হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের আলোকে নীতিমালা প্রণয়নের পর উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্ট আইনজীবীরা। ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগ উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে সাত দফা নির্দেশনা প্রদান করেন।
বিচারক নিয়োগে বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা আনতে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে বিচারক নিয়োগের জন্য আবেদন আহ্বান করা যেতে পারে। আবেদনকারী ব্যক্তিকে সম্পদের বিবরণ উল্লেখসহ সুপ্রিম কোর্টে সাক্ষাৎকার দিতে হবে। এটি বিচারক নিয়োগকে অধিকতর স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করার একটি উৎকৃষ্ট পন্থা। হাইকোর্টের নির্দেশনার পর ২০১৭ সালের ২৪ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যকরী কমিটির সাধারণ সভায় হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন করে বিচারপতি নিয়োগ করার দাবি জানানোর সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
বিভিন্ন সময় আইনজীবীরা হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগে নীতিমালা ও আইন করার দাবি জানালেও তা আজো বাস্তবায়ন হয়নি। বরং নীতিমালা প্রণয়ন বা আইন না করেই সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে নতুন বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাই চেয়ারম্যান প্রবীণ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, একটা কথা মনে রাখতে হবে, বিচার বিভাগ হলো জনমানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। এ আশ্রয়স্থলটি যাতে কোনো মতে, কোনোভাবে কলঙ্কিত না হয় এবং প্রভাবমুক্ত থাকে সেটা আমাদের সবার দেখতে হবে। তিনি বলেন, যোগ্যতা, সততা ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করে হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগ করার দাবি বহু দিনের। এ বিষয়ে হাইকোর্ট যে সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছেন তাও সঠিকভাবে প্রতিপালন করা হয়নি। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে আজকে যে অবস্থা তাতে দক্ষ যোগ্য সৎ বিচারক অনেক ক্ষেত্রেই নিয়োগ হচ্ছে না। কেননা আমরা যারা রাজনীতি করি তারা যখন ক্ষমতায় থাকি তখন স্বাভাবিকভাবেই আমরা চাইব আমাদের নিজস্ব লোকজন বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিতে। কিন্তু নীতিমালা থাকলে সে অনুযায়ী বিচারক নিয়োগ হবে। বিচারক নিয়োগে যে অনিয়ম হচ্ছে তখন তা থাকবে না।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমি এখনো মনে করি বিচারক নিয়োগ করে কেবল সংখ্যা বাড়ালেই হবে না। নিয়োগের আগে তাদের দক্ষতা ও সততা আমাদের দেখতে হবে। আমরা দেখেছি বর্তমান সরকারের আমলে এসব বিবেচনা না করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের পছন্দ মতো বিচারক নিয়োগ করা হয়েছে। ফলে আমরা দেখেছি বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ার ফলেও আশানুরূপ মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। তাই এখনো দাবি করছি বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যত দিন নীতিমালা না করা হয়, ততদিন হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছে তা পালন করে বিচারক নিয়োগ করতে হবে। নতুবা বিচারকের সংখ্যা বাড়িয়ে অযথা আমাদের রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় হবে বলে আমি মনে করি।
তিনি বলেন, আমি মনে করি আমাদের প্রধান বিচারপতি দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। হাইকোর্টের কোন আইনজীবী কী ধরনের তা তিনি জানেন। হাইকোর্টের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে তথ্য দেয়া উচিত ছিল, কিন্তু কতটা দিয়েছে তা আমি জানি না। আমার একটিমাত্র কথা দলীয় মনোভাব না নিয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণœ রাখা ও বিচার বিভাগের সততা ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আমাদের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। দলীয় মনোভাব বা ব্যক্তিগত পছন্দ কোনো মতেই যেন প্রাধান্য না পায় সে দিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।
