ইসলাম শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণ করা। আর যারা মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি ও তার প্রেরিত রাসূল হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম দ্বীন ইসলামকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এবং ইসলামের বিধিবিধানগুলো মেনে নিয়ে সে অনুযায়ী জীবন যাপন করে তাদেরকে মুসলিম বলে। ইসলামের মূল কথা হলো- আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা এবং তার সাথে কাউকে শরিক না করা। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তায়ালা তার নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন। আল্লাহ একক সত্তা, তার কোনো শরিক নেই। তাকে কেউ জন্ম দেয়নি এবং তিনিও কাউকে জন্ম দেননি। তিনিই একমাত্র ইলাহ বা মাবুদ। সুতরাং পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তার নিজের যে পরিচয় বর্ণনা করেছেন, সে অনুযায়ী তাকে বিশ্বাস করাই ঈমানের মূল কথা। যারা তার সাথে অন্য কাউকে শরিক করে তারা মুশরিক। আর মুশরিকদের স্থান হলো জাহান্নাম।
মানবতা প্রতিষ্ঠায় ইসলামের ভূমিকা : মানুষের কল্যাণে সৃষ্টির শুরু থেকে এ পর্যন্ত যে যা দিয়েছে, ইসলাম তার থেকে অনেক অনেক বেশিই দিয়েছে। এমনকি বিশ্বমানবতা প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলাম যা করেছে বা বলেছে তা সর্বযুগে এবং সর্বকালে শীর্ষ স্থানেই থাকবে।
দ্বীন ইসলামের ধারক ও বাহক হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর বাস্তব জীবনই হলো বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
মহানবী সা:-এর জীবনের দু’টি ঘটনা এখানে তুলে ধরা হলো-
১. তায়েফে অবস্থানকালে মহানবী সা: যে পথ দিয়ে মসজিদে সালাত আদায় করতে যেতেন, অমুসলিম এক বুড়ি প্রতিদিন সে পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত, একদিন পথে কাঁটা না দেখে তার কোনো অসুখ হলো কি না এই ভেবে দয়ার নবী বুড়ির খোঁজে তার বাড়ি গিয়ে পৌঁছেন। গিয়ে দেখেন বুড়ি অসুস্থতার কারণে ছটফট করছে। মহানবী সা: তার জন্য ওষুধের ব্যবস্থা করলেন এবং তার সেবা শুশ্রƒষা করলেন। আজো সেই বুড়ির বসবাসের বাড়িটি তায়েফে সংরক্ষিত আছে।
২. মক্কা বিজয়ের কয়েক দিন পর এক বৃদ্ধা তার সামান্য মালামাল পুঁটলি বেঁধে মক্কা ছেড়ে চলে যাচ্ছিল; কিন্তু বয়সের কারণে পুঁটলি বহন করা তার পক্ষে কষ্ট হচ্ছিল। নবী করিম সা: এসে তাকে দেখে জিজ্ঞেস করেন, মা তুমি কোথায় যাচ্ছ? বৃদ্ধা বলল, অমুক জায়গায় আমার আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছি। কেন যাচ্ছ, এ প্রশ্নের জবাবে বৃদ্ধা বলল, শুনেছি মুহাম্মাদ নামে এক ব্যক্তি আমাদের বাপ-দাদার ধর্মের বিরুদ্ধে এক নতুন ধর্ম প্রচার করছে তাই চলে যাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ সা: এবার বৃদ্ধার বোঝাটি নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে বললেন, মা তুমি আমার সাথে চলো, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবো। বৃদ্ধাকে তার আত্মীয়ের বাড়ি দিয়ে নবী করিম সা: বললেন, তুমি এখানে থাকো আমি যাচ্ছি। বৃদ্ধা বলল, বাবা তুমি কে আমার জন্য এত কষ্ট করেছ? দিনের নবী সা: বললেন, আমার নাম মুহাম্মাদ, আপনি যার কথা শুনেছেন আমিই সেই মুহাম্মাদ। আমিই ইসলামের কথা বলে থাকি এবং এক আল্লাহর ইবাদতের কথা প্রচার করে থাকি। বৃদ্ধা বলল, যদি এটাই হয় ইসলাম তাহলে আমি ইসলাম গ্রহণ করতে রাজি। এ বলে তিনি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে কালেমা পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামের ছাঁয়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলেন।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এবং মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর বাণীগুলোর প্রায় সর্বস্থান জুড়েই বলা হয়েছে মানবতার কথা। মানুষ তার জীবনে যখন যে স্তরেই থাকুক, ইসলাম মানবজীবনের প্রতিটি স্তরের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে।
মানুষ তার জীবনের প্রতিটি স্তরে যদি ইসলামের দেয়া বিধিবিধান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করে তবে নিশ্চয়ই সে হবে একজন প্রকৃত মানুষ। একজন মানুষ যখন তার জীবনকে ইসলামের বিধান অনুসারে পরিচালনা করবে তখন তার বাস্তব জীবনে পাবে শান্তি ও তৃপ্তি। শুধু কি তাই; বরং তার দ্বারা মানবকুল এবং প্রাণিকুল উপকৃত হবে এবং তার দ্বারা কেউ কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সা: এবং তার অনুসারীদের জীবনাদর্শই তার সুস্পষ্ট প্রমাণ রাখে।
নারীর অধিকার : মহানবী সা:-এর জন্মের আগে থেকেই আরব সমাজে নারীরা ছিল অবহেলিত ও নিগৃহীত। সে যুগে কন্যাসন্তানকে বংশের কলঙ্ক মনে করা হতো। কন্যাসন্তানকে অন্য বংশে বা পরিবারে বিয়ে দিলে সে পরিবারের কাছে মাথা নত হবে ভেবে কারো ঔরসে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করলে তাকে গর্ত খনন করে শৈশবেই জীবন্ত প্রোথিত করা হতো। মহানবী সা: এই ঘৃণিত প্রথা বাতিল করেছেন।
পবিত্র কুরআন ও মহানবী সা:-এর অসংখ্য বাণীর মাধ্যমে নারীদের যথার্থ মর্যাদার ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন- পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ‘তোমরা নারীদের সাথে সৎভাবে জীবনযাপন করো। অতঃপর যদি তাদেরকে অপছন্দ করো, তবে হয়তো এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছ যাতে আল্লাহ অনেক কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।’ (সূরা নিসা-১৯) মহান আল্লাহ বলেন- ‘তারা (নারীরা) তোমাদের জন্য পরিচ্ছদস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের জন্য পরিচ্ছদস্বরূপ।’ (সূরা-বাকারাহ) রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির ঘরে কন্যাসন্তান জন্ম লাভের পর সে যেন তাকে (জাহিলিয়াতের যুগের মতো) জীবিত কবর না দেয় এবং তাকে তুচ্ছ না করে। আর পুত্রসন্তানকে ওই কন্যাসন্তানের উপর প্রাধান্য না দেয়। (কেউ যদি এ আচরণ না করে) তা হলে আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন।’ (আবু দাউদ) রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।’ (তিরমিজি)
শ্রমিকের অধিকার : শ্রমিকের অধিকার প্রসঙ্গেও মহানবী সা:-এর অসংখ্য বাণী রয়েছে- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের অধীনস্থ ব্যক্তিরা (দাস-দাসীরা) তোমাদের ভাই। সুতরাং আল্লাহ যে ভাইকে যে ভাইয়ের অধীন করে দিয়েছেন সে তার ভাইকে যেন তাই খাওয়ায় যা সে নিজে খায়, তাকে তাই পরিধান করায় যা সে নিজে পরিধান করে।’ (বুখারি) রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা মজুরের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি দিয়ে দাও।’ (ইবনে মাজাহ)
অমুসলিমদের অধিকার : অমুসলিমদের অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে মহানবী সা:-এর অসংখ্য বাণী রয়েছে- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, মনে রেখো, যদি কোনো মুসলমান কোনো অমুসলিম নাগরিকের প্রতি জুলুম-নিপীড়ন চালায়, তার অধিকার খর্ব করে, তার কোনো জিনিস জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষ অবলম্বন করব।’ (আবু দাউদ) রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যে লোক কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকের ওপর জুলুম করবে ও তার সাধ্যের বাইরে কাজ চাপাবে অথবা করতে বাধ্য করবে কিয়ামতের দিন আমি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী হয়ে দাঁড়াব।’
