শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৬ অপরাহ্ন

ডোনাল্ড লু’র সফরে সম্পর্কের নতুন বার্তা

কামাল উদ্দিন মজুমদার
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০২৩
  • ১১২ বার

ভূরাজনৈতিক গতিশীলতার দ্রুত পরিবর্তনের মধ্যে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ১৪ জানুয়ারি দুই দিনের জন্য বাংলাদেশ সফর করেন। পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় তাকে নিয়ে নেতিবাচক ভাবমর্যাদা তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশেও একই ‘জবরদস্তিমূলক’ কূটনৈতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করবেন বলে গণমাধ্যমে জল্পনা ছিল। তবে সফরের বিভিন্ন দিক বিবেচনায় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কূটনৈতিক মহলে এটি অত্যন্ত সফল সফর হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এটি দুই দেশের ঐতিহ্যগত বন্ধন দৃঢ় করার পাশাপাশি সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে একে অপরকে বোঝার ও উভয়পক্ষের ভুল ধারণাগুলো দূর করার একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। ডোনাল্ড লু যখন খোলা মনে বাংলাদেশকে আলিঙ্গন করেন এবং বাংলাদেশে ভবিষ্যতের সব উদ্যোগের জন্য বাইডেন প্রশাসনের পক্ষে অব্যাহত সমর্থন ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন, তখন বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে দেখার অবকাশ আর থাকে না।

মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র ডিরেক্টর রিয়ার এডমিরাল আইলিন লাউবাচার চার দিনের সফরে গত ৭ জানুয়ারি ঢাকায় আসার পর এক সপ্তাহের মধ্যে এটি কোনো মার্কিন কর্মকর্তার দ্বিতীয় হাইপ্রোফাইল সফর। ডোনাল্ড লু এ অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশ সফর করলেও এটিই ছিল তার ঢাকায় প্রথম একক সফর। উল্লেখ্য, ডোনাল্ড লু তিন দশক ধরে মার্কিন প্রশাসনে কাজ করছেন এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এ অঞ্চলে তার গভীর ও অগ্রাধিকারের দীর্ঘ তালিকার ফলস্বরূপ, ডোনাল্ড লু’র সফর বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু প্রভাব রেখেছে। সফরের অংশ হিসেবে লু ১৫ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সাথে পৃথক বৈঠক করেন। বৈঠকে তারা বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক অগ্রাধিকারের দ্বিপক্ষীয় ও রাজনৈতিক ইস্যুগুলোর পুরো ধারা নিয়ে আলোচনা করেন। উভয়পক্ষই ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে বর্তমান সুসম্পর্ক নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে। এই ধারা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের নতুন উপায় অনুসন্ধানের ওপর জোর দিয়েছেন।
বৈঠকে লু বাংলাদেশের সাথে বন্ধুত্ব জোরদার করার জন্য একটি দৃঢ় বার্তা দিয়েছেন এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, শ্রম, মানবিক কৌশলসহ পারস্পরিক স্বার্থের বিস্তৃত দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের ১০ লাখ নাগরিকের মানবিক সহায়তা, প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসনের বিষয়গুলো আলোচনায় উঠে এসেছে।

স্বাধীনতা পর থেকে দেশের ব্যাপক আর্থসামাজিক উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে লু এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গার প্রতি বাংলাদেশের মানবিক সহযোগিতার গভীরভাবে প্রশংসা করেন। তিনি টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যেরও প্রশংসা করেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের যেকোনো সঙ্কটের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সম্মিলিতভাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং এর সাত সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের এক বছরেরও বেশি সময় পর এই সফর হলো। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য বোঝানোর চেষ্টা করছে। সফরকালে ডোনাল্ড লু র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) কর্মকাণ্ডে ‘মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের’ ক্ষেত্রে ‘উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির’ প্রশংসা করেন। লু বলেন, র‌্যাব নিয়ে তাদের ভালো আলোচনা হয়েছে এবং তিনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাম্প্রতিক বিবৃতির উল্লেখ করেন যেটি বিচারবহিভর্‚ত হত্যাকাণ্ড কমে যাওয়ার ঘটনাকে ‘অসাধারণ অগ্রগতি’ বলে স্বীকার করেছেন। লু বলেছেন, এতে বোঝা যায়, র‌্যাব মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই তার সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ প্রচেষ্টা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কার্য সম্পাদন করতে সক্ষম।

ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, উভয় দেশই মতভেদ দূর করে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার পক্ষে।
উভয়পক্ষই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে প্রস্তুত। বাংলাদেশ সরকার এই বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কার করবে।

বাংলাদেশ ২০১৩ সাল থেকে মার্কিন বাজারে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার দাবি করে আসছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ এই সুবিধা পায়নি, যা যুক্তরাষ্ট্র ৪৬টি দেশকে দিয়ে আসছে। এ ছাড়া, বাংলাদেশ ২০১৩ সাল থেকে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে, যা মার্কিন সরকার স্থগিত করেছে। সফররত মার্কিন সহকারী সচিব বলেছেন, তার দেশ জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশের সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। লু নিশ্চিত করেছেন, জিএসপি আবার চালু হলে তালিকায় প্রথম দেশ হবে বাংলাদেশ।
বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বাংলাদেশের তাৎপর্য ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ মনোযোগ উভয় দেশের সহযোগিতার জন্য একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য তার নৌ-সক্ষমতা এবং সুনীল অর্থনীতিতে ফোকাস করার একটি সুযোগ উন্মুক্ত করে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশসহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আরো সম্পদ বরাদ্দ ও আরো মনোযোগ দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। সফরের সময়, উভয়পক্ষই ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে খুব খোলামেলা আলোচনা করে। লু বলেন, ‘এটি শুধু কৌশল; এটি কোনো ক্লাব নয়।’ আপনি না চাইলে যোগ দেবেন না।

মার্কিন এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার, অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ এবং শ্রম ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করেছেন। ডোনাল্ড লু বলেছেন, শ্রম অধিকারের উন্নতির প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে অব্যাহত সহযোগিতার জন্য ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’।

বলাবাহুল্য, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে সহযোগিতা জোরদার করতে পারে। তাই গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তা, নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞরা মাঝে মধ্যেই বাংলাদেশ সফর করেছেন। এসব সফরে বাংলাদেশের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। এটি সহজেই অনুমেয় যে, শুধু বাংলাদেশ নয়, খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টও এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রতি অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের ওপর জোর দিয়ে জো বাইডেন বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য একটি ‘অসাধারণ গল্প’। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু সামনের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তার প্রশাসন দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার করতে বাংলাদেশের সাথে কাজ করার জন্য উন্মুখ।

এটি স্পষ্ট যে, এ ধরনের নিয়মিত শীর্ষ স্তরের সফর সমসাময়িক সম্পর্কের গতিশীলতাকে সুসংহত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে এটিও ঠিক, একটি নির্দিষ্ট ঘটনা বা বিষয়কে কেন্দ্র করে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। প্রতিটি সফরেই উন্নতির জায়গা আছে। উপসংহারে বলা যায়, ডোনাল্ড লু’র বাংলাদেশ সফর নিঃসন্দেহে ইতিবাচক এবং ফলপ্রসূ, গণতন্ত্র, ও মানবাধিকারের ওপর ভিত্তি করে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, ভূরাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, জ্বালানিসহ অনেক বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় ও সহযোগিতার জন্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com