ঈমানের পর মুসলিম নর-নারীর ওপর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত হলো সালাত। অর্থাৎ যথাসময়ে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা। গুরুত্বের বিচারে কুরআন ও হাদিসে সর্বাপেক্ষা উল্লিখিত বিধানের নাম সালাত। কুরআনে ৮২ স্থানে সালাতের কথা উল্লেখ রয়েছে, আর অসংখ্য হাদিসেও রাসূলুল্লাহ সা: সালাতের গুরুত্ব ও বিধানাবলি বর্ণনা করেছেন।
ইসলামের প্রত্যেকটি বিধানকে মানবজাতির জন্য সহজ করে দেয়া হয়েছে। যেমন- অসুস্থ থাকার কারণে সুযোগ রয়েছে যে, কেউ রোজা কাজা করতে পারবে এবং পরবর্তী সময়ে তা পুনরায় রাখতে পারবে। পুরোপুরি অক্ষম ব্যক্তির জন্য ফিদিয়া বা কাফফারা দিয়ে রোজার প্রতিবিধান করারও সুযোগ রয়েছে। এমনিভাবে অন্যান্য ইবাদত, যেমন- কেউ হজে গমনে ইচ্ছুক কিন্তু তার শারীরিক সামর্থ্য নেই এ ক্ষেত্রে তিনি কাউকে দিয়ে বদলি হজ করিয়ে নিতে পারেন। এভাবে প্রায় প্রত্যেক আমলেই বিকল্প সম্পাদন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাতে করে ইবাদতের সওয়াব থেকে সুস্থ, অসুস্থ, মাজুর, মুসাফির, মুকিম কেউই বঞ্চিত না হয়। কিন্তু একমাত্র সালাত এর ব্যতিক্রম। যার সালাত তাকেই পড়তে হবে এবং যথাযথ পড়তে হবে।
হাদিসের ভাষায় সালাত ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। (বুখারি-৮) সালাতের গুরুত্ব বোঝাতে কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘তোমরা সালাতের প্রতি যতœবান হও, বিশেষত মধ্যবর্তী সালাতের এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিনয়ী হয়ে দাঁড়াবে। যদি তোমরা আশঙ্কিত থাকো তাহলে পদচারী বা আরোহী অবস্থায় (সালাত আদায় করো)।’ (সূরা বাকারাহ : ২৩৮-২৩৯)
ইমরান বিন হুসাইন রা: বলেন, রাসূল সা: আমাকে বলেছেন, ‘তুমি দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করো, যদি তাতে সক্ষম না হও তাহলে বসে আদায় করো, আর তা-ও যদি সক্ষম না হও তাহলে শুয়ে আদায় করো।’ (বুখারি-১১১৭)
উল্লিখিত আয়াতগুলো ও হাদিসের সারগর্ভ এটিই যে, একজন মানুষ সাধারণ নিয়ম অনুসারে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করবে; তা সম্ভব না হলে বসে, শুয়ে, হেঁটে হেঁটে, দৌড়াতে দৌড়াতে, আরোহী অবস্থায় যেভাবে সম্ভব সেভাবেই তাকে সালাত আদায় করতে হবে।
রণক্ষেত্রের মতো আশঙ্কাজনক স্থানেও যথাসময়ে সালাত আদায়ের বিষয়ে ইসলামের বিধান রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন বান্দাকে সর্বপ্রথম তার সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’ (তিরমিজি-৪১৩)
এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, একজন মু’মিনের কোনো অবস্থাতেই (সুস্থ, অসুস্থ, বস্ত্রসহ, বস্ত্রহীন) সালাত কাজা করার কোনো সুযোগ নেই।
ইসলামে সালাত যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই ফজিলতপূর্ণ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘হে নবী, তুমি সালাত কায়েম করো, নিশ্চয় সালাত অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে।’ (সূরা আনকাবুত-৪৫)
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি, নিজ ঘরে পবিত্রতা অর্জন করে ফরজ সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করে, তার এক কদমে একটি করে গুনাহ মাফ করা হবে, আরেক কদমে একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে।’ (মুসলিম-৬৬৬)
রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি, সকাল-সন্ধ্যায় মসজিদে গমন করে, (নিয়মিত সালাত আদায় করে) আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাতে মেহমানদারি প্রস্তুত করবেন।’ (বুখারি-৬৬২)
সালাতকে আমরা আমাদের পক্ষ থেকে অত্যাবশকীয় দায়িত্ব মনে করি। কিন্তু আসলে চিন্তা করে দেখলে বোঝা যাবে, সালাত কোনো দায়িত্ব নয়; বরং মহাসৌভাগ্য লাভের সুবর্ণ সুযোগ। মহান প্রভু আমাদের এই অনন্য সুযোগ দান করে সম্মানিত করেছেন। যাতে করে প্রতিদিন পাঁচবার মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে কথা বলার মাধ্যমে, হৃদয়ের সব আকুতি-আবেদন তাঁকে জানানোর মাধ্যমে মহান রবের রহমত ও বরকত লাভ করতে পারি। কুরআন সালাতকে সব সফলতার চাবিকাঠি হিসেবে উল্লেখ করেছে। মহান আল্লাহ বলেন- ‘মুমিনরা সফলকাম হয়ে গেছে।’ (সূরা মু’মিনুন-১)
সালাত মনের প্রশান্তি, চক্ষুর শীতলতা, শরীরের শক্তি, অন্তরের সাহস। সালাত মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার পথ দেখায়। তাকে পরিশীলিত এবং পরিমার্জিত করে মানবতার পূর্ণ শিখরে আরোহণ করায়। সালাতের মাধ্যমে মু’মিন আল্লাহ পাকের বড়ত্ব, মহত্ত্ব ও আনুগত্যকে স্বীকার করে নেয়। সকাতর প্রার্থনায় অর্জন করে মানসিক দৃঢ়তা ও ভারসাম্য। পরম করুণাময়ের দরবারে অন্তরের ব্যথাবেদনা, না বলা কষ্ট- দুঃখ ও না পাওয়ার হাহাকার ব্যক্ত করে কাটিয়ে ওঠে সব মানসিক দুর্বলতা।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, ডক্টর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহ: প্রতিষ্ঠিত, জামেয়াতুস সুন্নাহ, ঝিনাইদহ সদর