রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০১:১৮ অপরাহ্ন

মা ও দুই সন্তান হত্যা : চিরকুট ঘিরে তদন্ত

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
  • ২৬৭ বার

রাজধানীর দক্ষিণখানে মা ও দুই সন্তান হত্যার তিন দিন অতিবাহিত হলেও এর রহস্য উন্মোচন করতে পারেননি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এ হত্যাকা নিয়ে জট কেবল বাড়ছেই। এখন পর্যন্ত নিখোঁজ গৃহকর্তা রকিব উদ্দিন ভূঁইয়ার কোনো হদিস মেলেনি। ঘটনার পর থেকেই তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ রয়েছে।

এ দিকে চিরকুটে একটি মোবাইল নম্বর নিয়েও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। চিরকুটে এক নারীকে ‘ডাইনি’ উল্লেখ করে তার (রকিব) জীবনে চলমান ঝামেলা ও বিপর্যয়ের জন্য ওই নারীকে দায়ী করে একটি মোবাইল ফোন নম্বর লিখে গেছেন। ওই নম্বরটি একই বাড়ির (যে বাড়িতে তিনি ভাড়া আছেন) বাড়িওয়ালীর নম্বর বলে জানা গেছে। এর আগেও স্বজনদের কাছে বাড়িওয়ালী সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ করেছিলেন রকিব উদ্দিন। সাত-আট বছর আগে তাকে ব্ল্যাকমেইল করে তার সব টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে ওই সময় স্বজনদের জানিয়েছিলেন। যদিও হত্যাকাে র সাথে প্রাথমিকভাবে বাড়িওয়ালীর কোনো সংশ্লিষ্টতা পায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। এর বাইরে চিরকুটের লেখার তথ্য মতে, ঘটনার পর থেকে গত কয়েক দিনে ট্রেনে কাটা পড়ে কেউ মারা যাওয়ারও তথ্য পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তে তিনজনকেই হত্যার কথা বলা হলেও কে বা কারা হত্যা করেছে সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বাসাটিতে সিসিটিভি থাকলেও কোনো ফুটেজ পাওয়া যায়নি।

এ দিকে হত্যাকাে র পর থেকে গৃহকর্তা রকিব উদ্দিনের খোঁজ না মিললেও তাকেই আসামি করে শনিবার রাতে মামলা করেছেন নিহত মুন্নির ভাই মুন্না রহমান। রকিব উদ্দিন নিখোঁজ, অন্য দিকে তার বিরুদ্ধে মামলায় হওয়ায় বিষয়টি ভাবনায় ফেলে দিয়েছে তার সহকর্মী ও স্বজনদের। ঘটনার পর থেকে তারা নিজেরাও রয়েছেন ধোয়াশার মধ্যে। রকিব উদ্দিনই স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করেছেন, না কি অন্য কেউ পূর্বশত্রুতার জেরে বাসায় ঢুকে তিনজনকে হত্যা করে পালিয়ে গেছে সেটিও নিশ্চিত হতে পারছেন না তারা। ভবনের একই ফ্লোরে থাকা ভাড়াটিয়ারাও এমন একটি ঘটনা টের পাননি। যার কারণে নিখোঁজ রকিব উদ্দিনের খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে সন্দেহভাজন ধরেই তদন্ত চলতে থাকবে। পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ, র্যাব ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) একাধিক টিম ছায়া তদন্ত করছে।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর দক্ষিণখান থানাধীন কে সি মডেল স্কুলের পেছনে প্রেমবাগান এলাকায় একটি বাড়ির চারতলায় মুন্নী বেগম (৩৭), তার ছেলে ফারহান উদ্দিন (১২) ও মেয়ে লাইভার (৪) লাশ পাওয়া যায়। মুন্নীকে মাথায় ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করে এবং শিশু দুটিকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। রকিব উদ্দিন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেডের (বিটিসিএল) উপসহকারী প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করতেন। প্রায় ১০ বছর ধরে পরিবার নিয়ে ওই বাসায় ভাড়া থাকেন। সম্প্রতি তিনি বিটিসিএলের গুলশান কার্যালয় থেকে উত্তরা কার্যালয়ে বদলি হয়েছেন। রকিবের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ভাতশালা এলাকায়। তিনি আশরাফ উদ্দিন ভূঁইয়া ও নাজিরা আক্তারের ছেলে।

মামলার বাদি ও নিহত মুন্নি বেগমের ভাই মুন্না রহমান বলেন, ডায়েরির লেখা এবং ময়নাতদন্তে হত্যাকাে একজন জড়িত থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ায় শুধু রকিব উদ্দিনের নামেই মামলা করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এর আগেও তিনি একবার নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। ওই সময় বাড়িওয়ালী সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছিলেন। যদিও তারা সে সময় সেসব কথা বিশ্বাস করেননি। ডায়েরিতে যেভাবে বাড়িওয়ালীকে সব কিছুর জন্য দায়ি করে গেছেন তখনো একইভাবে তাকে দায়ী করেছিলেন। ওই সময় তিনি স্বজনদের বলেছিলেন, সাত-আট বছর আগে বাড়িওয়ালী তাকে কোন এক ঘটনায় ব্ল্যাকমেইল করে তার অর্থকড়ি হাতিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু কোন ঘটনায় কিভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন সেটি স্পষ্ট করে খোলসা করেননি।
মুন্না রহমান আরো বলেন, তারা ওই সময় পুলিশকে জানাতে বললে তিনি অস্বীকৃতি জানান। এমনকি ওই বাড়িওয়ালী তাকেসহ তার স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করবে বলে তিনি আতঙ্ক প্রকাশ করেছিলেন। বিষয়টিতে স্বজনরা গুরুত্ব না দেয়ায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।

এ দিকে ঘটনার পর তিন দিন পার হলেও কোনো রহস্য উদঘাটন করতে না পারায় স্বজনরা ক্ষোভ ও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাদের ভাষ্য, বাসাটিতে মাসখানেক আগে সিসিটিভি লাগানো হলেও পুলিশ তাতে কোনো ফুটেজ পায়নি। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে সিসিটিভি ফুটেজ ডিলেট করা হয়েছে কি না সেটি নিয়েও তারা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বাড়িওয়ালীসহ সন্দেহভাজন সবাইকে চিহ্নিত করে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি জানান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরখান থানার পরিদর্শক (অপারেশন) সরোয়ার হোসেন খান বলেন, তারা ঘরে একটি চিরকুট পেয়েছেন। সেই চিরকুটের সূত্র ধরেই তদন্ত করা হচ্ছে। ১২ ফেব্রুয়ারি লেখা ওই চিরকুটে নিজেকে ‘নিকৃষ্ট লোক’ হিসেবে তুলে ধরে দুই সন্তান ও স্ত্রী হত্যার কথা স্বীকারের পাশাপাশি তার লাশ রেললাইনে পাওয়া যাবেও উল্লেখ ছিল। এই কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিকভাবে চিরকুটের হাতের লেখা রকিব উদ্দিনের বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে পরীক্ষার পর পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে। শুক্রবার লাশ পাওয়া গেলেও বুধবার বিকেলে হত্যাকা ঘটেছে বলে তারা ধারণা করছেন।

চিরকুটে বাড়িওয়ালীকে দায়ী করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি লোক যখন অনেক বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন তখন তিনি অনেক কিছুই ঠিকঠাকমতো বলতে পারেন না। তারপরেও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনার সাথে কারো সংশ্লিষ্টতা পেলে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সিসিটিভিতে ফুটেজ না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সিসিটিভি লাগানো থাকলেও সেটি যথাযথভাবে অপারেট করতে না পারায় কোনো ফুটেজ সংরক্ষণ পাওয়া যায়নি। তবুও কোনো ফুটেজ মুছে ফেলেছে কি না সেটি জানতে সিসিটিভি সিআইডি ও সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কাছে পাঠানো হয়েছে। তারা বিষয়টি তদন্ত করছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বুধবার বিকেলে রকিব তার এক সহকর্মীকে কল করে জানিয়েছিলেন যেÑ তিনি বৃহস্পতিবার অফিসে যাবেন না। ফোনে কললিস্টের সূত্র ধরে সেই সহকর্মীর সাথে কথা বলে বিষয়টি জানা গেছে। তবে সেটাই তার শেষ কল এবং শেষ কথা ছিল। এর পর থেকে তার ফোনটি বন্ধ রয়েছে। নিখোঁজ রকিবের খোঁজ মিললেই চাঞ্চল্যকর এই হত্যারহস্যটির জট খুলবে বলে মনে করছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।

র্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, ঘটনার আলামত ও আত্মীয়স্বজনদের বক্তব্যে হত্যাকাে র সাথে গৃহকর্তা রকিবের জড়িত থাকার বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট হওয়া গেছে। তবে তাকে না পাওয়ায় বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। আমরা তার অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা করছি। রকিবকে কেন প্রধান সন্দেহভাজন করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রকিব উদ্দিনের ঋণের পরিমাণ ৬০ লাখ টাকা। সেই টাকা তিনি কোনোভাবে পরিশোধ করতে না পেরে পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের কাছে টাকা চেয়েছেন। ঋণ পরিশোধে কেউ সহযোগিতা না করলে তিনি সপরিবারে আত্মঘাতী হতে পারেন বলে হুমকি দেন। যার কারণে তাকেই সন্দেহভাজন ধরে তদন্ত করা হচ্ছে।
ডিএমপির উত্তরা বিভাগের এডিসি হাফিজুর রহমান বলেন, আমরা অনুসন্ধান চালিয়ে প্রকৃত ঘটনা বের করার চেষ্টা করছি। সংশ্লিষ্ট এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। ফুটেজ উদ্ধারের পর প্রয়োজনে এক্সপার্টদের সহযোগিতা নেয়া হবে।

ডিএমপির উত্তরা বিভাগের ডিসি নাবিদ কামাল শৈবাল বলেন, বাড়ি থেকে উদ্ধার সিসিটিভিসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করা হবে। এ ছাড়া রেলওয়ে পুলিশকে ঘটনাটি জানানো হয়েছে। যদিও ঘটনার পর থেকে রেল দুর্ঘটনায় অজ্ঞাত পরিচয়ের কারো লাশ পাওয়া যায়নি বলে তারা জানতে পেরেছেন। এ বিষয়ে কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি রকিব উল হোসেন বলেন, ঘটনাটি তারা শুনেছেন এবং সচেতন রয়েছেন। তবে ১২ ফেব্রুয়ারির পর থেকে রেললাইনে কাটা পড়া কোনো মৃত বা আহত ব্যক্তির খোঁজ তারা পাননি বলে জানিয়েছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com