপনার সন্তানের শিক্ষক পদমর্যাদায় আপনার চেয়ে অনেক নিচে, আপনি তার সাথে আচরণের মাধ্যমে এটি কখনো প্রকাশ করবেন না। আপনার যদি আত্মসম্মানে এতটা আঘাত লাগে যে, তাকে শিক্ষক বা স্যার বলে আপনি সম্বোধন করতে পারছেন না, তাহলে কমপক্ষে তাকে মানুষ হিসেবে কল্পনা করে উত্তম ব্যবহারটি করুন। যদি এই ইগো আপনার ভেতর কাজ করে, বুঝতে হবে এখনো আপনি মানুষের কাতারে শামিল হতে পারেননি। ন্যূনতম মানুষ হওয়ার চেষ্টা করুন। কারণ আপনার এই বিরূপ প্রক্রিয়ার একটি প্রভাব আপনার সন্তানের ওপর পড়বে। এটি তার বিকাশে কিছুটা হলেও বাধা সৃষ্টি করবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com