রাগ নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। প্রত্যেক মানুষেরই রাগ আছে। তবে কারো কম আর কারো বেশি। প্রতিদিনের হাসি-কান্না, আনন্দ-দুঃখ, ঘৃণার মতো রাগও আমাদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ। রাগ এটি মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। রাগ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তবে সমাজ ও ধর্মীয় রীতিনীতির প্রতি লক্ষ রেখে রাগকে নিষ্ক্রিয় করা যাবে না। কারণ সামাজিক অবক্ষয় ও ধর্মীয় অনুসাশন মানার ক্ষেত্রে কখনো কখনো রাগ বা ক্ষোভেরও দরকার হয়। আল্লামা শেখ সাদী রহ: রাগ ও রাগী ব্যক্তিদের পরিণয়ের প্রতি লক্ষ রেখে বলেন, ‘ক্রোধের আগুন প্রথমে রাগান্বিত ব্যক্তির ওপর পড়ে। যার ওপর রাগ করা হয় তার ওপর পড়তেও পারে, না ও পড়তে পারে। যখন কারো রাগ এসে যায় তখন তার কর্মকাণ্ড এমন হয় যে, পরবর্তীতে তার লজ্জিত হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। তখন সে ভাবে, আমার মতো লোক এই কাজ করেছে! নিজেও উপলব্ধি করতে পারে না যে, সে এ কাজটি করেছে।’ তাই আমাদেরকে এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে, যে কাজের জন্য পরবর্তীতে আবার নিজেকেই লজ্জিত হতে হয়।
রাগ সংবরণের ফজিলত : রাগ অনিয়ন্ত্রিত হওয়া মানবীয় গুণের বিপরীত। আর আল্লাহ তায়ালাও নিয়ন্ত্রণহীন রাগী ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না। তাই রাগকে নিয়ন্ত্রণ করাই কাম্য। কুরআনে কারিমের ভাষ্যমতে-আল্লাহ তায়ালা চার গুণে গুণান্বিত মানুষকে ভালোবাসেন তার মধ্যে অন্যতম হলো- রাগ নিয়ন্ত্রণকারী। ইরশাদ হচ্ছে- ‘যারা সুসময়ে ও দুঃসময়ে ব্যয় করে এবং ক্রোধ সংবরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন’ (সূরা আল-ইমরান-১৩৪)। অনেক সময় রাগী ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়। তবে রাগের বশবর্তী হয়ে কাউকে ক্ষতি বা আঘাত করা প্রকৃত বীরের কাজ নয়; বরং প্রকৃত বীরের কাজ হলো রাগকে সংবরণ করে ক্ষমা করে দেয়া!
এমনটিই হাদিসে পাকের মধ্যে ইরশাদ হয়েছে, রাসূল সা: বলেন, ‘সে ব্যক্তি শক্তিশালী নয়, যে ব্যক্তি কুস্তি লড়ে অন্যকে ধরাশায়ী করে; বরং প্রকৃতপক্ষে সে ব্যক্তিই শক্তিশালী, যে রাগের সময় নিজেকে সংবরণ রাখতে পারে’ (বুখারি-৮০৯)। আবার কুরআনে রাগ সংবরণকারীর জন্য বর্ণিত হয়েছে মহা সুসংবাদ! আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘অতএব তোমাদের যা দেয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভোগ্যমাত্র। আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী, তাদের জন্য যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের পালনকর্তার ওপর ভরসা করে। যারা বড় গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকে এবং ক্রোধান্বিত হয়েও ক্ষমা করে’ (সূরা আশ-শুরা : ৩৬-৩৭)। আরেকটি হাদিসে রাগ দমনকারীর জন্য জান্নাতের ঘোষণা দিয়ে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তুমি রাগ করবে না, তাহলে তোমার জন্য জান্নাত’ (সুনানে তিবরানি-২১)।
যেসব বিষয়ে রাগ করা যাবে : আমাদের প্রিয় নবী সা: কখনো নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য কারো ওপর রাগ করেননি। তবে আল্লাহ ও শরিয়তের আহকামের ক্ষেত্রে তিনি কাউকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেননি। হজরত আয়েশা রা: বলেন, ‘রাসূল সা: কখনো নিজের কোনো ব্যাপারে কারোর কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। তবে মহান আল্লাহর নিষিদ্ধ কোনো কাজ করে ফেললে তিনি তার যথাবিহিত শাস্তির ব্যবস্থা করতেন’ (মুসলিম-৩৫৬০)। অর্থাৎ শরয়ি বিষয়ে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে সাথে সাথে প্রতিবাদ করা বা ক্ষোভ প্রকাশ করা ক্ষতিকর নয়; বরং তা প্রকৃত মুমিনের ঈমানিয়াতের আলামত।
রাগ সংবরণের পদ্ধতি : প্রথমেই আমরা জানতে পেরেছি ‘রাগ’ একটি স্বভাবজাত বিষয়। অতিরিক্ত রাগ কখনোই জীবনে সফলতা বয়ে আনতে সহযোগিতা করে না। তাই রাসূল সা: রাগ সংবরণের কয়েকটি পদ্ধতিও বলে দিয়েছেন, যথা-
অজু করা : নবী করিম সা: ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় রাগ শয়তানের পক্ষ থেকে। আর শয়তান আগুনের তৈরি। নিশ্চয় পানির দ্বারা আগুন নির্বাপিত হয়। সুতরাং তোমাদের কেউ যখন রাগান্বিত হয় সে যেন অজু করে’ (সুনানে আবু দাউদ-৪৭৮৬)।
শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন : রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যখন তোমাদের কারো রাগ হয় তখন সে যদি দাঁড়ানো থাকে, তবে যেন বসে পড়ে। যদি তাতে রাগ চলে যায় ভালো। আর যদি না যায়, তবে শুয়ে পড়বে’ (সুনানে আবু দাউদ-৪৭৮৪)।
আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা : দুই ব্যক্তি নবী করিম সা:-এর কাছে বসে পরস্পর গালাগাল করছিল। তাদের একজনের চোখ লাল হয়ে উঠল ও গলার শিরা ফুলে গেল। তখন রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘আমি একটি বাক্য জানি, যদি সে তা পড়ে তবে তার এ অবস্থা কেটে যাবে। সে বাক্যটি হলো, ‘আমি আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি’ (মুসলিম-৬৮১২)।
রাগ দূরীকরণের আরো অনেক পদ্ধতি রয়েছে। চুপ থাকা, কারো সাথে কোনো বিষয়ে কথা বললে রাগ হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হলে সে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া বা কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে হাসি মজার কোনো বিষয়ে আলোচনা করা।
লেখক :
ইসলামী গবেষক, নাজিরপুর, পিরোজপুর