বর্তমান সমাজে বেশির ভাগ পরিবারে অর্থ-ঐশ্বর্য থাকা সত্ত্বেও শান্তির বড় অভাব। নেই সুখ-সৌহার্দ্য, নেই হৃদ্যতা ও ভালোবাসা। কোমলতা এবং সহৃদয়তা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক মুহাব্বতের অতলস্পর্শী ছোঁয়া ও পরশ যেন বিলাস-ব্যসন আর পার্থিব প্রাচুর্যের নিচে ঢাকা পড়ে গেছে। হারিয়ে গেছে হৃদয়ের শীতলতা। ভোগ-বিলাসে ব্যতিব্যস্ত এখনকার বেশির ভাগ মানুষ জানেই না কেমন আচরণ তার কাছে তার স্ত্রীর প্রাপ্য। স্ত্রীও অনবহিত স্বামীর প্রতি কেমন হওয়া উচিত তার নিজের আচরণ। অথচ ইসলাম কতই না চমৎকার দায় এবং দায়িত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়েছে একে অপরকে। কতই না উত্তম মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে নারী ও পুরুষকে!
সব জাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ছিলেন রাসূলুল্লাহ সা:। সব শ্রেষ্ঠত্বের সাথে তিনি শ্রেষ্ঠতম স্বামীও ছিলেন। তাঁর চেয়ে অধিক সুন্দর আচরণের অধিকারী পৃথিবীতে আসেননি, আর কেউ আসবেনও না। যাঁর চারিত্রিক সনদ দান করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। ‘আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত’ (সূরা ক্কালাম-৪)। কেমন ছিল তাঁর পবিত্র দাম্পত্য জীবন? স্ত্রীদের সাথে কেমন ছিল তাঁর আচার-ব্যবহার? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সিরাত ও হাদিস থেকে পাওয়া যায় এক অনবদ্য ও আদর্শিক দাম্পত্য জীবন। যা পুরো মানবসমাজের জন্য অনুসরণীয়। বোঝা যায় একজন আদর্শ মানুষ কিংবা স্বামী হতে হলে আল্লাহর রাসূল সা:-এর সুন্নত ও নির্দেশনা অনুসরণের বিকল্প নেই।
সুন্দর নামে ডাকা : স্ত্রীদের সাথে রাসূল সা:-এর আচরণ-উচ্চারণ একটি আদর্শ দাম্পত্য জীবনের সর্বোত্তম উপমা।
এক হাদিসে আয়েশা রা: বলেন, রাসূল সা: কখনো কখনো ভালোবেসে আমাকে হুমায়রা বা লাল গোলাপ বলে ডাকতেন (ইবনে মাজাহ-২৪৭৪)।
খুনসুটি ও সখ্য : মহানবী সা: তাঁর আচার-আচরণে স্ত্রীদের প্রতি নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতেন। তাদের সাথে নানা ধরনের খুনসুটি করতেন। এতে পারস্পরিক আন্তরিকতা ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।
আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি ও রাসূল সা: একই পাত্র থেকে গোসল করতাম যা আমাদের মধ্যে থাকত। তিনি আমার চেয়ে অগ্রগামী হলে (দ্রুত গোসল করে পানি নিলে) আমি বলতাম, আমার জন্য রাখুন! আমার জন্য রাখুন! (মুসলিম-৩২১)।
ভালোবাসা প্রকাশ করা : উচ্চারণ ও কথার মাধ্যমে স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করা মহানবী সা:-এর সুন্নত। আল্লাহর রাসূল সা: বিভিন্ন সময়ে স্ত্রীদের সাথে বিভিন্ন রোমাঞ্চকর কথা বলতেন। মিষ্টি কথায় তাদেরকে মুগ্ধ করতেন।
হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: প্রিয়তমা খাদিজা রা: সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমার মনে তার প্রতি ভালোবাসা ঢেলে দেয়া হয়েছে’ (মুসলিম-২৪৩৫)।
আয়েশা রা:-এর প্রশংসা করে রাসূল সা: বলেছেন, ‘খাবারের মধ্যে সারিদ যেমন সবার সেরা; নারীদের মধ্যে আয়েশা সবার সেরা’ (বুখারি-৩৪১১)।
স্ত্রীর মতামত গ্রহণ করা : স্বামীর যেকোনো কাজেই স্ত্রীর মতামত নেয়া উচিত।
মহানবী সা: স্ত্রীদের সাথে পরামর্শ করতেন। তিনি শুধু ঘরোয়া বিষয়েই তাদের মতামত নিতেন না; বরং মুসলিম উম্মাহর অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। যেমন হুদাইবিয়ার সন্ধি সম্পাদন হওয়ার পর রাসূল সা: সাহাবিদের বলার পরও যখন তারা ব্যথিত হয়ে কোরবানি ও হলক (মাথা মুণ্ডানো) কোনোটিই করলেন না, তখন রাসূল সা: মনঃক্ষুণœ হয়ে তাঁবুতে প্রবেশ করেন এবং হজরত উম্মে সালমা রা:-এর সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করেন। অতঃপর তার পরামর্শ অনুযায়ী রাসূল সা: নিজের কোরবানি ও হলক সম্পাদন করলে সাহাবায়ে কেরামও নিজেদের কোরবানি ও হলক সম্পন্ন করে নেন (বুখারি-১/৩৮০)।
ঘরোয়া কাজে সহযোগিতা করা : ঘরের কাজকর্মে স্ত্রীদের সহযোগিতা করার প্রতি পুরুষদের অনাগ্রহ লক্ষ করা যায়। অনেকে আবার এটিকে মানহানিকর মনে করে থাকে। ছোট ছোট বিষয়েও তারা স্ত্রীনির্ভর হয়ে থাকে। অথচ রাসূল সা: ঘরের কাজকর্মে স্ত্রীদের সহযোগিতা করতেন।
হজরত আয়েশা রা:-কে একবার জিজ্ঞেস করা হলো, রাসূল সা: ঘরে কী কাজ করতেন? তিনি বলেন, ‘রাসূল সা: ঘরের কাজকর্মে স্ত্রীদের সহযোগিতা করতেন’ (মিশকাত-৩৫১৯)। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সা: নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন। নিজের জুতো নিজেই মেরামত করতেন।
ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও অসংখ্য রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় ভরপুর ছিল রাসূলুল্লাহ সা:-এর দাম্পত্য জীবন। জীবনের সব কিছুর মতো একজন আদর্শ স্বামীর জন্য সর্বোত্তম আদর্শ রেখে গেছেন তিনি।
লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম, নতুনবাগ, রামপুরা, ঢাকা