২০১৭ সালের ২২ মে প্রকাশিত রায়ে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের যোগ্যতা নির্ধারণে সাত দফা নির্দেশনা (পর্যবেক্ষণ) দেন হাইকোর্ট। এতে মূল্যায়নের সবসময় ক্ষমতা থাকবে প্রধান বিচারপতির হাতে। বিচারক নিয়োগে বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা আনতে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিতে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। গত ১৩ এপ্রিল বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের হাইকোর্ট বেঞ্চ বিচারক নিয়োগে বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা আনতে জারি করা রুল কিছু পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করেন। পর্যবেক্ষণসহ বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হচ্ছে বলে রায়ের সংক্ষিপ্তসারে জানিয়ে দিয়েছিলেন আদালত।
রায়ে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হতে একজন ব্যক্তির ন্যূনতম বয়স ৪৫ হওয়া উচিত। বিচারকদের ক্ষেত্রে জেলা ও দায়রা আদালতে বিচারিক অভিজ্ঞতা তিন বছরের কম হলে উচ্চতর বিচারিক ক্ষেত্রে তারা সুপারিশের জন্য গণ্য হবেন না।
সাত দফার প্রথম পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একজন ব্যক্তি, যিনি বাংলাদেশের নাগরিক ও যিনি সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে বর্ণিত বাংলাদেশের চারটি রাষ্ট্রীয় মূল নীতি যথা জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার ওপর এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর আস্থা রাখেন, তাকে নিয়োগে সুপারিশ করা যাবে। তবে কেউ এই মূলনীতি ও ভাবধারার ওপর আস্থাহীন হলে তাকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা যাবে না।
দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সুপারিশ করা ব্যক্তির শিক্ষাজীবনে দারুণ ফলাফল, সমৃদ্ধ পেশাগত দক্ষতা, আইনগত বিচক্ষণতা ও একাগ্রতা থাকতে হবে।
তৃতীয় দফায় বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে আগ্রহী প্রার্থীর জীবনবৃত্তান্ত সংরক্ষণ করা যেতে পারে, যাতে প্রধান বিচারপতি ইচ্ছে করলে প্রাথমিক বিবেচনার জন্য ওই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ সাক্ষাৎকারের জন্য তাদের সম্পদ ও দায়দেনার বিবরণসহ হাজির হতে পারেন, যা কার্যকর, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ইমেজের মধ্য দিয়ে যথার্থ সুপারিশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সুবিধা দেবে।
চতুর্থ দফায় বলা হয়, পেশাগত ক্ষেত্রে সময় দেয়ার মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তি পেশাগত দক্ষতা এবং যোগ্যতা অর্জন করেন। তাই সাধারণভাবেই প্রার্থীর বয়স সুপারিশের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত। ভারতীয় আইন কমিশনের ৮০তম প্রতিবেদনে বিচারকদের নিয়োগের বিষয়ে দেয়া পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, একজন বিচারকের জন্য পরিপক্বতা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বহু বছরের চমকপ্রদ পেশাগত কৃতিত্বের কোনো বিকল্প নেই। এ বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে আদালতের মত সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হতে চাওয়া একজন ব্যক্তির ন্যূনতম বয়স ৪৫ হওয়া উচিত।
পঞ্চম দফায় বলা হয়, ভালো মানের নিয়োগ নিশ্চিত করতে প্রধান বিচারপতির সুপারিশের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগে নিযুক্ত আইনজীবীদের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। তবে খুব ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে হাইকোর্টে নিযুক্ত আইনজীবীদেরও তাদের কাজের পরিধি, চর্চার অভিজ্ঞতা, সততা ও আন্তরিকতাকে আমলে নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগের জন্য তাদের সুপারিশ করা যেতে পারে।
ষষ্ঠ পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, অধস্তন বিচারিক ক্ষেত্রে কর্মরত বিচারকদের ক্ষেত্রে জেলা ও দায়রা আদালতে বিচারিক অভিজ্ঞতা তিন বছরের কম হলে তারা উচ্চতর বিচারিক ক্ষেত্রে সুপারিশের জন্য গণ্য হবেন না। সপ্তম দফায় বলা হয়, অধস্তন বিচারিক ক্ষেত্রে কর্মরতদের সুপারিশের ক্ষেত্রে মেধা এবং একাগ্রতাও অন্যতম বিবেচ্য হবে। এটা মাথায় রাখতে হবে যে উচ্চ মেধাসম্পন্ন একজন ব্যক্তির একাগ্রতা না থাকলে তিনি প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর হন।
রায়ে বলা হয়, হাইকোর্ট বিভাগ থেকে কাউকে নিয়োগের ক্ষেত্রে মতামত গঠন এবং যথার্থ, কার্যকর ও স্বচ্ছ সুপারিশের জন্য প্রধান বিচারপতি যদি মনে করেন, তাহলে তিনি আপিল বিভাগের দু’জন এবং হাইকোর্ট বিভাগের দু’জন জ্যেষ্ঠতম বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন। প্রধান বিচারপতি এই সুপারিশকে মতামত হিসেবে দেয়ার পরে ওই সিদ্ধান্তকে অনুমোদন না করার কোনো উপায় থাকবে না, যদি না সুপারিশকৃত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কোনো রাষ্ট্রবিরোধী বা সমাজবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকেন।
বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা আনতে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে ২০১০ সালের ৩০ মে আইনজীবী ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরী এ রিট দায়ের করেন। রিটের শুনানি নিয়ে ২০১০ সালের ৬ জুন বিচারপতি মো: ইমান আলী ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চ সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে বাছাই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা আনতে কেন সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা তৈরি করা হবে না এবং নিয়োগের নির্দেশনা প্রণয়ন করে তা কেন গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ দেবেন। আর ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিভাগের বিচারক-সংখ্যা সাময়িকভাবে বাড়ানো উচিত বলে সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হলে তিনি যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন এক বা একাধিক ব্যক্তিকে অনধিক দুই বছরের জন্য অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করতে পারবেন। আমাদের দেশে রেওয়াজ হচ্ছে ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে দুই বছরের জন্য অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়। দুই বছর পরে ওনাদের পারফরম্যান্স দেখে প্রধান বিচারপতি সুপারিশ করেন, সে অনুযায়ী ওনাদের কনফার্ম করা হয়।
আমিন উদ্দিন বলেন, আমরা আশা করছি ভবিষ্যতে যে নিয়োগগুলো হবে সেগুলো সংবিধানের ৯৫ ও ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুসরণ এবং ১০ বিচারপতির রায়ের ম্যান্ডেট দেখে নিয়োগ দেবেন সংবিধান অনুযায়ী। সংবিধানের বাইরে কিছু করার স্কোপ নেই। সংবিধানে স্পষ্ট রয়েছে এখানে কী করতে হবে। শুধু ম্যান্ডেট হচ্ছে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ নিতে হবে, আলোচনা করতে হবে। সংবিধানেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা রয়েছে। তিনি বলেন, নীতিমালা তো সংবিধানের ওপরে যাবে না। নীতিমালাতো আইনও না। নীতিমালার তো বাউন্ডিং ইফেক্টও নেই। সংবিধানে বিষয়টি স্পষ্ট রয়েছে। নীতিমালা কেন? আইন হতে পারে। নীতিমালাতো সংবিধানকে সুপারসিড করতে পারবে না।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, বিচারপতি পদে নিয়োগের পরে তদন্ত না করে আগেই তাদের যোগ্যতা ও সততা সম্পর্কে তদন্ত করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। শুধু রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে কাউকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ করা কোনোভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়।
তিনি বলেন, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে নতুন বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু বিচারক নিয়োগের নীতিমালা বা নিয়োগের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের নির্দেশনা পালন সম্পর্কে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। এ অবস্থায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সংবিধানের ৯৫ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের আলোকে বিচারক নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে নতুন বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে।