উম্মুল মু’মিনিন হজরত হাফসা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, চারটি আমল রাসূলুল্লাহ সা: নিয়মিত করতেন, কখনো ত্যাগ করতেন না। আমলগুলো হলো- ১. আশুরার রোজা; ২. রমজানের শেষদশকের ইতিকাফ; ৩. প্রতি মাসের তিন দিন তথা আইয়ামে বিজের রোজা ও ৪. ফজরের ফরজের আগের দু’রাকাত সালাত। (নাসায়ি, মিশকাত হাদিস নং-২০৭০)
১. আশুরার রোজা : হজরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- মহানবী সা: যখন হিজরত করে মদিনায় আগমন করেন, তখন তিনি দেখেন যে, ইহুদিরা আশুরার রোজা রাখছে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, এটি কিসের রোজা? তারা বলল- এটি মহান দিন, এ দিন আল্লাহ তায়ালা হজরত মূসা আ: ও বনি ইসরাইলকে তাদের শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করেন। তাই হজরত মূসা আ: এ দিন রোজা রাখতেন। রাসূলুল্লাহ সা: তখন বলেন, ‘আমি তোমাদের চেয়েও মূসার বেশি হকদার’। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা: সে দিন রোজা রাখেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে রোজা রাখতে নির্দেশ দেন। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, মহানবী সা:-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে, ফরজ সালাতের পর কোন সালাত উত্তম? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘মধ্যরাতের সালাত’। আবার প্রশ্ন করা হয়েছে রমজানের পর কোন রোজা উত্তম?
তিনি উত্তরে বলেন, ‘আল্লাহর মাস, যাকে তোমরা মহরম বলো অর্থাৎ আশুরার দিনের রোজা।’ (আহমদ, আবু দাউদ ও মুসলিম) রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেন, ‘আশুরার রোজা তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়নি। আমি এ রোজা রাখি। যার ইচ্ছা এ দিন রোজা রাখতে পারে। আর যার ইচ্ছা রোজা নাও রাখতে পারে।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) উম্মুল মু’মিনিন আয়েশা রা: বলেন, আশুরার দিন জাহেলি যুগে কুরাইশরা রোজা রাখত। রাসূলুল্লাহ সা:ও রোজা রাখতেন। মদিনায় আসার পরও তিনি রাখতেন এবং সাহাবিদের রোজা রাখার আদেশ দেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হয়, তখন তিনি বলেন, ‘যার ইচ্ছা আশুরার রোজা রাখতে পারে, যার ইচ্ছা নাও রাখতে পারে।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) হজরত আবু মূসা আশয়ারি বলেন, ইহুদিরা আশুরার দিনকে খুবই মান্য করত এবং এ দিন উৎসব পালন করত। মহানবী সা: সাহাবিদের বললেন, ‘তোমরা এ দিন রোজা রাখো’। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) হজরত ইবনে আব্বাস রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: যখন আশুরার রোজা রাখেন এবং অন্যদেরকেও রোজা রাখার আদেশ দেন, তখন লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এ দিনটিকে তো ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা সম্মান করে। তিনি বলেন, ‘আগামী বছর ইনশা আল্লাহ আমরা ৯ তারিখেও রোজা রাখব। হজরত ইবনে আব্বাস রা: বলেন, পরবর্তী বছর আগমনের আগে রাসূলুল্লাহ সা: আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। (সহিহ মুসলিম ও আবু দাউদ) রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমরা আশুরার রোজা ইহুদিদের বিপরীত করো। অর্থাৎ তারা এক দিন রোজা রাখে তোমরা রাখ দু’দিন অথবা তিন দিন। হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের জন্য ও পরিবারের জন্য আশুরার দিন অধিক ব্যয় করবে, আল্লাহ সারা বছর তাকে সচ্ছলতা দান করবেন।’ (বায়হাকি) ১০ মহররম পৃথিবীর বড় বড় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
২. রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ : ইতিকাফ অর্থ অবস্থান করা, আটক বা আবদ্ধ রাখা, লেগে থাকা ইত্যাদি। পরিভাষায় আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জামে মসজিদে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। খাদেমে রাসূল হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: প্রতি রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। (তিরমিজি) হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, প্রতি বছর (রমজানে) একবার মহানবী সা:-এর কাছে কুরআন মাজিদ উপস্থাপন করা হতো। যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন সে বছর দু’বার উপস্থাপন করা হয়। তিনি প্রতি বছর ১০ দিন ইতিকাফ করেন; কিন্তু যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন সে বছর ২০ দিন ইতিকাফ করেন (বুখারি) উম্মুল মু’মিনিন হজরত আয়েশা রা: বলেন, মহানবী সা: ওফাত পর্যন্ত রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। তার পরে তাঁর সহধর্মিণীরা ইতিকাফ করতেন। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
৩. আইয়ামে বিজের রোজা : চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখকে আইয়ামে বিজ বলা হয়। বিজ অর্থ উজ্জ্বল বা আলোকিত। এ তিন রাতে চাঁদ উজ্জ্বল থাকার কারণে এ তিন দিনকে আইয়ামে বিজ বলা হয়। এ তিন দিনের রোজায় রয়েছে অনেক ফজিলত। মহানবী সা: এ তিন দিনের রোজা কখনো ভঙ্গ করতেন না। হজরত আবুজার গিফারি রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: আমাদেরকে আইয়ামে বিজ তথা চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখতে আদেশ করেছেন এবং বলেছেন- এটি সারা বছর রোজা রাখার মতো। (নাসায়ি) রাসূলুল্লাহ সা: আব্দুল্লাহ ইবনে আমরকে বলেছেন, প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখা সারা বছর রোজা রাখার মতো, ফলে প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখো। (বুখারি ও মুসলিম) উম্মুল মু’মিনিন হজরত উম্মে সালামা বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: আমাকে প্রতি মাসে তিনটি রোজা রাখতে বলেছেন। (আবু দাউদ, নাসায়ি)
৪. ফজরের আগের দু’রাকাত সুন্নাত : উম্মুল মু’মিনিন হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ফজর সালাতের আগের দু’রাকাত সালাত আমার কাছে সারা পৃথিবীর চেয়ে প্রিয়।’ (আহমাদ, মুসলিম, তিরমিজি) হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘শত্রুদের ঘোড়সওয়ার বাহিনী যদি তোমাদেরকে তাড়া করে, তবুও অর্থাৎ ফজরের দু’রাকাত সুন্নাত ত্যাগ করবে না।’ (আহমাদ, আবু দাউদ, বায়হাকি, তাহাবি) হজরত আয়েশা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: ফজরের সালাতের আগের দু’রাকাত সুন্নাত যতটা গুরুত্ব দিয়ে আদায় করতেন অন্য কোনো সালাত অতটা গুরুত্ব দিয়ে আদায় করতেন না। (বুখারি, মুসলিম, আহমাদ, আবু দাউদ) রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেন, ‘ফজরের দু’রাকাত সুন্নাত পৃথিবী ও পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ অপেক্ষা উত্তম।’ (আহমাদ, মুসলিম, তিরমিজি, নাসায়ি) হজরত আয়েশা রা: বলেন, সব ভালো কাজের মধ্যে ফজরের আগের দু’রাকাত সুন্নাত পড়ার প্রতি রাসূলুল্লাহ সা:-কে সর্বাধিক দ্রুত ধাবিত হতে দেখেছি। (আহমাদ, মুসলিম)
লেখক :
প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী