সূর্য থেকে বিপুল পরিমাণ শক্তি পৃথিবীর দিকে বিকিরণ হওয়ার কারণে গেলো সপ্তাহে যুক্তরাজ্য থেকে ‘অরোরা’ বা নর্দার্ন লাইটস খুব স্পষ্টভাবে চোখে পড়েছে। এমনকি সিলি দ্বীপপুঞ্জের মতো দূর দক্ষিণাঞ্চল থেকেও দেখা মিলেছে নর্দার্ন লাইটসের।
শিক্ষানবীশ থেকে শুরু করে পেশাদার ফটোগ্রাফার- সবাই এই নর্দার্ন লাইটস বা অরোরার ছবি তোলার জন্য সবচেয়ে উপযোগী জায়গার খোঁজে রীতিমতো প্রতিযোগিতা করেছেন।
এদের মধ্যে কয়েক জন বিবিসির সাথে তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন।
গত রোববার সারাদিন জন গ্র্যাভেট বন্ধুদের কাছ থেকে বেশ কয়েকটি বার্তা পেয়েছেন যেখানে তারা বলেছেন যে- ওই রাতে অরোরার ছবি তোলার খুব ভালো সুযোগ আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু তিনি যখন লেক ডিস্ট্রিক্টের কেসউইকের বাড়ি থেকে জানালা দিয়ে তাকালেন তখন মেঘ ছাড়া আর কিছু নজরে আসেনি।
‘রাত প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে আমি সব আশা বাদ দিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো আকাশে তাকিয়ে মেঘের ফাঁকে ছোট একটি গর্তের মতো জায়গায় কয়েকটি তারা ছাড়া কিছু দেখিনি,’ বলেন তিনি।
‘আমি ট্রাইপডে ক্যামেরাটা বসালাম, একটি ছবি তুললাম এবং এটা সবুজ দেখাচ্ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাকে বাইরে বেরুতে হবে।’
এই ৬৫ বছর বয়সী ফটোগ্রাফার, যিনি তার সারা জীবন ছবি তোলায় ব্যয় করেছেন। গাড়ি চালিয়ে বেসেনথওয়েইট লেকের পাড়ে যান। সেখানে তিনি পৌঁছাতে পৌঁছাতে আকাশ পুরো পরিষ্কার হয়ে যায়।
তিনি বর্ণনা করছিলেন এভাবে, বেশিরভাগ মানুষ খালি চোখে রঙের খুব বেশি বৈচিত্র্য দেখতে পারে না। এর পরিপূর্ণ রঙের বর্ণালী দেখার জন্য ছবি তোলাটা জরুরি।
‘ক্যামেরায় প্রথম এক্সপোজারটা নেয়ার পর এটা আমাকে অভিভূত করে দেয়- প্রচণ্ড আশ্চর্য্যজনক,’ বলেন তিনি।
‘এটা চূড়ায় পৌঁছানোর পর মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত প্রায় আধা ঘণ্টার মতো সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি।’
‘ছবিতে যে দাঁড়িয়ে আছে সেটা আসলে আমি,’ তিনি বলেন। ‘আমার মনে হলো যে ছবিতে একজন মানুষ দরকার। আর আশপাশে কোনো কাক-পক্ষীও ছিল না।’
‘এটা আসলেই একটি স্মরণীয় সন্ধ্যা ছিল।’
পেশাদার ফটোগ্রাফার অ্যান্ড্রু ফুসেক পিটার্স বলেছেন যে- তিনি সেই রাতে একটি সৌভাগ্যের আশায় ফেসবুক গ্রুপ ও বিভিন্ন অ্যাপের তথ্যও দেখছিলেন।
তিনি বলেন, ‘এর আগে প্রতিবারই মনে হচ্ছিল যেকোনো সতর্কতা এসেছে, আর মানুষ বলেছে যে, আপনাকে বেরুতে হবে, আমি তখন হয় এটি মিস করেছি বা আবহাওয়া খারাপ ছিল,’ তিনি বলেছিলেন।
কিন্তু রোববার শ্রপশায়ারের উপরে আকাশ পরিষ্কার ছিল এবং তাই তিনি চার্চ স্ট্রেটনের শ্রপশায়ার পাহাড়ের জলাভূমি অংশের লং মাইন্ড এলাকায় তড়িঘরি করে চলে যান।
সেখানে মানুষের ‘উপচে পড়া’ ভীড় ছিল, তিনি বলেন। ‘এটি ব্যস্ত রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের মতো ছিল।’
কিন্তু এই ফটোগ্রাফার, যিনি আট বছর ধরে ওই এলাকায় ন্যাশনাল ট্রাস্টের সাথে কাজ করছিলেন, তিনি জানতেন যে আসলে কোথায় যেতে হবে।
‘জলাভূমির একটি জায়গা ছিল যেখানে পানির সামনের অংশ এবং অরোরা দুটোই একসাথে পাওয়া যেতো, আর আমি চাইছিলাম অরোরা প্রতিফলনটা তুলে আনতে,’ তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন।
‘আর আপনি ছবিটি দেখলেই বুঝতে পারবেন যে আমি সেটা করতে পেরেছি- আর তার চেয়েও আশ্চর্যজনক আমি মনে করি যে হয় আমি একটি খসে পড়া তারার ছবি তুলতে পেরেছি বা এটি লিরিড উল্কা ছিল।
‘অরোরার একটি ছবি পাওয়া, শ্রপশায়ারে, মিডল্যান্ডসে, এটি সত্যি দুর্দান্ত।’
অরোরা সম্পর্কে নিজের ফোনে একটি সংকেত পেয়েছিলেন লরা স্কটও।
স্থানীয় রাগবি ক্লাবে কাজ শেষ করার পর লেক ডিস্ট্রিকের অ্যাম্বলসাইডের ৩৮ বছর বয়সী এই বাসিন্দা গাড়ি চালিয়ে একটি উঁচু জায়গায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
‘আমার যতদূর মনে পড়ে নর্দার্ন লাইটসের ছবি তোলার বিষয়টি আমার তালিকায় অনেক দিন থেকে ছিল,’ তিনি বলেন, কিন্তু তার কাছে শুধু আইফোন ছাড়া আর কোনো ক্যামেরা ছিল না বলেও জানান।
‘আমি কয়েকটি ছবি তোলা শুরু করে এবং তারপর মনে হয় যেন আকাশ ফেটে পড়ছিলো,’ তিনি বলেন।
লরা বলেন, ‘আমার কাছে কোনো ট্রাইপড ছিল না, তাই নিজেকে স্থির রাখতে আমার গাড়ির বনেট ব্যবহার করেছিলাম আমি।’
‘এটা বেশ আবেগঘন ছিল, আমার মনে হয় একপর্যায়ে আমার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বহু বছর ধরে আমি এই ছবি তোলার চেষ্টা করে আসছি।’
অরোরা শিকারীদের কাছে যারা রোববার তথ্য পাঠাচ্ছিলেন তাদের মধ্যে একজন জেমস রওলি-হিল।
নরফোকের হ্যাপিসবার্গের রাতের আকাশের ছবি তোলা উৎসুক এই ফটোগ্রাফার ও ৪৮ বছর বয়সী গ্যারেজের মালিক যৌথভাবে এইউকে-অরোরা ইউকে নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ পরিচালনা করেন- যার সদস্য সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি।
রোববার অরোরা ঝড়ের সম্ভাবনা ছিল ‘কিন্তু যা ঘটেছে তা আসলে অবর্ণনীয়,’ তিনি বলেন।
স্কটল্যান্ডের কিছু অংশ, উত্তর ইংল্যান্ড এবং নরফোকে এই আলো দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তিনি বলছিলেন, কিন্তু যখন এটি শুরু হয় তা আসলে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।’
দুর্ভাগ্যবশত, নরফোক মেঘাচ্ছন্ন থাকায় তিনি এটি দেখতে পাবেন না বলে ধারণা ছিল।
‘আমি পুরো ইউরোপ জুড়ে সরাসরি সম্প্রচারিত ক্যামেরায় নজর রাখছিলাম এবং আমার অনুসারীদের নিয়ে টুইটারে ছিলাম যারা আদমাকে ছবি পাঠাচ্ছিল।’
‘এটা ছিল সেই পাগল করা মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটি যখন আমার মনে হলো যে, কোনোভাবেই এটা এতোটা ভালো হতে পারে না।’
রওলি-হিলের কাজে যারা কৃতজ্ঞ ছিলেন তাদের মধ্যে একজন জনো কিম্বার যিন শ্রপশায়ারের এলিসমেয়ারের মেয়ারে এই আলোর ছবি তুলেছিলেন।
‘আমার সফলতা এসেছে সেই সব অরোরা অনুসারী আর ভক্তদের মাধ্যমে যারা এই গ্রুপটি পরিচালনা করে এবং তারা আমাকে কখন সবচেয়ে ভালো সুযোগটি পাওয়া যাবে তা বরে করার সরঞ্জাম দেয়,’ তিনি বলেন।
‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাইরে বের হয়ে হতাশ হতে হয়,’ তিনি বলেন, কিন্তু রোববার রাতেও তিনি বাইরে বের হয়েছিলেন।
‘আমি আপনার মতোই আকাশের দিকে তাকালাম এবং কিছু আঁকাবাঁকা রেখা দেখতে পেলাম। আমার মনে হলো এতোক্ষণ আমি ফোনে তাকিয়ে থাকার কারণেই কি এরকম দেখছি?’
ক্যামেরায় যখন আমি ছয় সেকেন্ডের একটি এক্সপোজার নিলাম, ‘সফল, এটা আসলেই সেখানে ছিল,’ তিনি বলেন।
‘এটা ছিল উজ্জ্বল গোলাপী রঙের, আলোর রশ্মি এবং আমার মনে হলো বাহ, আক্ষরিক অর্থেই একেবারে কোনো কিছু না থাকার মতো অবস্থা থেকে এক মিনিটের পূর্ণ আলোক রশ্মি, যা এটিকে বলা হয়।’
প্রযুক্তি এবং সোশ্যাল মিডিয়া আসলেই এটি কখন ঘটবে এবং দেখা যাবে তা নির্ণয় করার সুযোগ বাড়িয়েছে, তিনি বলেন।
‘আমি প্রচণ্ড রোমাঞ্চিত ছিলাম এবং আমি জেমসকে বার্তা পাঠিয়েছি, আর সে আমাকে বললো যে, ‘নিয়ে এসো!’ সে আসলেই সবার সাফল্য উদযাপন করছিল।’
সূত্র : বিবিসি