নিউইয়র্ক নগরের স্পেশাল হাইস্কুলে ভর্তি নিয়ে চলছে অসম প্রতিযোগিতা। যাদের অর্থবিত্ত আছে, তারা কোচিং আর আলাদা করে সন্তানদের পড়ালেখার ব্যবস্থা করে এসব স্কুলে ভর্তির জন্য তৈরি করছেন। যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাদের সন্তানেরা পিছিয়ে পড়ছেন। এতে জীবনের শুরুতে মানসিক চাপে পড়ছে শিশুরা। অসংখ্য শিক্ষার্থী জীবন শুরুর আগেই মানসিক বৈকল্যের শিকার হচ্ছে। এ নিয়ে কয়েক বছর ধরে সোচ্চার নাগরিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। এবার তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন নিউইয়র্ক নগরের মেয়র বিল ডি ব্লাজিও। তিনি ‘সবার জন্য সমান সুযোগ’ স্লোগান তুলে স্পেশাল স্কুল বাদ দেওয়ার প্রস্তাব এনেছেন।
১৯৭২ সালে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য ও নগরের সমন্বয়ে একটি প্রস্তাব পাশ হয় যাতে অঙ্গরাজ্যের সাতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ‘স্পেশাল স্কুল’ ঘোষণা করা হয়। পরে আরও দুটি স্কুলকে স্পেশাল স্কুলের মর্যাদা দেওয়া হয়। বর্তমানে মোট স্পেশাল স্কুলের সংখ্যা নয়টি। এগুলো হলো—ব্রঙ্কস সায়েন্স হাইস্কুল, ব্রুকলিন ল্যাটিন স্কুল, ব্রুকলিন
টেকনিক্যাল হাইস্কুল, প্রিয়েলো লাগার্ডিয়া হাইস্কুল অব মিউজিক, আমেরিকান স্টাডিজ অ্যাট লেহমেন কলেজ, কুইন্স হাইস্কুল ফর দ্য সায়েন্স অ্যাট ইয়র্ক কলেজ, স্ট্যাটেন আইল্যান্ড টেকনিক্যাল হাইস্কুল, ম্যাথ সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জনিয়ারিং অ্যট সিটি কলেজ ও স্টাইভারস্যান্ট হাইস্কুল।
অভিযোগ উঠেছে, এসব স্পেশাল স্কুলে ভর্তি ঘিরে নিউইয়র্কে গড়ে উঠেছে কোচিং বাণিজ্য। মিলিয়ন ডলারের এই বাণিজ্যের ফাঁদে পড়ে সন্তানদের নিয়ে স্বপ্নে বিভোর প্রবাসী অনেকে ফতুর হচ্ছেন। কষ্টে উপার্জিত হাজার হাজার ডলার অর্থ কোচিং সেন্টারে ব্যয় করছেন। এ নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যেও আছে হতাশা, আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। স্পেশাল স্কুল বাদ দিতে সিটি মেয়র বিল ডি ব্লাজিও প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন। প্রস্তাবটি আইনে পরিণত হলে ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীর জন্য সমান সযুযোগ-সুবিধার পরিবেশ তৈরি হবে।
স্পেশাল স্কুল আইন অনুযায়ী, নগরের অন্যান্য স্কুলের চেয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে কয়েকগুণ বেশি বাজেট থাকে। শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও ইনস্ট্রুমেন্ট সাপোর্ট থাকে। অনেক ধনী ব্যক্তি এসব স্কুলে ডোনেশান দেন। ভালো মানের শিক্ষকদের সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের স্পেশাল স্কুলে ভর্তি করাতে আগ্রহী।
অষ্টম ও নবম শ্রেণি থেকে স্পেশাল স্কুলে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়। ধনী অভিভাবকেরা পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে স্পেশাল স্কুলে ভর্তির জন্য তৈরি করতে সন্তানদের কোচিং সেন্টারে পাঠাতে শুরু করেন। ফলে অনেকেই স্পেশাল স্কুলে ভর্তির সুযোগ পান। সীমিত আসনের কারণে আবার বেশির ভাগেরই ভর্তির সুযোগ হয় না। আবার যারা সামর্থ্যের কারণে তাদের সন্তানকে কোচিংয়ে পাঠাতে পারছেন না, তারা ভাবেন নিজেদের আর্থিক অক্ষমতার কারণে সন্তানের ভর্তির সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তৎকালে এক শ্রেণির ধনী, বর্ণবাদী ও প্রভাবশালীদের কারণে এসব স্কুল প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, যাতে নিম্ন আয়ের মানুষের সন্তানেরা এসব স্কুলে পড়তে না পারে। স্বল্প আয়ের মানুষের সঙ্গে শ্রেণিভেদ রাখতে ও নানা সুযোগ-সুবিধা নিতে এক শ্রেণির ধনী সম্প্রদায় বিশেষ স্কুল গড়তে কলকাঠি নেড়েছে।
তবে অনেক অভিভাবক মনে করেন, কোচিং সেন্টারে না পড়িয়ে সন্তানদের স্পেশাল স্কুলে ভর্তি হওয়া সম্ভব। সাধারণ জ্ঞান ও স্কুলের পড়া থেকে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা একটু মনোযোগী হলেই স্পেশাল স্কুলে ভর্তির যোগ্য হতে পারে।
২০১০ সালে ব্রুকলিন টেক থেকে পাস করা নাইম ইসলাম বলেন, স্পেশাল স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে একটি বৈষম্যমূলক আচরণ। সাধারণ স্কুলের শিক্ষার্থীরাই কোচিং ছাড়াই স্পেশাল স্কুলে ভর্তি হতে পারে। এ জন্য জানতে হবে সহজ ভর্তির নিয়ম।
অভিভাবক ফারুক ফয়সাল বলেন, অভিভাবকদের বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারে তাদের সন্তানদের না দেওয়া উচিত। এসব কোচিং সেন্টারে পড়ানো ব্যয়বহুল। তবে স্পেশাল স্কুল রাখা প্রয়োজন। এতে করে শিশুদের মেধা বিকাশে সহায়ক হয়। তবে স্পেশাল স্কুল সংখ্যা বাড়ানো দরকার। এতে ভর্তির জন্য স্কুলেই একটি বিশেষ ক্লাস থাকা প্রয়োজন।
২০০৪ সাল থেকে স্পেশাল স্কুল বন্ধের দাবিতে আন্দোলন করছে নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ সংগঠন ড্রামসহ প্রায় ২৫টি সামাজিক সংগঠন। এসব সংগঠন নিউইয়র্ক শিক্ষা অধিদপ্তরের সামনে বছরের বিভিন্ন সময়ে সভা-সমাবেশ ও স্মারকলিপি দিয়ে থাকে।
ড্রাম কর্মকর্তা ইসলাম বলেন, ‘আমরা বছরের পর বছর স্পেশাল স্কুলগুলো বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছি। আমাদের সঙ্গে আরও সংগঠন কাজ করছে। এসব স্পেশাল স্কুলে সব কমিউনিটি নয়, শুধু ধনী লোকদের সন্তানেরা ভর্তির সুযোগ পায়। অন্যান্য স্কুলের তুলনায় স্পেশাল স্কুলে বাজেট বেশি, এটি নেহাত বৈষম্য। তিনি বলেন, এক ঘরে যদি চার সন্তান থাকে, তাদের সবাইকে কোচিং সেন্টারে দেওয়া হয়, তার মধ্যে দুজন স্পেশাল স্কুলে সুযোগ পায়। তখন বাকি দুজনের মানসিক অবস্থা কোনোভাবেই ভালো থাকে না। এ রকম মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে হাজার হাজার ছাত্র। অনেকে শেষ পর্যন্ত পড়ালেখাও ভালোভাবে শেষ করতে পারছে না।
ইসলাম আরও বলেন, এমন অনেক অভিভাবক আছেন, যারা সন্তানকে স্পেশাল স্কুলে ভর্তি করাতে হাজার হাজার ডলার খরচ করেছেন। কিন্তু সন্তান ভর্তির সুযোগ পায়নি। সেই অভিভাবকের মানসিক অবস্থা কী হতে পারে, একটু ভাবা দরকার। নগর কর্তৃপক্ষ বিলটি পাস করলেই স্পেশাল বলে আর কিছু থাকবে না।
অভিভাবক আহমেদ হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার ছেলেকে স্পেশাল স্কুলে ভর্তির জন্য আমি একটি কোচিং সেন্টারে দিই। তারা বিভিন্ন কিস্তিতে আমার কাছ থেকে ১০ হাজার ডলার নেয়। আমার ছেলে স্পেশাল স্কুলে ভর্তি হতে পারেনি। এটি কোচিং সেন্টারের বাণিজ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। কোচিং কর্তৃপক্ষ অভিভাবক ও ছাত্রদের সঙ্গে প্রতারণা করছে।’
আরেক অভিভাবক সুব্রত বিশ্বাস বলেন, ‘স্পেশাল স্কুলের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। কোনো স্কুল যদি ভালো হয়, সেখানে যে কেউ পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে পারে। ভর্তি পরীক্ষা ভালো না হলে সে ছাত্র ভর্তি হতে পারবে না।’ কোচিং সেন্টার সম্পর্কে তিনি অভিযোগ করেন, এ সব কোচিং সেন্টারে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য চলছে।
একটি কোচিং সেন্টারের ছাত্রী নাসরিন আক্তার জানান, ‘আমাদের পাশের বাসার এক ছাত্রী স্পেশাল স্কুলে ভর্তির জন্য কোচিং করছে। তার দেখাদেখি আমার মা আমাকেও কোচিংয়ে ভর্তি করান। কিন্তু আমি কোচিং থেকে কোনো ফল পাইনি।’
অবশ্য স্পেশাল স্কুলে ভর্তি ও কোচিং বাণিজ্য প্রসঙ্গে খান টিউটোরিয়ালের চেয়ারপারসন নাঈমা খান বলেন, ‘কোচিং সেন্টার শুধু বাণিজ্য করে—এমন অভিযোগ সঠিক নয়। আমরা প্রচুর গরিব ছাত্রছাত্রীদের সহযোগিতা করি। আমাদের কোচিং সেন্টারে যারা পড়ছে, তারা শতভাগ সাফল্য লাভ করছে। দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে খান টিউটোরিয়াল সুনামের সঙ্গে সেবা দিয়ে আসছে।’
খান টিউটোরিয়ালের সিইও ইভান খান বলেন, ‘এক সময় আমাদের কমিউনিটির লোকজন বৈষম্যর শিকার ছিল, এখন আর তা নেই। কারণ, আমাদের ছেলেমেয়েরা উচ্চ শিক্ষিত। আর উন্নত শিক্ষা দেওয়ার কাজটি আমরা করছি। এটাকে আমরা কোনোভাবেই ব্যবসা হিসেবে দেখি না। তিনি দাবি করেন, এই কোচিংয়ে পড়ালেখা করে অনেকেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও সায়েন্টিস্ট হয়েছে। তারাও কমিউনিটির উন্নয়নে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
ববি তারিক কোচিং সেন্টার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার ফোন করলেও তাদের কেউ ফোন ধরেনি। এসএমএস দেওয়া হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। ম্যাথ মেটার্স টিউটোরিয়াল সেন্টারের সিইও সাঈদ হোসাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
মামুন টিউটোরিয়ালের মালিক শেখ আল মামুন বলেন, কেউ যদি দুই হাজার ডলার খরচ করে সন্তানকে একটা ভালো স্কুলে পড়াতে পারেন, এটা তার জন্য একটি সাফল্য। এটিকে কোনোভাবেই কোচিং সেন্টারের বাণিজ্য বলা যায় না। স্পেশাল স্কুল বন্ধে মেয়রের বিল উত্থাপন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিলটি গত বছর ও চলতি বছরে স্টেট কর্তৃপক্ষ নাকচ করেছে। এ বিলের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।