সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। সেটা দিতে রাজি হলেই তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারেন। সেন্টমার্টিন নিয়ে কেন এই কাহিনী? এর ক’দিন আগে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বাংলাদেশে জল্পনা চলে যে, মোদি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে কথা বলবেন। সফরকালে প্রথমবারের মতো হোয়াইট হাউজে প্রবেশ করেন নরেন্দ্র মোদি। লাল গালিচার অন্যপ্রান্তে তখন অপেক্ষায় বিশ্বের এক নম্বর ক্ষমতাধর ব্যক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
হোয়াইট হাউজে প্রবেশের পর নিরাপত্তাকর্মী গাড়ির দরজা খুলে দিলে ধীরপায়ে মৃদু হাসিমাখা মুখে মোদি নামেন। কয়েক কদম এগিয়ে বাইডেন জড়িয়ে ধরেন মোদিকে। এমন দৃশ্য ভারতের ৭৫ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম। বিশেষ আমন্ত্রণে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক প্রটোকল নিয়ে ২১-২২ জুন, আমেরিকায় দু’দিনের রাষ্ট্রীয় সফর এভাবেই শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। ইতিহাসে এটাও প্রথম যে আমেরিকায় বসবাসরত কয়েক শ’ ভারতীয় আমেরিকানের জন্য সেদিন হোয়াইট হাউজের প্রধান ফটক খুলে দেয়া হলো। তারা সবাই লনে দাঁড়িয়ে গেলে একটু পরেই বাইডেন-মোদি বেরিয়ে এসে দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার জন্য ভারতীয় আমেরিকানদের বিশাল অবদানের কথা উল্লেখ করে সবাইকে ধন্যবাদ জানান। ২২ জুন বিকেলে মোদি কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেন। আমেরিকার ইতিহাসে আর মাত্র দু’জন নেতা কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে দু’বার ভাষণ দেয়ার সুযোগ পেয়েছেন। প্রথমজন চার্চিল, দ্বিতীয়জন নেলসন ম্যান্ডেলা। এই কাতারে তৃতীয়জন হলেন মোদি।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ জনসংখ্যার দেশ ভারতের জন্য অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র বিচ্ছিন্নবাদের হুমকি থেকে মুক্ত থাকা সবচেয়ে বড় বাধ্যবাধকতা। তাই আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নীতিনির্ধারণে এই বাধ্যবাধকতার ব্যত্যয় ঘটতে পারে এমন যা কিছু হোক, তার বিরুদ্ধে যাওয়া তার জন্য অপরিহার্য। বিগত দিনের লিগ্যাসির ভয়াবহতা সবারই মনে আছে। সুতরাং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের জাতীয় স্বার্থের যেকোনো ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায়নাকে ঘিরে তার নিজের বৃহত্তর স্বার্থেই ভারতের শঙ্কাকে প্রাধান্য দেবে, এটাই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক ভাবনা। চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নীতির কূটনীতিতে ভারত নিজের স্বার্থে একতরফা ও একমুখী নীতিতে যাবে না, তা মোদির বার্তায় স্পষ্ট।
অনেক দ্বন্দ্ব ও মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ২০২২ সালে এসে ভারত-চীনের বাণিজ্য এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ ১২৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। মিয়ানমারে চীন-ভারত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করেছে। তাইওয়ানকে ঘিরে চীন-আমেরিকার দ্ব›দ্ব সাময়িক হলেও থেমেছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মার্কিন সফর নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে গেছে ভারতে-বাংলাদেশে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, এবার মোদির মার্কিন সফরে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হলো? আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও মানবাধিকার প্রশ্নে চাপ দিচ্ছে। সম্প্রতি মার্কিন প্রশাসন যেভাবে বাংলাদেশের ওপর চাপ দিচ্ছে, কেউ কেউ বলছেন, এ বিষয়ে আলোচনা করার প্রশ্নই ওঠে না। বাইডেনের সাথে বাংলাদেশ নিয়ে মোদি আলোচনা করতে যাবেন কেন? আবার অনেকে বলছেন, না, বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। আসল সত্যটা কী? নরেন্দ্র মোদির এবারের মার্কিন সফর অতীতের সফরগুলোর চেয়ে অনেক দিক থেকে আলাদা।
কূটনীতির একটি নিজস্ব ধারাবাহিকতাও থাকে। অর্থাৎ সেটি বুশ, ওবামা, ক্লিনটন, ট্রাম্প থেকে বাইডেন, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। জওয়াহেরলাল নেহরু থেকে মোদি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের সম্পর্কের অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। বাইডেন ও মোদির যখন বৈঠক পাড়ার চায়ের আড্ডা নয় যে মোদি ফস করে বাংলাদেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন।
একটি উদাহরণ দিই, ধরুন, মোদি বাইডেনের সাথে দেখা করতে যাওয়ার আগে দিল্লিতে এসেছিলেন। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। তার সাথে অজিত দোভাল বৈঠক করেন, যেটা প্রধানমন্ত্রী স্তরে বা হেড অব দ্য স্টেটের স্তরে হয় না, কিন্তু এনএসের স্তরে সে কথাটি বলা যায়, সেখানে অজিত দোভাল বলেছেন, বাংলাদেশ নিয়ে আমেরিকা যেন এমন কিছু না করে, যাতে ভারতের সার্বভৌম স্বার্থে ব্যত্যয় ঘটে। কেন ভারত বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন করছে? কারণ এর সাথে ভারতের স্বার্থ জড়িত। আমরা এটাকে বলি, আন্ডারস্টুড ডিপ্লোম্যাসি। অর্থাৎ বুঝে নিতে হয়।
চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত ও ভূ-কৌশলগত দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাত আছে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা করাটাই তো স্বাভাবিক ঘটনা। আজকে চীন যদি মিয়ানমারে ড্রাগনের নিঃশ্বাস ফেলে, মিয়ানমার-চীন সম্পর্কের জন্য যদি ভারতের অসুবিধা হয় এবং এর ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা ভারতের অস্বস্তির কারণ হয়, তাহলে সেটি কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে না জানানোরও কোনো কারণ নেই। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দুনিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র, যার সাথে চীনের সরাসরি কূটনৈতিক রাষ্ট্রীয় আদর্শের সঙ্ঘাত আছে।
তাই চীনের মোকাবেলায় ভারতকে সাথে রাখা আমেরিকার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। এখানে একটি জিনিস মনে রাখতে হবে, এবার বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে দু’টি তথ্য দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। প্রথমত, বিশদভাবে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থের জন্য ভূমিকা রাখতে দ্বিধা করবে না। আর দ্বিতীয়ত, স্বার্থগুলো যখন এই অঞ্চলের সাথে সম্পৃক্ত, তখন ভারত সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার। ওয়াশিংটন ডিসিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে এই তথ্য জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের মুখ্য উপমুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল।
সন্ত্রাসবাদ আর সেই সাথে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে যৌথ বিবৃতিতে সামান্য উল্লেখ আছে। এতে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া, ইন্দো-প্যাসিফিক, পূর্ব এশিয়াসহ আঞ্চলিক বিষয়গুলোতে দুই সরকারের মধ্যে চলমান গভীর, গতিশীল পরামর্শ অনুষ্ঠানকে উভয় নেতা স্বাগত জানান এবং ২০২৩ সালে অনুষ্ঠেয় ইন্ডিয়ান ওশেন ডায়ালগের উদ্বোধনী অধিবেশন নিয়ে ভারত-আমেরিকা আগ্রহ প্রকাশ করে।
দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে অনেক বেশি বিবৃত হয়েছে যৌথ বিবৃতিতে। প্রত্যাশিতভাবেই তাতে প্রচ্ছন্ন চীনবিরোধিতার নিদর্শন আছে বেশ। চীনের সাথে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের চলমান বৈরী সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্য এতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন আবারো রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত এই দ্বীপ ইজারা (লিজ) দিলে আগামীতে ক্ষমতায় থাকাটা নির্বিঘ্ন হয়; ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য আসার পর এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি হয়। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে দ্বীপ নিয়ে এমন বিতর্ক নতুন নয়। স্বাধীনতার আগে পরে বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা সৃষ্টির নজির রয়েছে। এর মধ্যে অতীতে এ ধরনের বিতর্কে টেনে আনা হতো ভোলার মনপুরা দ্বীপকে। পরে সে জায়গায় আসে সেন্টমার্টিন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে নিতে চায় এবং বিএনপি দ্বীপটি ‘বিক্রির মুচলেকা’ দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়-ক্ষমতাসীন দল ও তার জোটসঙ্গীরা কিছু দিন ধরে এমন অভিযোগ করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন, এটি ঠিক নয়। সেন্টমার্টিন দ্বীপ নেয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কখনো কোনো আলোচনা করেনি। আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপ বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। পর্যটন করপোরেশনের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য বলছে, দ্বীপটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমারের উপক‚ল থেকে আট কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত এটি প্রবাল দ্বীপ যা সামরিক ঘাঁটির উপযুক্ত নয়।
দ্বীপটি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক যে অনেক আগে থেকেই হচ্ছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৮০ সালের ১৮ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিবৃতিতে; যার শিরোনাম ছিল, ‘সেন্টমার্টিন দ্বীপে কাউকে নৌঘাঁটি করতে দেয়া হবে না।’ ওই বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, একটি নির্দিষ্ট দেশকে সেন্টমার্টিনে নৌঘাঁটি করতে দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে বলে কয়েকটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল যে অভিযোগ করেছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
২০২৩ সালে এসে রাজনীতিতে সেন্টমার্টিনের বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আনেন জাতীয় সংসদে দেশের একজন প্রবীণ সংসদ সদস্য। সাবেক চীনপন্থী রাজনৈতিক ওই সংসদ সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কারণে অকারণে সমালোচনা না করলে তাদের পেটের ভাত হজম হয় না।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকলেও রাজনীতিতে এটি আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে মনপুরা বা সেন্টমার্টিন দ্বীপ দিয়ে দেয়া, ভারতকে সুবিধা দেয়া- এ রকম ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করা এ দেশে পুরনো রাজনৈতিক কৌশল। অতীতে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যে এই চর্চা বেশি ছিল। এখনো তারা সেই অভ্যাস ত্যাগ করেনি।
লেখক : নব্বইয়ের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা