যেখানে যাবতীয় চেষ্টা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের, সেখানে উল্টো তৎপরতা এ দেশে আরও রোহিঙ্গা ঠেলে পাঠানোর। এরই মধ্যে নতুন করে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা ঢোকানো হয়েছে বলে তথ্য মিলেছে অভিযোগ আকারে। গত সপ্তাহে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্ত এলাকার মিয়ানমার অংশে গোলাগুলির ঘটনায় একজন নিহত ও দুজন গুলিবিদ্ধের খবরের আড়ালের খবর এটি। সেদিনের ঘটনায় মূল ফোকাস হয়েছে হতাহতের খবরটি। আর ঘটনার সমান্তরালে যে নতুন করে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে, সেই খবরটি পড়ে গেছে আড়ালে। এ রকম সময়েই কক্সবাজারসহ আশপাশে আরও আশ্রয়শিবির গড়ার চেষ্টা নিষ্ঠুর অপচেষ্টা পর্যন্ত চলছে।
১৮ জানুয়ারি গোলাগুলির সময় ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় থাকা ক্যাম্পে আগুন ধরিয়ে দেওয়ায় সেখানে আশ্রিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের দিকে এসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভোর সাড়ে ৫টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত গোলাগুলিতে বালুখালী ক্যাম্পের হামিদ উল্লাহ নিহত এবং টেকনাফের জাদিমুড়া ক্যাম্পের মুহিব উল্লাহ ও ঘুমধুম শূন্যরেখার শিশু মোহাম্মদ হোসেন আহতের খবর নিশ্চিত করা হলেও ধেয়ে আসা রোহিঙ্গারা কোথাও আশ্রয় নিয়েছে, না ফিরে গেছে তা কিছুটা উহ্যের মতো। তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গা তরুণ মুহিব উল্লাহ নিজেকে দাবি করেছেন আজাদি নেতা হিসেবে। নিজেদের অঞ্চলকে ‘আজাদ’ করতে তারা মিয়ানমার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছেন বলে দাবি তার। চট্টগ্রাম মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন এই রোহিঙ্গা তরুণ একে-৪৭, এম-১৬সহ নানা অস্ত্র চালনায় দক্ষ বলে জানিয়েছে পুলিশকে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে সীমান্তের ওপারে গিয়েছিল বলেও স্বীকারোক্তি দেওয়া মুহিব উল্লাহর সঙ্গী হামিদুল্লাহ নিহত হয়েছে। তারা রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্য।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো নিধন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০-১১ লাখ নির্ধারণ করা হয়েছে এভাবেই। বাস্তব সংখ্যা যে অনেক বেশি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশাল এ শরণার্থী এখন বাংলাদেশের জন্য কেবল বোঝা নয়, আপদের ওপর বিপদের মতো; পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় ‘বিষফোঁড়া’। তার সহকর্মী প্রতিমন্ত্রী কোনো রাখঢাক না রেখে বলে ফেলেছেনÑ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিভিন্ন দেশের কাছে যে সহযোগিতা আশা করা হয়েছিল, বাস্তবে তা মিলছে না। এতে অর্থনৈতিক বোঝার সঙ্গে এখন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তারও সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। বিষ খেয়ে বিষ হজম করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বন্ধু রাষ্ট্রগুলো সহযোগিতার বদলে দিচ্ছে এই বিষয়ক পরামর্শ আর তাগিদ।
বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ায় এক সময় যারা বাংলাদেশের মানবিকতার স্বীকৃতির সঙ্গে কিছু সহায়তা করেছে, তারা এখন সাহস-পরামর্শ দিয়ে কেটে পড়ছে সাইডলাইনে। উপরন্তু অসহযোগিতা, এমনকি ভেতরে ভেতরে চিকন কূটনীতিও করছে। তাও হজম করে চলছে বাংলাদেশ। চলমান বৈশ্বিক স্নায়ুচাপের তাপে তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। রোহিঙ্গারা গত কয়েক বছরের চেয়ে সাম্প্রতিক সময়ে অত্যন্ত বেপরোয়া। তাদের নিয়ে বহু এজেন্ডাও অনেকের। ইন্টারেস্টেড গ্রুপ গজিয়েছে দেশে-বিদেশে। রাজনীতি-কূটনীতিসহ অনেক কিছুর আইটেমে পরিণত করা হয়েছে এই শরণার্থীদের। আশ্রিত, শরণার্থী, অসহায় ইত্যাদি নামে সম্বোধন করা বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে কথাচ্ছলে বলে ফেলেছেন, ‘এদের বিশ্বাস করা যায় না। এরা বড় ভয়ঙ্কর।’ বাস্তবতার নিষ্ঠুরতায় উচ্চারণ হয়ে যাচ্ছে অপ্রিয় সত্য কথাগুলো। এমনিতেই তারা স্বভাব-বৈশিষ্ট্যে বেপরোয়া-আনকোরা, সামান্য কিছুতেই উত্তেজিত করে তাদের দিয়ে যে কোনো কাণ্ড ঘটিয়ে দেওয়া যায়। ‘একে তো নাচুনি বুড়ি, তার উপর ঢোলে বাড়ি’ প্রবাদের মতো তাদের আরও নাচিয়ে তোলার তৎপরতা অনেকটাই দিবালোকের মতো স্পষ্ট। নানা শক্তি ভর করায় প্রকারান্তরে রোহিঙ্গারা এখন কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা উপ-অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটের কারণে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ একটি জটিল পরিস্থিতিতে আছে।
একটা সময় পর্যন্ত মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে নিই-নিচ্ছিতে আমতা আমতা করেছে, এখন বেঁকেই বসেছে। এই পরিস্থিতিতে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা। জাল-জালিয়াতিতে নাগরিকত্বের সনদও নিচ্ছে। সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে বাংলাদেশি প্রবাসী হয়ে। তাদের ফেরত আনা বা তারা বাংলাদেশি নয়, তা প্রমাণের সুযোগ নেই সরকারের হাতে। তবে মাঝে মধ্যে অনেকে ধরা পড়ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথে বা জালিয়াতি করে পাসপোর্ট বানাতে গিয়ে। আবার সমুদ্রপথে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে বহু রোহিঙ্গা। পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে ক্যাম্পে ফেরত এসেছে অনেকে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) হিসাবে শুধু ২০২২ সালেই সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবির থেকে পালিয়ে টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লি সেজে আসার পথে ধরা পড়েছে সাড়ে সাতশর মতো। ধরা পড়েনি বা ইজতেমায় আসতে সক্ষম হয়েছে, তা নিরূপণের অবস্থা নেই। ইজতেমা করে তারা ক্যাম্পে ফেরত গেছে কিনা, কে জানে? ক্যাম্প থেকে পালিয়ে দেশের মূল জনস্রোতে মিশে যাওয়াদের শনাক্ত করা কঠিন। ভাষাগত মিল থাকায় পালানোর পর রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের উত্তম ভূভাগ বৃহত্তর চট্টগ্রাম। আর ক্যাম্পগুলোয় থাকাদের মধ্যে হয়েছে এখন নানা গ্রুপ। সব গ্রুপই শক্তিমান। খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে পাকা সবাই। মাঝে মধ্যেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ করছে ভারী-হালকা-মাঝারি অস্ত্রসজ্জিত হয়ে। তারা একা নয়, এ দেশীয় অনেক সহযোগী ও মদদদাতা গজিয়েছে তাদের। ক্যাম্পের ভেতর-বাইরে ছোট-বড় সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে আসা বেশিরভাগ অস্ত্রই মিয়ানমার থেকে সংগ্রহ করা। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের নবী হোসন বাহিনীর সদস্য দাবি করে কয়েকটি গ্রুপ অপরাধ জগৎ ছেড়ে ভালো পথে আসার কথা জানিয়ে প্রচার করছে।
ভিডিওতে থাকা যুবকদের সবার হাতে অস্ত্র রয়েছে। তারা নবী হোসেন বাহিনীর অপরাধের চিত্র তুলে ধরে মাদক ব্যবসা ও আধিপত্যের জন্য মাঝি খুনের কথাও বলছে। অনেকে আবার ভিডিওতে থাকা লোকজনকে আরসার সদস্য বলে দাবি করেছে। এর মধ্যেই আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি আরসাপ্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনিসহ শীর্ষ ২৮ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পোস্টার লাগানো হয়েছে। পোস্টারে বার্মিজ ভাষায় তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ নিয়ে আরেক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। আরও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার খবর নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র কার্যক্রম ঘুরছে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির ঘিরে। র্যাবের সঙ্গে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের গোলাগুলিও হয়েছে। অস্ত্র-গোলাবারুদসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুজনকে। র্যাবের দাবিÑ ওই দুজনের একজন জঙ্গি সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান রণবীর, আরেকজন বোমাবিশেষজ্ঞ বাশার।
এর আগে বান্দরবানের রুমায় দুর্গম পাহাড়ের খাদে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া ও কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) পরিত্যক্ত গোপন আস্তানা এবং একটি কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার শারক্বীয়ার জঙ্গিদের তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে এসবের সন্ধান মেলে। প্রায় তিন ফুট গভীর কবর খুঁড়ে দুটি গিলাকাপড় পাওয়া গেছে। তবে কোনো লাশ পাওয়া যায়নি। নতুন জঙ্গি সংগঠনের অবস্থান সাধারণ রোহিঙ্গাদের ভাবিয়ে তুলেছে। গত চার মাসে এই সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ২৩ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে আছে ৫ জন আরসা, ১১ জন রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা) ও অন্যরা সাধারণ রোহিঙ্গা। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আরসার প্রধান কমান্ডার আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনিসহ শতাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় পৃথক চারটি মামলা হলেও এখনো মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। গোটা দেশের জন্য এটি বড় রকমের বিপদসংকেত।
এমন সব সংবাদের তোড়ে এখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বা প্রত্যাবাসনচেষ্টার খবর হয়ে যাচ্ছে সম্পূরক খবর। দেশের নিরাপত্তার খাতিরে রোহিঙ্গাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডগুলো এড়িয়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্ন আসে না। এতে বিষের তেজ আরও বাড়বে। আবার মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর অবস্থা নেই। বছরের পর বছর ধরে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পুনর্বাসনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে একজন রোহিঙ্গাকেও দেশটিতে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। তাই বলে প্রত্যাবাসনচেষ্টায় ঘাটতিও কাম্য নয়। সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে প্রয়োজনে খুঁজতে হবে অন্য উপায় ও কৌশল।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক-কলাম লেখক ও বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন