অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি পলিসিতে পিছিয়ে রয়েছে। ২০২৪ সালে কুইক রেন্টাল থেকে বের হয়ে আসার কথা। এখন সরকারের হাতে সময় রয়েছে ৬ মাস। কিন্তু এর থেকে বের হয়ে আসার জন্য সরকারের কোনো উদ্যোগ দেখছি না বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি পলিসি আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়নি। দ্রুত বিদ্যুৎপ্রাপ্তির সংশোধিত আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন তিনি। দ্রুত বিদ্যুৎপ্রাপ্তি আইনটি করা হয়েছিল কিন্তু ২০২২ সালে দেশে বিদ্যুতের এই পরিস্থিতি নেই।
ধানমন্ডিস্থ সিপিডি সেন্টারে আয়োজিত নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২২ (খসড়া): এটি কি পরিচ্ছন্ন জ্বালানির লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হবে? শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে লিখিত উপস্থাপনাসহ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
উপস্থাপনায় ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি পলিসি-২০২২ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমান বিদ্যুৎ খাতে যে সঙ্কট রয়েছে তা অনেকটাই কমে যাবে। বিদ্যুৎ খাতে অদূরদর্শী ও ভুল সিদ্ধান্তের জন্য সরকারের উপর এখন বিশাল পরিমাণ ভর্তুকির চাপ পড়েছে। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দোহাই দিয়ে তা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ভোক্তাদের ওপর। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে গৃহীত নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতির যে নতুন খসড়া (নবায়ন জ্বালানি নীতি-২০২২) তৈরি হয়েছে, এতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাস্তবায়ন ও বিস্তারে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে, যা মূল নীতির চেয়ে আরো বেশি বিস্তারিত এবং নতুন প্রস্তাবনা সমৃদ্ধ। তবে একই সঙ্গে মূল এবং খসড়া নীতির কিছু সিদ্ধান্তে সাংঘর্ষিকতা রয়েছে। তিনি বলেন, যাদের কাজ করার যোগ্যতা নেই তাদেরকে বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প দেয়া হচ্ছে। এতে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ৩৬টি প্রকল্পের মধ্যে ২৬টি প্রকল্পে কোনো কাজ হয়নি। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নীতিমালা নেই। ড. মোয়াজ্জেম বলেন, নতুন পলিসিতে বায়ু, বিদ্যুৎ, বায়োম্যাস এনার্জি, ওয়েস্ট টু ইলেকট্রিক্যাল এনার্জি, হাইড্রো এনার্জি বিষয়ে মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তির মধ্যে রয়েছে- জিওথার্মাল এনার্জি, টাইডাল এনার্জি, ওয়েভ এনার্জি, রিভার কারেন্ট, হাইড্রোজেন এনার্জি ইত্যাদি। এ ছাড়া পলিসির প্রথম দফায় ২০২৫ সালে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, যা সামগ্রিক উৎপাদনের ১০ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২৬ থেকে ২০৪১ সালে সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা।
যা উৎপাদনের ২০ শতাংশ এবং ২০৩১ থেকে ২০৪১ সালে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা, যা উৎপাদনের ৪০ শতাংশ। কিন্তু ২০০৮ সালে গৃহীত পলিসির আওতায় সামগ্রিক উৎপাদনের ৮ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এটা পলিসির ব্যর্থতা। তিনি জানান, তবে জীবাশ্ম জ্বালানিকে নিরুৎসাহিত না করা হলে এই পলিসির মাধ্যমে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিস্তার করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে বিশেষ পরিস্থিতিতে জ্বালানি খাতের জন্য দ্রুত বিদ্যুৎ প্রাপ্তি আইনটি করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালে দেশে বিদ্যুতের এই পরিস্থিতি নেই। এখন তো আইনটি রয়ে গেছে। এর অন্যতম কারণ এই আইনের মাধ্যমে অনেক অনিয়ম আড়াল করা হচ্ছে। মানুষ জানতে পারছে না বিদ্যুতের চুক্তিগুলো সম্পর্কে। তিনি বলেন, ওই আইনের কারণে জ্বালানি খাতের কোনো স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সরকার কোথায় কার সঙ্গে কী শর্তে চুক্তি করছে এটি দেশের জন্য প্রয়োজনীয় না ক্ষতিকর কিছুই জানা যাচ্ছে না। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ সবচেয়ে সস্তা হওয়ার কথা কিন্তু এখন যেসব তথ্য বের হয়ে আসছে তাতে তো দেখা যাচ্ছে মাথা খারাপ হওয়ার মতো দাম। আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুতের দামও ১৬ টাকা ইউনিট।
ড. মোয়াজ্জেম বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে এখনি অবসরে পাঠিয়ে দিয়ে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে আমাদের যেতে হবে। এটি করলে দেশের কোনো ক্ষতি হবে না। এ বিষয়ে সিপিডির একটি গবেষণা আছে। সেখানে দেখানো হয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র করলে আর্থিকভাবে ক্ষতি হবে না। বরং দীর্ঘ মেয়াদে লাভের সম্ভাবনা রয়েছে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী সরকার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করছে। কারণ আইএমএফ বিদ্যুতের ভর্তুকি প্রত্যাহারের কথা বলেছে। এখন মূল্য বৃদ্ধির দায়ভার ভোক্তার ঘাড়েই চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। সাধারণভাবে বলা হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা। মূল কারণ দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের ৪৮ শতাংশ অব্যবহৃত থাকছে। এই অব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম দিতে হচ্ছে। এর ফলে দেশে মূল্যস্ফীতিসহ জীবনযাত্রার মানে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
সিপিডির উপস্থাপনায় বলা হয়, ২০০৮ সালে সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানির যে খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করেছিল তার চেয়ে ২০২২ সালের খসড়াটি বেশ গোছানো। সেখানে ২০২৫ সালেই মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির কথা বলা হয়েছে। ২০৪১ সালে এর উৎপাদন ধরা হয়েছে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ।
উপস্থাপনায় ভারত ও ভিয়েতনামের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, এই খাতে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে যে সুযোগ দেয়া হয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতেও তেমন সুযোগ দেয়ার সুপারিশ করা হয়। এনার্জি পার্ক স্থাপনের জন্য আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে।
ড. মোয়াজ্জেম বলেন, ভারত ও ভিয়েতনামের বিস্তীর্ণ জমি রয়েছে। এর জন্য তারা বড় ধরনের এনার্জি পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিতে পেরেছে। কিন্তু আমাদেরও এই ধরনের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এতে বিনিয়োগকারীরা এক জায়গা থেকে সহজে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ দিতে পারবে। তিনি বলেন, কথায় কথায় আমরা ভারত বা ভিয়েতনামের তুলনা এনে কথা বলি, এখন সময় এসেছে ভারত ও ভিয়েতনাম নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে সে সবের সঙ্গেও যেন আমাদের তুলনা করা হয়।