কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ব্রিটেনে শনিবার পর্যন্ত মারা গেছে দুইজন। পাশাপাশি করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশটিতে চিকিৎসা নিচ্ছে প্রায় ২০৬ জন। এদিকে করোনায় আক্রান্ত ও মারা যাওয়ার ঘটনায় ব্রিটেনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাব : করোনাভাইরাসের ভয়ে ব্রিটেনের অনেক মানুষ সামাজিক কিছু সৌজন্যতা বন্ধ করে দিয়েছে। ব্রিটেনের মানুষের কাছে স্বাভাবিক সৌজন্যতা হচ্ছে ঘনিষ্ঠ কারো সাথে দেখা হলে হ্যান্ড শেইকের পরপরই গালে গাল লাগিয়ে হৃদ্যতা প্রকাশ করা। যদিও মুসলিমসহ কিছু ধর্মের মানুষ তা করে না। কিন্তু করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খবরে ব্রিটেনের মানুষ এখন পারস্পরিক হ্যান্ড শেইক কমিয়ে দিয়েছে।
ঘনিষ্ঠজনদের সাথে গালে গাল লাগিয়ে হৃদ্যতা প্রকাশ বন্ধ দিয়েছে। সরকারও ঘোষণা দিয়েছে কোভিড-১৯ করোনা থেকে সতর্ক থাকতে পারস্পরিক চুমু বিনিময় না করা। এ বিষয়ে ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক লর্ড রবার্ট উইনস্টন বলেন, অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক চুমু ভাল তবে বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে পারস্পরিক চুমু ভয়ংকর। কভিড-১৯ থেকে বাঁচতে আমাদের অনুধাবন করতে হবে, নিজেদের চোঁখ, মুখ ও নাক যতকম সম্ভব স্পর্শ করা। একই সাথে অন্য মানুষের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলা।
কফিশপগুলো ব্রিটেনের মানুষের কাছে আড্ডার জন্য প্রিয় জায়গা। সারাদেশে জনপ্রিয় কফিশপ স্টারবাকস তাদের পুনরায় ব্যবহার করা প্লাস্টিকের কাপগুলো ব্যবহার করা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে করোনার ভয়ে। ব্রিটেনের অধিকাংশ মানুষের কাছে ফুটবল খেলা একটি ধ্যান ও জ্ঞানের মতো। করোনা আতঙ্কে ব্রিটেনের প্রিমিয়ার লীগের প্রায় ৭০টি খেলা বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
এদিকে রাজধানী লন্ডনের ব্যস্ততম এলাকা অক্সফোর্ড স্ট্রিটে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের এক বিদেশী শিক্ষার্থী কেনাকাটা করতে গেলে কয়েকজন যুবক তাকে অতর্কিত কিলঘুসি মেরে তাকে রক্তাক্ত করে। এসময় যুবকরা তাকে বলতে থাকে,‘আমি তোমার করোনা ভাইরাস আমার দেশে চাই না’। পুলিশ এই ঘটনাকে বর্ণবাদী আচরণ হিসেবে গণ্য করে আক্রমনকারী তিন যুবকের মধ্যে দু’জনকে আটক করেছে।
ব্রিটেনের অনেক স্থানে এক বাড়িতে বিভিন্ন রুমে কয়েকজন মানুষ রান্নাঘর ও টয়লেট শেয়ার করে বাস করে। করোনা আক্রান্তের ভয়ে সেসব বাড়ির কেউ হালকা কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হলে বাড়ির অন্যরা সাময়িকভাবে অন্য বাড়িতে গিয়ে বাস করার খবর পাওয়া গেছে। অনেক অভিভাবক তাদের ছেলে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বিশেষ করে ইতালীতে করোনাভাইরাসে মৃতের খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে ব্রিটেনের স্কুলগুলোতে এর প্রভাব পড়ে। কারণ ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ব্রিটেনের স্কুলগুলোতে এক সপ্তাহ ছুটি থাকায় অনেকে ছুটি কাটাতে ইতালী গিয়েছিলেন। তাদের মাধ্যমে করোনা ব্রিটেনে ছড়াতে পারে