গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন কী বার্তা দিয়ে গেল, সেটা আমাদের নির্বাচন কমিশন (ইসি) বুঝতে পারলেও তা প্রকাশ করার হিম্মৎ হয়তো তার ছিল না। তবে এ নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল স্ফটিক স্বচ্ছ। সে জন্য অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য পাশ্চাত্য যে চাপ তাপ তৈরি করেছে জনগণ সেটিকে ইতিবাচক, গ্রহণযোগ্য হিসাবে স্বাগত জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য যে নতুন ভিসানীতি প্রকাশ করেছে, তার জাদুতেই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ‘জাদুকরি’ ফলাফল হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেই নীতির ‘ধাক’ ও ব্যাপ্তি এতটাই বেশি যে, সেটা ধন্বন্তরি ওষুধের মতোই কাজ করেছে। এমন এক অন্তঃপুরবাসিনী বয়োবৃদ্ধ নারী, মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন যিনি শুধু গৃহকর্মের হয়তো জাদুকর ছিলেন। কিন্তু রাজনীতিতে এসে তুরুপের তাস ফেলে রাজনৈতিক অঙ্গনের একজন ‘সিজেন পলিটিশিয়ান’কে কুপোকাৎ করতে পেরেছেন। এটা যে সম্ভব কেউ ভাবতেও পারেনি। আসল কথা হচ্ছে, মার্কিনিদের কঠিন চাপে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা উপরের নির্দেশেই নির্বাচনের দিনে ভোট দানের পরিবেশ খুব একটা বিঘ্নিত করার সাহস পায়নি। সে জন্য ভোটারদের ঢল না নামলেও, দলে দলে অসংখ্য নারী-পুরুষ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে শান্তিতে ভোট দিতে পেরেছেন। এক নির্বাচন কমিশনারের দাবি ৫০ শতাংশের বেশি ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে এসেছিলেন। এখানে প্রাসঙ্গিক কারণে একটা বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে।
অতি সম্প্রতি জাতীয় সংসদের একটি উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে মাত্র ১৫ শতাংশ ভোট কাস্ট দেখানো হয়েছে। কিন্তু অনেকের দাবি এ সংখ্যা আরো কম হবে। এর পেছনের কারণটা কিন্তু সেই উপনির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সরকারি দলের ‘বিজয়ী’ প্রার্থীর কর্মীবাহিনী প্রতিপক্ষ দুই প্রার্থী অত্যন্ত জোরালো কণ্ঠে এই অভিযোগ করেছিলেন। সরকারি দলের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের হুমকি ধমকি দিয়ে এসেছে। তারা বলেছে কারো ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই। এই হুমকির খবর ইসি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জেনেও অজ্ঞাত কারণে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সে কারণে প্রতিপক্ষের প্রার্থীরা নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা বলেছেন, এই ইসির গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার কোনো সক্ষমতা নেই। এটাই সত্য।
এখন একটু পেছনে ফিরে গাজীপুরের অনুষ্ঠিত নির্বাচনের বিষয় নিয়ে সামান্য কিছু বিষয়ে নজর দেয়া যেতে পারে, যা নীরবে একটা ভোটবিপ্লব হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। সাংবাদিকরা বহু কেন্দ্র ঘুরেফিরে দেখেছেন, খুব কমসংখ্যক ভোটকেন্দ্রেই জায়েদা খাতুনের পোলিং এজেন্টদের দেখা গেছে। অথচ জনগণ স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে ঘড়ি প্রতীকের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ফলে নির্বাচিত মেয়র জায়েদা ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের বিপুল ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন। জায়েদার পেছনে সর্বক্ষণ ছায়ার মতো ছিলেন তার পুত্র জাহাঙ্গীর। যিনি সম্প্রতি আওয়ামী লীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কৃত হয়েছেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে জায়েদা বাংলাদেশের দ্বিতীয় মহিলা যিনি এবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তার আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম মহিলা মেয়র হয়েছিলেন আইভি রহমান।
আসলে গাজীপুরে যে অবাক করার মতো ঘটনা ঘটেছে। সেখানে ইসি ও অন্য কোনো বাহিনীর কিছুমাত্র কারিসমা ছিল না। গ্রাম্য এক প্রবাদ আছে ‘ঠেলার নাম জসমত আলী মোল্লা।’ হ্যাঁ সেই মোল্লার ঠেলাই গাজীপুরে মানুষ ম্যাজিক দেখিয়েছেন।
তবে একটা কথা মনে অবশ্যই রাখতে হবে, মাত্র এক জায়গার নির্বাচনে ‘মোল্লা মিয়ার’ ‘ঠেলা’ কাজ করেছে বটে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনে যখন নির্বাচন হবে তখন কিন্তু শুধু মোল্লায় কাজ হবে না। সেখানে মূল কেন্দ্রে এমন কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বে থাকতে হবে যাদের হুকুম, আহকাম, গর্জন, রক্তচক্ষু ৩০০ আসনেই তখন জসমত আলী মোল্লার মতো এক একটি স্থানীয় মোল্লাদের ভূমিকা পালন করতে পারে। তাহলেই কেবল জনগণ যে ধরনের নির্বাচন আকাক্সক্ষা করে তেমন সুষ্ঠু অবাধ স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে। দলীয় কোনো সরকারের অধীনে নয়, বরং নির্বাচনকালীন একটা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোট হলেই সেটি সম্ভব হতে পারে। ঋজু ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারই শুধু নিরপেক্ষ নির্মোহ ও নির্বিকারভাবে একটি সুষ্ঠু এবং সব মহলে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করাতে সক্ষম হবে। অন্যথায় কিছু হবে না।
