তাঁর জীবনই সর্বোৎকৃষ্ট পূর্ণাঙ্গ জীবন। আল্লাহ তায়ালা নিজ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে মুহাম্মাদ সা:-কে শেষনবী ও কিয়ামত পর্যন্ত আগত সব মানুষের জন্য আদর্শ হিসেবে মনোনীত করেছেন। তাঁকে বানিয়েছেন সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। তাঁর জীবন ছিল এমন এক জীবন যা সরাসরি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ তত্ত্বাবধানে গড়ে তুলেছেন। তাই এমন বরকতময় জীবনের সাথে আমাদের পরিচয় হওয়া আবশ্যক। যেন তাঁর আদর্শ গ্রহণই হয় মানবজীবনের মুক্তির পথ।
তার জীবনাদর্শে রয়েছে মানবজাতির জন্য মহাশিক্ষা ও উপদেশ। চাই তা ঈমান ও আকিদা বিষয়ে হোক, বা আখলাক ও চারিত্রিক কোনো বিষয়ে হোক কিংবা ব্যক্তি, পরিবার বা দেশ ও জনগণের সাথে সম্পর্কিত কোনো বিষয়ে হোক। মানুষের জীবনে কল্যাণকর এমন কোনো বিষয় নেই যাতে মহানবী সা:-এর দিকনির্দেশনা নেই। তাঁর জীবনের প্রতিটি পর্বই উম্মতের জন্য আদর্শ। যুবক হিসেবে তিনি আদর্শ যুবক, স্বামী হিসেবে তিনি আদর্শ স্বামী, বন্ধু হিসেবে তিনি ছিলেন আদর্শ বন্ধু, শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন আদর্শ শিক্ষক, শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শাসক।
আমদের সামনে পৃথিবীর অনেক সফল ও আদর্শিক মানুষের জীবনী আছে। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এবং শত শত রচনায় শত শত সফল মানুষের জীবনী ও আত্মজীবনী আমরা পাঠ করি। সেখানে শুধু আমরা তাদের জীবনের বিশেষ উল্লেখেযোগ্য কিছু দিকের আলোচনা পাই। তিনি মানুষের জন্য কী করেছেন, দেশের জন্য কী করেছেন, তিনি কোনো একটি বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন, অথবা তিনি কোনো একটি থিওরি আবিষ্কার করেছেন ইত্যাদি। কিন্তু তাদের জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেমন ছিল তা কখনো সামনে আসে না। কিশোর, তারুণ্য, যৌবন ও মৃত্যু পর্যন্ত তাদের জীবনীতে কী কী আদর্শিক বিষয় ছিল তা খুঁজে পাওয়া যায় না। পক্ষান্তরে নবী মুহাম্মাদ সা:-এর জীবনীতে তাঁর জীবনের সব দিকের আলোচনা আমরা সিরাত ও হাদিসের কিতাবাদিতে পাই। তিনি শিশুদের সাথে কেমন আচরণ করতেন, পুত্র-কন্যাদের সাথে তিনি কেমন ছিলেন, আত্মীয়-স্বজনদের হক রক্ষায় তাঁর আদর্শ কী ছিল, প্রতিবেশীদের অধিকার রক্ষার জন্য তিনি কতটুকু সচেতন ছিলেন, এমনকি পারিবারিক গোপন বিষয়াদির ব্যাপারেও দিকনির্দেশনা পাই তাঁর জীবনচরিতে। মোট কথা, মহানবী সা:-এর জীবনের সব দিক আমাদের সামনে পরিষ্কার। কোনো সাইড গোপন নেই।
পবিত্র কুরআন কারিমে তাঁর জীবনাদর্শ নিয়ে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। অর্থ- আমি তো এর আগেও একটি বয়স পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে কটিয়েছি। তবুও কি তোমরা বুঝবে না? (সূরা ইউনুস-১৫)
রাসূল সা: যখন নবুয়তপ্রাপ্ত হলেন, তখন আরবের লোকেরা তার সমালোচনা করতে লাগল। কেউ পাগল বলে, কেউ বলে কবি, কেউ বলে জাদুকর। সে সময় আল্লাহ তায়ালা উপরের আয়াতটি নাজিল করেন। এতে বলা হয়েছে, ‘হে নবী! আপনি তাদেরকে বলুন যে, নবী হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ ৪০ বছর আমি তোমাদের মধ্যে কাটিয়েছি। আমার জীবনের সবকিছু তোমাদের সামনে আছে। আমাকে তোমরা আরবের সবচেয়ে সভ্য, বিশ্বস্ত ও আমানতদার যুবক মনে করতে। এমনকি তোমরা আমাকে আল-আমিন উপাধিতে ভূষিত করেছ। এবার তোমরাই বলো যে, আমার পুরো জিন্দেগিতে তোমরা কি কোনো আদর্শহীনতা পেয়েছিলে? পেয়েছিলে কোনো ত্রুটি বা অপূর্ণতা?’ পৃথিবীর আর কোনো মনীষী তাঁর জীবন সম্পর্কে এতবড় চ্যালেঞ্জ দিতে পারেননি, কিয়ামত পর্যন্ত কেউ পারবেও না। পৃথিবীর নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকরাও অকপটে স্বীকার করেছেন, মুহাম্মাদ সা: সর্বকালের, সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ আদর্শিক মহামানব।
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন- ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ, সেসব ব্যক্তির জন্য যারা আল্লাহ তায়ালা ও পরকালের ওপর বিশ্বাস রাখেন এবং বেশি পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করেন।’ (সূরা আহজাব-২১) আল্লাহ তায়ালা তাকে সব পাপ-পঙ্কিলতা ও ভুলত্রুটি থেকে মুক্ত রেখেছেন। এমনকি নবী হওয়ার আগেও তাঁর দ্বারা কোনো প্রকার পাপ সংঘটিত হয়নি। তিনি নবী হওয়ার আগেও নিষ্পাপ, নবী হওয়ার পরেও নিষ্পাপ। হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসূল সা: বলেন, ‘আমার বয়স যখন ১৪ বছর, তখন কুরাইশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে হচ্ছিল। তখনকার যুগে প্রচলন ছিল কোনো ধনী পরিবারের বিয়ের অনুষ্ঠান হলে সেখানে গান-বাজনা হতো।’ যেমন- আমাদের বর্তমান সমাজে গরিবের বিয়েতে তুলনামূলক গুনাহ কম হয়। কিন্তু যারা একটু ধনী, তাদের বিয়ে থাকে নানা রকম গুনাহের কাজ। ঠিক তেমনি তখনকার জাহেলি যুগেও একই রকম প্রথা ছিল। তারপর রাসূল সা: বলেন, ‘আরবের ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে যখন গান-বাজনার আসর শুরু হলো, তখন আমার ঘুম এসে গেল, ফলে আমি ঘুমিয়ে গেলাম এবং এই ঘুমে রাত পার হয়ে গেল। সকালে যখন আমি ঘুম থেকে উঠলাম জানতে পারলাম, রাতে অনেক গান-বাদ্য হয়েছে।’ এভাবে আল্লাহ তায়ালা তাকে গান-বাজনা শোনার গুনাহ থেকে রক্ষা করলেন। রাসূল সা: যদি ওই দিন গান শুনতেন, তাহলে কি পরবর্তী সময়ে গান-বাজনার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারতেন? যেন কেউ এ কথা বলতে না পারে যে, তুমিও তো ছোটকালে গান শুনেছ এখন আমাদেরকে কেন বাধা দিচ্ছ? তই এই পাপ থেকে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে মুক্ত রেখেছেন।
রাসূল সা: কখনো যদি মানবিক অথবা পারিপার্শিক কোনো কারণে এমন কোনো কাজ করতে চাইতেন যা আল্লাহ তায়ালার অভিপ্রায় নয়, তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে সতর্ক করে দিতেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ছিল মুনাফিকদের সরদার। মুখে মুখে নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করত; কিন্তু বাস্তবে সে ছিল অবাধ্য কাফের। যখন সে মৃত্যুবরণ করে, তখন তার ছেলে আব্দুল্লাহ (তিনি ছিলেন খাঁটি মুসলমান) রাসূলের কাছে এসে পিতার সালাতুজ জানাজা পড়ানোর অনরোধ করেন। রাসূল সা: তার জানাজা পড়ালেন। তখন আয়াত নাজিল হয়- ‘এ ধরনের লোকদের জানাজা আপনি পড়াবেন না। তাদের কবরে দাঁড়িয়ে আপনি দোয়াও করবেন না। তারা তো ছিল আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের অবাধ্য।’ (সূরা তাওবাহ-৭৪)
এভাবে আল্লাহ তায়ালা তার রাসূলের জীবনকে মানবিক ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত রেখেছেন। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা তাঁর স্বীয় রাসূলকে বিশ্বজগতের রহমত বানিয়েছেন, তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করা মানুষের জন্য আবশ্যক করেছেন, তাঁর জীবনকে আল্লাহ তায়ালার বিশেষ তত্ত্বাবধানে গড়ে তুলেছেন এবং সব পাপ ও পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত রেখেছেন, তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি হবেন মানব ও মানবতার পথপদর্শক এবং তার আদর্শই হবে সর্বোত্তম আদর্শ ও সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা। সুতরাং কথা-কাজে, চিন্তাচেতনায়, আকিদা-বিশ্বাসে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে আমরা যদি মাহনবী সা:-এর আদর্শ ও পদচিহ্ন ধরে অগ্রসর না হই, তাহলে আমরা কিছুতেই সফল হব না।
লেখক :
শিক্ষক, মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া মাদরাসা সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