ইয়াতিমদের অধিকার : মহান আল্লাহর বাণী-‘যারা ইয়াতিমের ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে তারা নিজেদের পেটে আগুন ভর্তি করেছে এবং অতিসত্বর তারা আগুনে (জাহান্নামে) প্রবেশ করবে।’ (সূরা নিসা-১০) রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মুসলমানদের ঘরের মধ্যে উত্তম ঘর সেটি যাতে ইয়াতিম আছে আর তার সাথে উত্তম আচরণ করা হয় এবং খারাপ ঘর সেটি- যাতে ইয়াতিম আছে, আর তার সাথে অসদাচরণ করা হয়।’ (ইবনে মাজাহ )
সৃষ্টির প্রতি দয়া : মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সৃষ্টিজগতের প্রতিটি প্রাণীর প্রতি অনুগ্রহশীল হওয়ার জন্য পবিত্র কুরআন ও হাদিসে অসংখ্য বাণী রয়েছে- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সব সৃষ্টি আল্লাহ তায়ালার পরিবারের সন্তানসন্ততিবিশেষ। সৃষ্টজীবের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার কাছে সবচেয়ে প্রিয় সে-ই, যে তার সন্তানসন্ততির প্রতি অনুগ্রহ করে।’ (বায়হাকি) রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করে না আল্লাহ তার প্রতি অনুগ্রহ করেন না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
দরিদ্র, নিঃস্ব ও অসহায় ব্যক্তিদের অধিকার : দরিদ্র, নিঃস্ব ও অসহায় ব্যক্তিদের জন্য ইসলামের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো জাকাত-ব্যবস্থা। ইসলাম নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী ধনী ব্যক্তিদের মালিকানাধীন সম্পদের ৪০ ভাগের এক ভাগ সম্পদ দরিদ্রদের জন্য নির্ধারণ করেছে। জাকাতের সম্পদ আটটি খাতে ব্যবহার করার জন্য ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। তার মধ্যে দরিদ্র ও নিঃস্ব ব্যক্তিদের জন্য বেশির ভাগ রয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তুমি কি দেখেছ তাকে, যে দ্বীনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে? সে তো ওই ব্যক্তি যে ইয়াতিমকে গলাধাক্কা দেয় (অর্থাৎ সে কোনো সাহায্য প্রার্থনা করলে তাকে তাড়িয়ে দেয়) এবং মিসকিনকে খাদ্যদানে উৎসাহিত করে না।’ (সূরা মাউন) রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, আল্লাহর কসম, সে ঈমানদার হবে না। আল্লাহর কসম সে ঈমানদার হবে না। আল্লাহর কসম সে ঈমানদার হবে না। জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা: সে কে? হুজুর সা: বললেন, যার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ নয়।’ (বুখারি ও মুসলিম) মহানবী সা:-এর বাণী- হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ থেকে বলতে শুনেছি যে, সেই ব্যক্তি পূর্ণ মু’মিন নয়, যে উদরপূর্তি করে খায় অথচ তার পাশেই তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে।’ (বায়হাকি)
এভাবে মানবজীবনের যতটি ক্ষেত্র ও বিভাগ রয়েছে তার প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলাম শ্রেষ্ঠতম বিধান দিয়েছে। আসুন পবিত্র কুরআন ও মহানবী সা:-এর সুস্পষ্ট বাণীগুলো অর্থসহ বুঝে বুঝে পড়ার চেষ্টা করি এবং তা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে বাস্তবায়ন করি, তবেই আমরা হবো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষ।
লেখক:
সুপারিনটেনডেন্ট, বৈটপুর ভদ্রপাড়া জামালিয়া দাখিল মাদরাসা, বাগেরহাট সদর