এই আতঙ্কে অনেক অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব: ব্রিটেনে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ঘটেছে গত সপ্তহে। এ পরিস্থিতিতে পার্লামেন্ট অধিবেশন বন্ধ রাখা হবে কি না সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। এভাবে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে থাকলে বড় ধরনের সমাবেশে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বিবেচনা করছে সরকার। এর মধ্যে সংসদ অধিবেশন বন্ধ করার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
সেন্ট্রাল লন্ডনের ব্যস্ততম ওয়েস্টমিনিস্টারে অবস্থিত পার্লামেন্টে প্রতি সপ্তাহে কয়েক শ’ এমপি ও লর্ডস সমবেত হন। এই পার্লামেন্ট ঘিরে চাকরি করে প্রায় ৩ হাজার মানুষ। এছাড়া ব্রেক্সিটকে ঘিরে আলোচনার জন্য জরুরী বিষয়ে অধিবেশনও দরকার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের। এমনই পরিস্থিতিতে কি করা দরকার সে বিষয়ে আলোচনা করছে পার্লামেন্টের স্পিকার স্যার লিন্ডসে হোয়লি এবং সরকারের চিফ মেডিক্যাল অফিসার প্রফেসর ক্রিস হোইটি। তারা উভয়ই হাউস অব কমন্স ও হাউস অব লর্ডসের ডিরেক্টর জেনারেলদের সাথে আলোচনা করে ওই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট শুধু ব্রিটেনের আইনসভা নয়, সারাবিশ্বের লাখ লাখ মানুষ সেখানে পর্যটনের উদ্দেশ্যে যায়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র জানান, পার্লামেন্ট স্থগিতের দিদ্ধান্ত শুধু প্রধানমন্ত্রী বা স্পিকারের নয়। পার্লামেন্টের কর্তৃপক্ষ, বিজ্ঞানী ও মেডিক্যাল অফিসাররা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে সরকারি ও বিরোধী দলীয় কয়েকজন এমপি বিশ্বাস করেন পার্লামেন্ট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হবে অনভিজ্ঞ সিদ্ধান্ত। আর সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন করা খুব সহজ হবে না। অন্যদিকে কয়েকজন এমপির মত হচ্ছে পার্লামেন্ট স্থগিত হলেও ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে এমপিদের সাথে যোগাযোগ করে পার্লামেন্টের কাজ চালু রাখা দরকার। কারণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি রয়েছে ইস্টার হলিডের পরে।
জানা গেছে, এপ্রিল মাসে ইস্টার-এর ছুটির পরে এই ‘শাটডাউন’ শুরু হবে। এরপরে সেপ্টেম্বরে আবারো পার্লামেন্ট খুলে দেয়া হবে। এটি হবে ১৯১৪ সালের পর থেকে দীর্ঘতম স্থগিতাদেশ। তবে লেবার দলের এমপি ক্রিস ব্রায়ান্ট এ ধরনের পরিকল্পনার বিষয়কে নাকচ করে দিয়েছেন। এটিকে তিনি ‘বাজে কথা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব : কোভিড-১৯ বা করোনার আতঙ্কে ব্রিটেনের মানুষ নানা পন্য কিনে মজুত শুরু করছে। এসবের মধ্যে প্রধানত রয়েছে হ্যান্ড সেনিটাইজার ও মাস্ক। প্রতিটি সুপারশপসহ লোকাল শপগুলোতে এসব পন্য পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে সেনিটাইজারের বিকল্প হিসেবে সাবান কিনে রাখছে। এছাড়া অনেকে টিস্যু পেপার কিনেও মজুত করছে। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী ওসব পন্য কিনে মজুত করে বেশি দামে বিক্রি করছে। আবার অনেক মানুষ আতঙ্কে শুকনো খাবার কিনে বাসায় রাখছে।
প্রায় ২ হাজার দোকানের উপর জরিপ চালিয়ে দেখা দেখা গেছে, ক্রেতাদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন আতঙ্কে বাসায় খাবার মজুত করছে। আর তিন জনের মধ্যে একজন আক্রান্ত হলে কিভাবে খাবার কিনবে এই ভয়ে বাসায় খাবার রাখছে। লাখ লাখ মানুষ এভাবে খাবার কিনে রাখায় এর প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। বর্তমানে আতঙ্ক যতটা না ভাইরাস আক্রান্ত নিয়ে, তার চেয়েও ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে খাবার মজুদে।
সরেজমিন দেখা গেছে, বিভিন্ন শহরের বেশিরভাগ সুপারশপের সেলফ প্রায় খালি হয়ে গেছে। রাজধানী লন্ডনের প্রাণকেন্দ্র সেন্ট্রাল লন্ডনে এখন তেমন জমজমাট নেই। আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনগুলোতেও কম ভীড় পরিলক্ষিত হচ্ছে। গত সপ্তাহে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেক শপিংমল ঘুরে ক্রেতার তেমন সমাবেশ দেখা যায়নি। নিত্যদিনের ব্যস্ততাও চোখে পড়েনি। তবে কিছু কিছু বড় সুপারশপে ছিল ক্রেতাদের হুড়োহুড়ি। এসব ক্রেতার অধিকাংশই এসেছেন ভবিষ্যতের খাবার সংগ্রহে। অজানা আতঙ্কে আপৎকালীন খাবার সংগ্রহই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এসব ক্রেতার আকর্ষণ ছিল ড্রাই ফুডের পাশাপাশি ক্যান ফুডের প্রতিও। কারও পানির চাহিদা পাঁচ কেস কিন্তু শপ কর্তৃপক্ষ সরবরাহ দিতে পারছে না। এক্ষেত্রে তারা দিচ্ছেন মাত্র জনপ্রতি এক কেস। অস্বাভাবিক চাহিদার কারণে বোতলজাত পানির কোটাও নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে কোথাও কোথাও। অবশ্য অন্য খাবার এভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না।
খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ নাগালের বাইরে না গেলেও হাত জীবাণুমুক্তকরণ স্যানিটাইজার সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। লন্ডন, ম্যানচেস্টার, বার্মিংহাম, ইয়র্ক, লিডস, ব্রাইটন, সারে, কেন্টসহ অনেক জায়গায় ফোন করে জানা গেছে কোথাও আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার পাওয়া যাচ্ছে না। অনলাইন কেনাকাটার ওয়েবসাইট আমাজন ও ইবেতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি হচ্ছে স্বাভাবিক দামের চেয়ে কয়েকগুন বেশি। স্কাই নিউজের এক রিপোর্টে দেখা যায়, ৭০ পেন্সের হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইবেতে বিক্রি হচ্ছে ১৩ থেকে ১৭ পাউন্ডে। আর আমাজনে ১.৮০ থেকে ২.২০ পাউন্ডের হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি হচ্ছে ৯৮ থেকে ১২০ পাউন্ডে। অতিরিক্ত দামে অনলাইনে বিক্রি করার কারণে পুলিশ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
এদিকে ব্রিটিশ রিটেইল কনসোর্টিয়াম (বিআরসি) জানিয়েছে, করোনার কারণে মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ব্রিটেনের সুপারশপগুলোতে প্রয়োজনীয় দ্রব্য রয়েছে। স্থানীয় কোনো কোনো দোকানে কিছু পণ্য না পাওয়া গেলেও এতে আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দিয়েছে বিআরসি’র ডিরেক্টর এন্ডু অপি। তিনি বলেছেন, মানুষ আতঙ্কিত হয়ে কেনাকাটার কারণে সাময়িক কিছু পণ্যের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে।