কেউ ৮০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন। কেউ হাঁটছেন ২০০ কিলোমিটার। এমনকি, পাঁচ শ’ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। তারা সবাই শ্রমিক। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন। নিজের রাজ্য ছেড়ে, গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ভিন রাজ্যে থাকেন। কেউ সপরিবার, কেউ বা একা। করোনার ফলে লকডাউন হয়ে যাওয়া ভারতে তাদের দুর্গতির শেষ নেই। একে তো খাবার নেই, থাকার জায়গা নেই, হেঁটে অভুক্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। মাঝে মধ্যেই পুলিশের লাঠির বাড়ি খেতে হচ্ছে। বাড়ি ফিরেও নিস্তার নেই। গ্রামের লোক তাদের ঘরে যেতে দিচ্ছেন না। মারধর পর্যন্ত করছেন। হৃদয়হীন শহর তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। নিজের গ্রামও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তাদের ঠাঁই দিচ্ছে না। অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তারা।
করোনার ভয় বা আতঙ্কে লোক দিশেহারা। তাই প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে ঘরে ফেরা শ্রমিকদের সঙ্গে। ঝাড়খণ্ডে গ্রামে ফেরার পর এরকমই এক শ্রমিককে ধরে মারা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে একজন গ্রামবাসী ফেরার পর তাকে ঢুকতে না দিয়ে মেরেধরে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। বর্ধমান জেলার কাটোয়ার অভিজ্ঞতা তো আরও খারাপ। তৃণমূল এমপি সুখেন্দু শেখর রায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ”পশ্চিমবঙ্গের অনেক কাগজেই খবর বেরিয়েছে, কাটোয়া পুরসভা উদ্যোগ নিয়ে বিহার থেকে আসা শ্রমিকদের তাদের রাজ্যে ফেরাতে যায়। তাঁদের বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বিহার পুলিশ ও প্রশাসন তাদের ঢুকতেই দেয়নি। তারা আবার কাটোয়ায় ফিরে এসেছেন। পুরসভা এখন তাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। বিভিন্ন রাজ্যে হাজার হাজার শ্রমিক আটকে পড়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকার বিদেশে আটকে থাকা ভারতীয়দের চার্টার্ড বিমানে করে নিয়ে আসতে পারেন, অথচ, এই শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করতে পারেন না। আর দুই দিন ট্রেন চালালে কী ক্ষতি হত? অভিজ্ঞতা বলছে, বড়লোকরাই বিদেশ থেকে এই সংক্রমণ নিয়ে ফিরছেন। গরিবরা পরে তাদের সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হচ্ছেন।”
এই পরিস্থিতি দেখে অনেক জায়গায় জনপ্রতিনিধিরা সক্রিয় হয়ে ভিন রাজ্য থেকে আসা শ্রমিকদের ঘরে ফেরাচ্ছেন। তাঁরা যেন বাইরে যত্রতত্র না ঘুরে বেড়ান, তা দেখছেন। তৃণমূলের সাংসদ মানস ভুঁইঞা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ”পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ে ভিন রাজ্য থেকে ১ হাজার ৯৩ জন এবং পিংলায় ৬৬২ জন ফিরেছেন। এখনও মুম্বই, চেন্নাই, হায়দরাবাদ, কেরালা, গোয়া, হরিদ্বারে মোট ৩৫০ জন সবংয়ের শ্রমিক আটকে পড়েছেন। চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়ে আমি গ্রামবাসীদের বুঝিয়েছি। যাঁরা ফিরেছেন, তাদেরও ঘরবন্দি হয়ে থাকতে বলেছি।” এখানে না হয় মানসবাবু নিজে পেশায় চিকিৎসক ও দীর্ঘদিনের জনপ্রতিনিধি এবং তিনি সক্রিয় বলে অসুবিধা হচ্ছে না, কিন্তু অন্যত্র?
ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বাড়ি ফিরছেন এই শ্রমিকের দল। তেলেঙ্গানা থেকে রাজস্থান যাচ্ছিল দুটি বড় কনটেইনার ট্রাক। মহারাষ্ট্রের পুলিশ তাদের রুটিন পরীক্ষার জন্য থামায়। দেখা যায়, কনটেইনারে কোনও অত্যাবশ্যকীয় জিনিস নেই, গাদাগাদি করে আছেন ৩০০ শ্রমিক, এ ভাবেই তারা রাজস্থানে নিজেদের বাড়ি ফিরছিলেন। ট্রাকের চালকদের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কিন্তু শ্রমিকদের নিয়ে কী করা হবে, তা এখনও স্থির করা যায়নি।
কতটা মরিয়া হলে তারা এইভাবে ঘরে ফেরার চেষ্টা করেন তা সহজবোধ্য। নিজেদের পুঁজির টাকা সব ট্রাকচালককে দিয়ে ঝুঁকি নিয়েও ফিরছেন তারা। যারা মনে করছেন হাঁটতে পারবেন, তাঁরা হেঁটেই ফিরছেন। তাদেরও হেনস্থার শেষ নেই। গোয়ালিয়র থেকে উত্তরপ্রদেশের গ্রামে ফিরছিলেন কয়েকজন শ্রমিক। বদায়ুঁতে পুলিশের কনস্টেবল তাদের প্রথমে হামাগুড়ি দিতে বলে। তারপর ব্যাঙের মতো লাফাতে বলে। সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে সেই ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় কনস্টেবলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
আবার ব্যতিক্রমও যে নেই তা নয়। গাজিয়াবাদ থেকে উত্তরপ্রদেশেই গ্রামে ফিরছিলেন রাজেশ কুমারসহ কয়েকজন। কিন্তু রাস্তায় লোকে সাহায্য করেনি এই ভেবে যে, গাজিয়াবাদ থেকে তারা নিশ্চয়ই করোনাভাইরাস নিয়ে ফিরছেন। লখিমপুর খিরি পৌঁছলে পুলিশ তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। তারপর খেতে দেয়। আবার মেদিনীপুরের একটি গ্রামে ভিন রাজ্য থেকে শ্রমিকরা বাড়ি ফেরার পর রীতিমতো মাইক বাজিয়ে নাচাগানা করে পার্টিও করেছেন গ্রামবাসীরা। করোনার সময়ে এটাও দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ।
সূত্র : ডয়চে ভেলে