রাজিন রাজধানীর খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া এলাকায় অবস্থিত একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী। কয়েক দিন আগে তার ডায়েরিতে শিক্ষক লিখে দিয়েছেন, ক্লাসে দুষ্টুমি করে, বাসায় যত্ম নিন।
রাজিনের বাবা এ প্রতিবেদককে জানান, রাজিনের ডায়েরিতে এর আগেও শিক্ষক লিখে দিয়েছেন সে ক্লাসে বেশি কথা বলে। সর্বশেষ ডায়েরিতে এ মন্তব্য দেখে রেগে যান রাজিনের মা। তিনি রাজিনের কাছে জানতে চান ক্লাসে সে কী দুষ্টুমি করেছে। ডায়েরিতে কেন ঘন ঘন মন্তব্য পাচ্ছেন। এ কথা বলে একপর্যয়ে সে রাজিনকে লাঠি দিয়ে পেটানো শুরু করেন। পেটানোর সময় সে বলে শিক্ষক তোকে বাসায় যত্ম নিতে বলেছে। এই হলো তোর যত্ম ।
রাজধানীর অনেক অভিভাবক জানিয়েছেন, একসময় শিক্ষকেরা ক্লাসেই শিক্ষার্থীদের শাসন করতেন। খারাপ কাজ করলে শাস্তি দিতেন স্কুলে। কিন্তু বর্তমানে রাজধানীর অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যত যা কিছুই করুক না কেন, শিক্ষকেরা ক্লাসে তাদের তেমন শাসনও করেন না, শাস্তিও দেন না। তারা এটি ছেড়ে দেন মা-বাবার হাতে। পড়া আদায় থেকে শুরু করে ক্লাসে বেয়াদবি, দুষ্টুমি, অমনোযোগী বা যা কিছুই করুক না কেন, তারও শাস্তি দিতে হয় মা-বাবাকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর একজন স্কুলশিক্ষক এ বিষয়ে বলেন, অনেক নামী-দামি আর প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের সন্তানেরা পড়ে আমাদের স্কুলে। আমরা সামান্য শিক্ষক হয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের মারধর করলে তা অনেকে সহজে মেনে নিতে পারেন না। অনেক সময় শিক্ষকদের জবাবদিহি করতে হয় এ জন্য। কিন্তু তার পরও ক্লাসে সার্বিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তাদের শাসন করতে হয়। ক্লাসে শাসন করা হয় না, তা ঠিক নয়। শাসন না করলে তো ক্লাসে পাঠদান সম্ভব হয় না। যতটা মার্জিত উপায়ে সম্ভব ক্লাসে তাদের শাসন করে, বকাঝকা দিয়ে বা অনেক ক্ষেত্রে কানে ধরে দাঁড় করিয়ে রেখে ক্লাসে শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়।
প্রাথমিকের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানিয়েছে, শিক্ষক ক্লাসে বেত লাঠি না আনলেও বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়া হয়। যেমন কাউকে ক্লাসে কান ধরে দাঁড় করানো হয়, কেউ বেশি খারাপ কাজ করলে তাকে ক্লাসের বাইরে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়, আবার কাউকে সিঁড়িতে পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রাখা হয় বেশি লজ্জা দেয়ার জন্য। এ ছাড়া কখনো কখনো ডাস্টার দিয়েও আঘাত করেন কোনো কোনো শিক্ষক।
একজন অভিভাবক আফসোস করে বললেন, বর্তমানে প্রায় প্রতিটি শিশু পড়াকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন ঘরে মা-বাবা কর্তৃক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। যে শিশুটি প্রতিদিন ঘরে মা-বাবা কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তার ভবিষ্যৎ কী আর সে শিশুর নিরাপত্তাই বা কোথায়। ঘরেই তো সে নিরাপদ নয়।
অভিভাবকদের মতে, বর্তমান শিক্ষা আর শিক্ষা ব্যবস্থাই শিশুদের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এক দিকে শিশুদের ওপর বিরাট বড় বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে আরেক দিকে তাদের জন্য আয়োজন করা হয়েছে ঘন ঘন পাবলিক পরীক্ষা। স্কুলে দুই থেকে তিনটি পরীক্ষা ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলে সারা বছর প্রায় প্রতি সপ্তাহে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। এ কারণে মা-বাবা সারা বছর শিশুদের তীব্র চাপে রাখতে বাধ্য হন। পরীক্ষা আর পড়া আদায়কে কেন্দ্র করে ঘরেই নিয়মিত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিশুরা। এতে শিশুদের সঠিক মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেক অভিভাবক।
শিশুদের ওপর অধিক পড়ার বোঝা আর ঘন ঘন পরীক্ষার কারণে শিশুরাই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। বরং শিশুদের পড়া নিয়ে তীব্র চাপে রয়েছেন প্রায় সব মা। শিশুর পড়া নিয়ে অনেক পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও নিয়মিত মনোমালিন্য আর ঝগড়া পর্যন্ত হচ্ছে। শিশুর পড়ার চাপ আর তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন মায়েদের অনেকে ভুগছেন নানা ধরনের মানসিক সমস্যায়। এ নিয়ে অনেক সময় ঘটছে অনেক মর্মান্তিক ঘটনা। পারিবারিক এ সমস্যা শেষ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে রূপ নিচ্ছে সামাজিক সমস্যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক শাহ শামীম আহমেদ বলেন, কোনো কিছু না শিখলে একটি শিশু তা পরবর্তীতে নিজে শিখে নিতে পারে কিন্তু একটি শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে সে ক্ষতি ভবিষ্যতে কোনো কিছু দিয়ে পূরণ করা যায় না। তিনি বলেন, বর্তমানে মা-বাবার মূল লক্ষ হলো শিশুদের প্রতিযোগিতার বাজারে ফলাফলের ক্ষেত্রে গ্রেড বা মান বাড়ানো। এ জন্য তারা শিশুদের শারীরিক ও মানসিকভাবে শাস্তি দিচ্ছে। কিন্তু শিশু কতটুকু ধারণ করার উপযুক্ত এবং আদৌ সে এত পড়া ধারণ করতে পারছে কি না সে দিকে তাদের খেয়াল নেই। ফলে অধিক পড়ার চাপে শিশুরা মানসিকভাবে ভীষণ চাপে থাকে এবং তাদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।