জাতীয় ক্রিকেট দলের টেস্ট ও টি-২০ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান গত সপ্তাহে সংযুক্ত আরব আমিরাতে একজন ‘বিতর্কিত ব্যবসায়ী’র জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানের নতুন শোরুম উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন আর তা নিয়ে দেশের গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যম কয়েকদিন বেশ সরগরম।
বিতর্ক শুরুর চার দিন পরে বিষয়টি নিয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বক্তব্য দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বিসিবি।
বিসিবির পরিচালক জালাল ইউনুস গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের ক্রিকেটের সম্পদ, তাকে আগলে রাখা বিসিবির দায়িত্ব।’
এদিকে তুমুল বিতর্ক আর আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে দুবাই থেকে ফিরে সাকিব সিলেটে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে যোগ দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কী বলছে
বিতর্কিত ব্যবসায়ী যাকে ‘খুনের মামলার আসামি’ বলে বর্ণনা করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। তার মালিকানাধীন স্বর্ণের দোকানের নতুন শোরুম উদ্বোধন করতে দুবাই গিয়েছিলেন সাকিবসহ দেশের কয়েকজন তারকা।
এরপরই ওই ব্যবসায়ীর অতীত কর্মকাণ্ডের বিষয়টি গণমাধ্যমের সামনে আসে এবং ‘সাকিব কেন তার পণ্য এনডোর্স করছেন’ এমন প্রশ্নে তার নৈতিক অবস্থানের সমালোচনা শুরু হয়।
এক পর্যায়ে গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকেও এ নিয়ে মন্তব্য করা হয় এবং ওই ব্যক্তি সম্পর্কে সাকিবকে সতর্ক করা হয়েছিল এমন অভিযোগও ওঠে।
এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ক্রিকেট অপারেশন্সের প্রধান জালাল ইউনুস বলেছেন, ‘এই ঘটনায় সাকিবের দায় না থাকলে তাকে সবকিছু থেকে রক্ষা করবে বিসিবি।’
তিনি বলেন, ‘সাকিব শুধু বিসিবিরই নয়, দেশের সম্পদ। তাকে দেখাশোনা করা আমাদের দায়িত্ব।’
শনিবার সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের ইনিংস বিরতিতে জালাল ইউনুস সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘ঘটনার এক দিনের মাথায় আরেকটি সিরিজ শুরু হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল আইসিসির বৈঠকের জন্য সিইও ও প্রেসিডেন্ট দেশের বাইরে আছেন। আমাদের শৃঙ্খলা কমিটি আছে। ওনারা যদি মনে করেন তদন্ত প্রয়োজন তবে তারা দেখবেন।’
জালাল ইউনুস জানান, বিষয়টি নিয়ে এখনো সাকিব আল হাসানের সাথে বিসিবির কোনো আলোচনা হয়নি। আয়ারল্যান্ড সিরিজ শেষে এ নিয়ে আলোচনা করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
তবে তিনি মনে করেন, এমন সময়ে সাকিবের সমর্থন দরকার আর বিসিবি সেটি তাকে পুরোপুরি দেবে।
‘এখানে সাকিবকে সমর্থন করাটা দরকার। ও যদি আসামির সম্পর্কে জেনে না থাকে তাহলে তাকে পরামর্শ বা উপদেশ দেয়া যায় কি না, আমাদের কোনো নির্দেশনা আছে কি না, সেটা নিয়ে আমরা আলাপ করতে পারি,’ বলেন বিসিবির এই পরিচালক।
জালাল ইউনুস সাংবাদিকদের বলেছেন, ঘটনার বিস্তারিত জেনে এবং বিসিবির কেন্দ্রীয় চুক্তির কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে কি-না সেসব বিষয় তদন্ত করে দেখবে বিসিবি এবং তারপরই এ বিষয়ে যা করার করবে সংস্থাটি।
সাকিব আল হাসান বিভিন্ন সময়ে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন।
এর মধ্যে ২০১৯ সালে এক জুয়াড়ির সাথে কথপোকথন গোপন করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছিলেন।
তারপর ক্রিকেটে ফিরে ঢাকার লিগে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে অখুশি হয়ে স্ট্যাম্প ভেঙেছিলেন সাকিব।
তবে অনেকে মনে করে থাকেন সাকিব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চরিত্র, তাই তার যেসব কর্মকাণ্ডে শাস্তির মাত্রা অনেক গুরুতর হতে পারত, সেসব ঘটনায় লঘুদণ্ডেই পার পেয়ে যান, হয়তো তার নামের কারণেই।
যে কারণে দুবাই সফর নিয়ে বিতর্ক
মার্চের ১৪ তারিখে টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে তিন ম্যাচের সিরিজে হোয়ইটওয়াশ করে বাংলাদেশ।
সেদিন রাতের ফ্লাইটেই সাকিব আল হাসানের দুবাই যাওয়ার কথা, যা তিনি নিজেই ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন।
পরদিন থেকে শুরু নতুন এই বিতর্কের।
যে প্রতিষ্ঠানের নতুন শোরুম উদ্বোধনের জন্য সাকিব আল হাসান দুবাই গেছেন, একই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন ঢাকার আরো কয়েকজন ব্যক্তিত্ব।
কিন্তু মূলত সাকিব তাতে যোগ দেয়ার পরই এ নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা শুরু হয়।
ঢাকার কয়েকটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়, যে পণ্যের প্রচারণায় দুবাই গেছেন সাকিব আল হাসান, সেই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তি একজন অপরাধী।
এরপরই গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরণের অনুসন্ধানী খবর এবং বিশ্লেষণ প্রকাশিত হতে থাকে।
এর মধ্যে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকেও সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ১২টির মতো গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে।
অন্যদিকে, ফেসবুক, ইউটিউব ও টিকটকসহ সামাজিক মাধ্যমে সাকিবের পক্ষে এবং বিপক্ষে নানা মতামত দেখা যায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাকিবের অনুসারীদের কেউ কেউ লিখেছেন, ‘সাকিবের উচিৎ কোথায় যাচ্ছেন এবং কার সাথে মিশছেন এসব বিবেচনা করা।’
কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ লিখেছেন, ‘যেহেতু সাকিব একজন আইডল, তিনি যদি এমন কোনো কাজ করেন বা এমন কারো সাথে মেশেন যিনি ক্রিমিনাল বলে অভিযুক্ত। সেটা আসলে মেনে নেয়া যায় না।’
আবার কেউ কেউ বলেছেন, ‘সাকিব নিজের ইমেজ বিক্রি করছেন। কিন্তু তিনি যে একজন আসামির সাথেই চুক্তি করছেন, এটা তদন্ত করা তো সাকিব আল হাসানের কাজ নয়।’
এসব আলোচনার মধ্যেই সেই বিতর্কিত ব্যবসায়ী নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে সাকিব আল হাসানের সাথে একটি ছবি পোস্ট করেন।
তিনি দাবি করেন, সাকিব তার বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন, সেই ছবির ক্যাপশনে ‘এত নিউজের পরেও’ তার আতিথেয়তা গ্রহণের জন্য তিনি সাকিবকে ধন্যবাদ জানান।
তবে পুরো বিষয়টি নিয়ে সাকিব এখনো পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেননি।
এই প্রতিবেদনের জন্য সাকিব আল হাসানের হোয়াটস্যাপে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে তিনি তারও কোনো উত্তর দেননি।
তবে একদিনের দুবাই সফর শেষ করে সাকিব দেশে ফিরেই সিলেটে বাংলাদেশ দলের ক্যাম্পে যোগ দেন।
সেখানে প্র্যাকটিস সেশনে ডান হাতে ব্যাট করে অবাক করে দেন সবাইকে। পরের দিন ৯৩ রানের একটি ইনিংস খেলে বাংলাদেশের জয়ে ভূমিকা রাখেন।
সূত্র : বিবিসি