মানুষের আমলখেকো বদভ্যাস; গিবত করা ইসলামে কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। অথচ আমাদের সমাজে একটি মারাত্মক ব্যাধি এটি। হাজারো আলোচনার মাধ্যমেও এ থেকে মানুষকে ফেরানো যাচ্ছে না। আজকাল এর বিস্তার চরম আকার ধারণ করেছে। এর মূল কারণ হলো গিবতের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের ধারণার অভাব।
দু’চারজন লোক এক জায়গায় উপস্থিত হলেই আমরা অহরহ গিবত করে থাকি। সাধারণত বিনা প্রয়োজনে কোনো ব্যক্তির দোষ অপরের কাছে উল্লেখ করাকে গিবত বলা হয়। অর্থাৎ কারো অবর্তমানে তার দোষ বর্ণনা করাকেই গিবত বলা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, মিথ্যা দোষ বর্ণনা করা গিবত, সত্য দোষ বর্ণনা করা গিবত নয়। আবার কারো কারো ধারণা, একজন ব্যক্তির যে দোষ সবাই জানে সেটি বর্ণনা করা গিবত নয়। যে দোষ লোকজন জানে না সেটি বর্ণনা করলে গিবত। এ ধরনের ধারণাও ভুল। ইবনুল আসির রহ: বলেন, গিবত হলো কোনো মানুষের এমন কিছু বিষয়, যা তার অনুপস্থিতিতে উল্লেখ করা হয়, এটা কেউ বলুক তা সে অপছন্দ করে, যদিও তা তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে। চাই মুখে হোক আর লেখনীতে হোক। কোনো মুসলমানের কাছে হোক আর অমুসলিমের কাছে হোক। আর যদি দোষ না থাকে মিথ্যা বানিয়ে বর্ণনা করা হয় তাহলে তা হবে অপবাদ। রাসূলুল্লাহ সা: একদিন সাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা জান গিবত কাকে বলে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: ভালো জানেন। জবাবে রাসূল সা: ইরশাদ করলেন, গিবত হচ্ছে তোমার অপর ভাইয়ের এমন দোষ বর্ণনা করা যা সে শুনলে অসন্তুষ্ট হবে। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা:! বর্ণনাকৃত সেই দোষ যদি তার মাঝে থাকে তবে কি গিবত হবে? রাসূল (সা:) বললেন- যার দোষ বর্ণনা করা হবে তার মাঝে যদি এ দোষ বিদ্যমান থাকে তবে তা গিবত হবে। আর যদি না থাকে তবে সেটি হবে বুহতান বা অপবাদ। (মুসলিম)
আবার অনেকে মৃত ব্যক্তির দোষ বর্ণনা করে। এটাও হারাম। কারণ রাসূল (সা:) বলেছেন- তোমাদের কেউ মারা গেলে তাকে ছেড়ে দাও। তার গিবত করো না। তিনি আরো বলেছেন- তোমরা মৃতদের ভালো গুণগুলো আলোচনা করো এবং মন্দ আলোচনা থেকে বিরত থাকো। আমরা যেভাবে গিবত করে থাকি- অমুক ব্যক্তি দারুণ কৃপণ, পোশাকপরিচ্ছদও ভালো পরে না। অমুক রঙচঙ্গা পোশাক পরিধান করে। কিংবা অমুক মেয়েটা লজ্জাহীন। ঠিকমত পর্দা করে না; সতর খোলা থাকে, পেট খোলা থাকে। এসব সত্য কথা বলাও গিবত। অমুকের বংশ ভালো নয়। তার বাপ-দাদা হীন বা নিচু বংশীয় ছিল। কিংবা তারা নিচুমানের পেশার কাজ করত। অমুক তো জোলার বংশ। অমুক তো কুলুর বংশ। এভাবে বংশধারা নিয়ে কথা বলাও গিবত হবে। কারো অভ্যাস বা আচার আচরণ নিয়ে আলোচনা করাও গিবত। যেমন- অমুক একটা কাপুরুষ। নিতান্ত দুর্বলচেতা মানুষ। অমুক ভীষণ পেটুক; খালি খাই খাই করে বেড়ায়। চালচলনে ভদ্রতা বা শালীনতা রক্ষা করে চলে না। অমুক স্ত্রীর কথায় চলে। অমুক লোকটা দেখতে সোজাসাপ্টা মনে হয়, আসলে খুব ধূর্ত ইত্যাদি কথাও গিবত। কেননা কোনো এক সাহাবি জনৈক লোক সম্পর্কে বললেন- সে অত্যন্ত দুর্বল। এ কথা শুনে রাসূল সা: বললেন, তোমরা তার গিবত করেছ এবং তার গোশত ভক্ষণ করেছ।
কারো গুনাহের কথা অন্যের কাছে বলাও গিবত। অমুকে জেনা করেছে, অমুকে অমুকের গিবত করেছে, অথবা সে অত্যন্ত ঈর্ষাপরায়ণ, সে মিথ্যা বলে; কারো সম্পর্কে এরূপ বলাও গিবত। ইঙ্গিতে কারো সম্পর্কে কিছু বলাও গিবত। যেমন- কাউকে ইঙ্গিত করে কেউ বলল- কিছু কিছু মানুষ স্ত্রীর তাঁবেদারি করে। কিছু কিছু মানুষ দাড়ি কাটে। কিছু কিছু মানুষ মিথ্যা কথা বলে। কাউকে সামনে রেখে এরূপ ইঙ্গিত করে কথা বলাও গিবত।
গিবত শোনাও মহাপাপ- কারো গিবত শুনে চুপ থেকে প্রতিবাদ না করাও কানের গিবত। কেননা গিবত শুনে চুপ থাকা এবং প্রতিবাদ না করা নিজেই গিবত করার শামিল। রাসূল সা: বলেছেন, যখন কারো গিবত করা হয় আর তুমি সে মজলিসে বসা থাকো তখন তুমি গিবতকৃত ব্যক্তির সাহায্যকারী হও। যার গিবত করা হচ্ছে তুমি তার প্রশংসা শুরু করে দাও, যাতে মানুষ তার গিবত থেকে বিরত হয়। গিবতকারীকে গিবত করা থেকে নিষেধ করো, নতুবা মজলিস থেকে চলে যাও। কেননা চুপচাপ বসে থাকলে তুমিও গিবতকারী হিসেবে গণ্য হবে। যেমন- মায়মুন বিন সিয়াহ রা: নিজের অবস্থার বর্ণনায় বলেন- একদিন আমি ঘুমাচ্ছিলাম, স্বপ্নে দেখলাম আমার সামনে এক মৃত হাবশিকে এনে কেউ বলছে, হে মায়মুন, তুমি এ মৃত হাবশিকে খাও। আমি বললাম, আমি কেন মৃত হাবশিকে খাবো। সে বলল- তুমি অমুকের গিবত করেছ। আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি তার গিবত করিনি। সে বলল- যদিও তুমি গিবত করনি তবে শুনেছ। আর গিবত শোনা আর গিবত করা একই রকম গুনাহ।