আমরা একটা কথার ওপরে জোর দিয়েছি। সেটি হলো দ্রæত একটি নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার প্রযোজনীয়তা। এখন এ নিয়ে জরুরি ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। সেটা যে কতটা জরুরি দেশে বিরাজমান পরিস্থিতিই তা প্রমাণ করছে। সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষের যেসব কর্মসূচি এখন মাঠে গড়াচ্ছে, তাকে ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করার যাবতীয় ব্যবস্থা কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেক বিধিব্যবস্থার কথা শোনা গেলেও রাজনৈতিক প্রশাসন, আমলা, পুলিশ প্রশাসন সব নীতিনৈতিকতা, গণতান্ত্রিক চেতনা দূরে ছুঁড়ে ফেলে যেভাবে স্বৈরনীতি প্রতিষ্ঠার আয়োজন করছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এমনো দেখা যেতে পারে, রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতাসীনদের সরব কোনো প্রতিপক্ষকেরই অস্তিত্ব আর থাকবে না। তখন তাদের সব খেলাই বিনা বাধায় এগিয়ে যাবে। তাই সময় শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই সব ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণ জনগণ ও সচেতন মানুষ সেটা গভীরভাবে অনুভব করছে। কথায় আছে না, ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ।’
বর্তমান ইসির দ্বিচারিক ভূমিকা জনগণ বার বার এটা দেখেছে। একেবারে হালের একটা উদাহরণ এখানে পেশ করলে তাদের দ্বিচারিতার সর্বশেষ সংস্করণ দেখা যাবে। মাত্র কিছু দিন আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বেশ দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, সরকারের আন্তরিক কোনো ভ‚মিকা ব্যতিরেকে ভালো নির্বাচন করা অসম্ভব। এ কথার রেশ কাটতে না কাটতেই খবর বেরিয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ‘ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালায়’ পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। তাতে বলা আছে, ভোটকেন্দ্র কোন প্রতিষ্ঠানে হবে তা নির্ধারণের ক্ষমতা রাজনীতিক ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে দেয়া হচ্ছে। এখানে অবাক হবার মতো ব্যাপার, নির্বাচন কমিশনের কোনো ভ‚মিকা সেখানে থাকবে না। একই সঙ্গে আগের নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র বহাল রাখার যে বাধ্যবাধকতা সেটা তুলে দেয়া হচ্ছে। ওই সব বিধান মুক্ত করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং ব্যবস্থাপনা নীতিমালার খসড়াটির অনুমতি ইসির একটি কমিটি ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই নয়া নীতি কেন হলো, কারা সেটা চেয়েছে। এমন নীতিমালা কিন্তু নির্দোষ বলে কেউই মনে করছেন না। এটা আসলে কার স্বার্থে হচ্ছে। এ নিয়ে মুক্ত আলোচনা, প্রশ্ন তোলা দরকার। হতেও তো পারে এটা বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই হচ্ছে। সবাই তো জানেন রাজনীতিক প্রশাসন সাধারণ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে অতীতে দেখা গেছে সবাই বিগত বছরগুলোতে কোনোভাবে কোনো পর্যায়েই কতটুকু ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকা পালন করে।
আগেই উল্লেখ করে এসেছি এই নয়া পদক্ষেপ নিয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এত দিন ধরে যা ইসি নির্ধারণ করে এসেছে হঠাৎ করে তাতে কেন এই পরিবর্তন অপরিহার্য হলো। আজকে দেশের এমন এক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যখন সর্বত্রই একটা সংশয়-দ্বিধা সৃষ্টি হয়েছে। এমন একটা রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণের দায়িত্বে রাজনীতিক পুলিশ ও প্রশাসনকে নিযুক্ত করা হলো কেন। এমন সংযুক্তির কারণে জনগণের মধ্যে সন্দেহের বীজ বপন করা হয়ে গেছে। এখানে আরো একটা কথা স্মরণ করা যেতে পারে, এই নয়া নীতিতে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যাও কমানো হবে। কিন্তু গত সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে আসন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবধান পাঁচ বছরের বেশি হবে। এ সময় জনসংখ্যা বেড়েছে কিন্তু ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা কমানোটা একটা বৈপরিত্বের বিষয় নয় কি!
এখনো নির্বাচনের ৬ মাসের চেয়ে বেশি সময় বাকি। এই বাকি সময়টুকুতে আর কত যে ঝড়ের নাচন দেখা যাবে সেটা কি অনুমান-অনুধাবন করা যায় না। যদি এবারও জাতি ‘ট্রেন মিস’ করে তবে কোন গহ্বরের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে সবাইকে দাঁড়াতে হবে সেটা কেউ এই মুহূর্তে কল্পনাও করতে পারবে না। আমাদের সুহৃদ সুজন যতটুকু করেছেন। তার চেয়ে আর বেশি কী করবেন। বাকি ১৬ আনার অবশিষ্ট ৬ আনা রাজনৈতিক নেতাকর্মী-সমর্থকদেরই করতে হবে। তীরে এসে তরী যাতে না ডোবে তার সে জন্য মাঝিমাল্লাকে সতর্ক থাকতে হবে।