নিউইয়র্ক তথা উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশী কমিউনিটির সুপরিচিত সাংবাদিক লাবলু আনসার। কয়েক বছর আগে আকস্মিকভাবে নিজেকে ‘মুক্তিযোদ্ধা দাবী’ আর দীর্ঘ ২২ বছর কর্মরত সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকার মালিক সম্পর্কে অতি সম্প্রতি তার ‘বির্তকিত বক্তব্য’ নিয়ে কমিউনিটিতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। তার দাবী তিনি মুক্তযোদ্ধা এবং জামালপুরে যুদ্ধ করেছেন এবং সাপ্তাহিক ঠিকানার মালিক রাজাকার। তার দাবী তিনি নিউইয়র্কে মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতি। বিভক্ত আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাব নিউইয়র্ক-এর সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি ঢাকার বসুন্ধরা গ্রুপের অন্যতম প্রিন্ট মিডিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর উত্তর আমেরিকা সংস্করনের (সাপ্তাহিক) নির্বাহী সম্পাদক। তার সাবেক কর্মস্থল সাপ্তাহিক ঠিকানা। সেখানে তিনি টানা ২২টি বছর বিভিন্ন পদে থেকে কাজ করেছেন। রিপোর্টার থেকে শুরু করে সম্পাদকের দায়িত্ব পর্যন্ত পালন করেছেন।
সাংবাদিক লাবলু আনসার সম্প্রতি পবিত্র ওমরাহ হজ্ব পালন শেষে বাংলাদেশ সফরে যান। দেশে নিজ জেলা জামালপুরে স্থানীয় প্রেসক্লাবের দেয়া এক সংবর্ধনায় সাপ্তাহিক ঠিকানা-কে ‘রাজাকারদের পত্রিকা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার এই বক্তব্যের ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।
ইতিপূর্বে কমিউনিটির অনেকেই সাংবাদিক লাবলু আনসারের দাবী ‘তিনি মুক্তিযোদ্ধা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ যুক্তরাষ্ট্র কমান্ডের অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা তার দাবীকে ‘ভুয়া হিসেবে’ পাল্টা দাবী করেছেন। সর্বশেষ অতি সম্প্রতি কমিউনিটি অ্যাক্টিভিষ্ট, উদীচী যুক্তরাষ্ট্রের সভাপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত বিশ্বাস সাংবাদিক লাবলু আনসারের মুক্তিযোদ্ধার দাবী প্রসঙ্গে তার ফেসবুক পেজে একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যা নিয়েও কমিউনিটিতে ঝড় উঠেছে।
উল্লেখ্য, সাংবাদিক লাবলু আনসার যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাস জীবনের আগে বাংলাদেশে নিজ জেলা জামালপুরের দৈনিক বাংলা (অধুনালুপ্ত) ও বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)-এর জেলা সংবাদদাতা ছিলেন। তৎকালীন সময়ে বিএনপি’র মহাসচিব ব্যারিষ্টার আব্দুস সালাম তালুকদারের (মরহুম) সাথে তার (লাবলু আনসার) বিরোধ হয় এবং তিনি প্রবাসে চলে আসেন বলে কমিউনিটিতে জনশ্রুতি রয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত বিশ্বাস গত ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ প্রকাশিত নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক আজকাল-এ ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দৌরাত্ব্যে অতিষ্ঠ কমিউনিটি’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। এর আগে ২২ ডিসেম্বর ২০২২ তার ফেসবুক পেইজে ‘৯ বছর বয়সে সাংবাদিক লাবলু আনসার মুক্তিযোদ্ধা ও নিউইয়র্কের দু’নম্বারী মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশ করেন। যা নিয়ে কমিউনিটিতে তোলপাড় শুরু হয়। তবে সাংবাদিক লাবলু আনসার তার বিরুদ্ধে উঠা ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’র অভিযোগ বিষয়ে কোন বক্তব্য বা প্রতিবাদ দেননি।
এদিকে সাপ্তাহিক ঠিকানা ও ঠিকানা’র মালিক সম্পর্কে সাংবাদিক লাবলু আনসারের বক্তব্যও প্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ঠিকানা গ্রæপের চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সাবেক এমপি এম এম শাহিন। লাবলু আনসারের বক্তব্য ও এম এম শাহিনের প্রতিক্রিয়া এখন নিউইয়র্ক সিটিতে টক অব দ্য কমিউনিটিতে পরিনত হয়েছে। হককথা’র পাঠকদের জন্য ভাইরাল ভিডিও এবং এম এম শাহিনের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো।
লাবলু আনসারের বক্তব্য-
জামালপুর প্রেসক্লাবে সাংবাদিক লাবলু আনসারের মাত্র ৫৫ সেকেন্ড বক্তব্যর ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। এতে লাবলু আনসার বলেন- ‘ঠিকানা পত্রিকায় কাজ করেছি, সেটা হলো রাজাকারের পত্রিকা। কিন্তু আমি যখন আমার কথা বলছি তখন আমি আমার কথাই বলছি, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছি। কিন্তু সাংবাদিকতার প্রয়োজনে, জীবিকার প্রয়োজনে সেটা আমি তখন ঐভাবে করছি কিন্তু কখনোই এই ২২ বছরে ঐখানে চাকরি করা অবস্থায় কখনোই আমার নিজের নামে কোন আর্টিকেল ওখানে ছাপিনি। এটার জন্য ঐ মালিক পক্ষ বহুবার বলেছেন যে আপনি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ হচ্ছে একটা লেখা দেন। আমি বলেছি আমার নামে লেখার মতো কিছু নেই। সুতরাং অটুট রাখার চেষ্টা করছি এবং ফাইনালি আমি কাজ করছি। এখন আমি আমার। দুই হাত খুইলা লিখছি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রবাসে কি হচ্ছে, কি করা দরকার, ষড়যন্ত্র চলছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, এভরি আমি এখন সরাসরি লিখি।’
এম এম শাহিনের প্রতিক্রিয়া
এম এম শাহিন নিজস্ব ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন “সাংবাদিক লাবলু আনসার : যেই থালায় খায় সেই থালা ফুটো করা যার স্বভাব। জামালপুর প্রেসক্লাবের এক অনুষ্ঠানে গত ৫ জানুয়ারী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক লাবলু আনসার, যিনি নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বহির্বিশ্বের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা সংবাদপত্র ঠিকানায় দীর্ঘ ২২ বছর কর্মরত ছিলেন। ঠিকানা ছেড়ে বর্তমানে তিনি কর্মরত আছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের আমেরিকা সংস্করণে। ওই অনুষ্ঠানে জামালপুরের স্থানীয় সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে লাবলু আনসার ঠিকানা সম্পর্কে এমন এক আপত্তিকর কথা বলেন, যা চরম মানহানিকর, অসত্য, ধৃষ্ঠতাপূর্ণ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা (!) দাবি করে তিনি বলেন, ঠিকানা রাজাকারদের পত্রিকা। বাঁচার তাগিদে ওই পত্রিকায় দীর্ঘ ২২ বছর চাকরি করলেও কোনো দিন তার স্বনামে কোনো সংবাদ বা লেখা তাতে ছাপা হয়নি।
লাবলু আনসারের ওই ঢাহা মিথ্যা কথাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে তার সম্পর্কে শুধু একটি শব্দই প্রযোজ্য, অকৃতজ্ঞ।
২২ বছর যে থালায় খেল, তাকে মুহূর্তের মধ্যে ফুটো করে দেওয়া একমাত্র লাবলুর মতো অকৃতজ্ঞদের পক্ষেই সম্ভব। আর তার স্বনামে ঠিকানার পাতায় অসংখ্য লেখা ছাপা হয়েছে, যা ঠিকানা কর্তৃপক্ষের হাতে সংরক্ষিত আছে। মুখে মিথ্যার ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে মানুষকে সাময়িক বিভ্রান্ত করা যায়, কিন্তু ছাপার অক্ষরকে তো আর অস্বীকার যায় না। লাবলু আনসারের নামে ঠিকানায় প্রকাশিত একেকটি লেখা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে তিনি কত বড় মিথ্যাবাদী ও বেইমান।
আজ থেকে তিন দশক আগে সাংবাদিকতার এবিসি শিখে নিউইয়র্কে পাড়ি জমিয়ে যখন এক বেলা পেটের ভাতের জন্য রাস্তায় রা¯স্তয় ঘুরে বেড়াচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে লাবলু আনসারের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল ঠিকানা। ঠিকানা তাকে দিয়েছিল অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান। ঠিকানাই তাকে হাতেকলমে সাংবাদিকতার পাঠ দিয়েছিল। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিচর্যার মাধ্যমে অচেনা-অখ্যাত এক লাবলুকে ঠিকানাই পরিচিত করে তুলেছিল প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে। ঠিকানাই তাকে দিয়েছিল একের পর এক পরিচিতি। সাধারণ একজন রিপোর্টার থেকে শুরু করে সিনিয়র রিপোর্টার, বার্তা সম্পাদক এবং সর্বশেষ সম্পাদকের মতো আসনে ঠিকানাই তাকে বসিয়েছিল। কিন্তু এত সুখ-সম্মান-সমৃদ্ধি লাবলুর মতো অকৃতজ্ঞ, লোভী, অহংকারী, নির্লজ্জ, অপদার্থ বহন করতে ব্যর্থ হলো। দিনকে দিন তার চাওয়া-পাওয়ার উদগ্র বাসনা তাকে মানুষরূপী পিচাশে পরিণত করল। অতি লোভী লাভলু ঠিকানার মতো পত্রিকার সম্পাদক পদ ছেড়ে তিনি যোগ দিলো বাংলাদেশ প্রতিদিনের নিউইয়র্ক সংস্করণের নির্বাহী সম্পাদক পদে। একটি পত্রিকার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সম্পাদক। পত্রিকার সকল সফলতা-ব্যর্থতা সম্পাদকের ওপরই বর্তায়। ঠিকানা যদি রাজাকারদের পত্রিকাই হয়, তাহলে লাবলু আনসার ঠিকানার সম্পাদকের মতো সর্বোচ্চ পদে আসীন থেকে নিজেকে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করতে পারেন? একজন মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে কি ২২ বছর ধরে কোনো রাজাকারের পত্রিকায় কাজ করা সম্ভব? আসলে প্রতিহিংসাপরায়ণ লাবলু ঠিকানার সঙ্গে পেরে উঠতে না পারায় এখন আবোলতাবোল বকছেন। তিনি এমন এক ব্যক্তি, স্বার্থ ফুরোলে যিনি বাবাকেও ভুলে যান। সিলেটি একটি প্রবাদ আছে “কার হগদায় খাওগো বান্দি ঠাকুর চিনো না”
বাংলার বিখ্যাত রাজনীতিবিদ শেরেবাংলা একে ফজলুল হক বলেছিলেন, একেবারে নিঃস্ব কাউকে সাহায্য করলে সঙ্গে তার হাতে একটি লাঠিও দিয়ে দিয়ো। কারণ বড় হয়ে একদিন ওই ব্যক্তি উপকারীর পিঠেই প্রথম লাঠির আঘাতটা করবে। লাবলু আনসারের ক্ষেত্রে শেরেবাংলার এই উক্তি একেবারেই যথার্থ। ঠিকানা ছেড়ে দিয়ে লাবলু শুরুতেই নেমে পড়লেন ঠিকানার বিষোদ্গারে। কিন্তু প্রবাসীদের প্রিয় মুখপত্র ঠিকানাকে হার মানাতে গিয়ে তিনি নিজেই কাহিল হয়ে পড়লেন। ঠিকানার সঙ্গে কোনোভাবেই না পেরে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নিলেন মিথ্যার। বললেন, ঠিকানা রাজাকারের পত্রিকা।
অথচ একুশের চেতনা বুকে ধারণ করে আজ থেকে প্রায় ৩৪ বছর আগে ঠিকানার জন্ম। দলমত-নির্বিশেষে প্রবাসীমাত্রই জানেন, ঠিকানা কারো তাঁবেদারি করে না। ঠিকানা কোনো ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ের লিফলেট নয়। ঠিকানা কথা বলে প্রবাসীদের পক্ষে, বাংলা ভাষার পক্ষে, বাংলাদেশের পক্ষে। আর যে পরিবারের হাতে ঠিকানা প্রতিষ্ঠিত, সেই পরিবারটি একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের হাতে প্রতিষ্ঠিত একটি পত্রিকার গায়ে রাজাকারের তকমা এঁটে দেওয়া লাবলু আনসারের মতো অর্বাচীন, বিবেকবর্জিত, নীতিভ্রষ্ট ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ঠিকানা নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে, এখনো হচ্ছে। লাবলু আনসারদের মতো গুটি কয়েক কুচক্রীর হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা বরাবরই সইতে হচ্ছে। কিন্তু সূর্যকে যেমন মেঘ ঢেকে রাখতে পারে না, ঠিকানার এগিয়ে চলাও তেমনি কোনো চোখরাঙানি, চক্রান্ত ও হীনম্মন্যতা রুদ্ধ করতে পারেনি। একুশের জাতক ঠিকানা সব সংকট সততা, ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। আমার বিশ্বাস, অকৃতজ্ঞ লাবলু আনসাররা একদিন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবেই আর পাঠক, পৃষ্ঠপোষক, লেখক, শুভাকাঙ্খীদের ভালোবাসা ও সমর্থনে ঠিকানা তার শীর্ষ অবস্থান অটুট রেখে এগিয়ে যাবে যুগ-যুগান্তর।”
এদিকে এই রিপোর্ট লেখার সময় সাংবাদিক লাবলু আনসার বাংলাদেশে থাকায় তার সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। ফলে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তিনি নিউইয়র্কে ফেরার পর তার বক্তব্য নিয়ে তা হককথা’য় প্রকাশ করা হবে।
সূত্র : ইউএনএ