– রফতানি আয়ও কমছে
– সঙ্কুচিত বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের পথ
ব্যাংকগুলো বেশি দামে ডলার কিনতে দিলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যায়। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করলে অর্থাৎ নির্ধারিত দরে ডলার কেনার বিষয়ে কঠোর হলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যায়। রেমিট্যান্স প্রবাহ যেন ডলারের দাম বাড়া-কমার বৃত্তে আটকে গেছে। এর বড় প্রমাণ পাওয়া যায় গত কয়েক মাসের রেমিট্যান্স প্রবাহের চিত্র থেকে। অক্টোবরে ব্যাংকগুলো বেশি দামে রেমিট্যান্স আনার সুযোগ পেয়েছিল। এতেই আগের তিন মাসের চেয়ে অনেক বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। যেমন, আগস্টে এসেছিল ১৬০ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৩৩ কোটি ডলার। কিন্তু অক্টোবরে রেমিট্যান্স আসে ১৯৮ কোটি ডলার। এদিকে, বেশি দরে রেমিট্যান্স আনায় বাজারে ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতি আরো উসকে দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য গত মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশি দামে রেমিট্যান্স আনার বিষয়ে কঠোরতা আরোপ করা হয়। নীতিনির্ধারণী ব্যাংকারদের সংগঠনকে দিয়েই রেমিট্যান্সের ডলার বেঁধে দেয়া হয়। আর ব্যাংকগুলো তা পরিপালন করছে কি না তা তদারকি করা হয়। এতেই গত মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ আবারো কমে গেছে।
এদিকে, বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের অন্যতম আরো একটি খাত রফতানি আয়ও গত দুই মাস যাবৎ ধারাবাহিক কমে যাচ্ছে। গত নভেম্বরে কমেছে ৬ শতাংশ। এভাবেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের পথ।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, একশ্রেণীর ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাফেদা (বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন) ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি (অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ) যৌথ বৈঠকে আমদানি-রফতানিতে কী দামে ডলার কেনাবেচা করবে, আর কী দরে রেমিট্যান্স আহরণ করবে তা নির্ধারণ করে দিয়ে থাকে। কিন্তু তাদের এ নির্দেশনা ব্যাংকগুলোর বড় একটি অংশই পরিপালন করে না। যেমন, বলা হয়েছিল প্রতি ডলার ১১০ টাকার বেশি দরে রেমিট্যান্স আহরণ করা যাবে না। কিন্তু দেখা গেল কোনো কোনো ব্যাংক ১১৮ টাকা থেকে ১২২ টাকা পর্যন্ত রেমিট্যান্স আহরণ করছে। তারা বেশি দামে রেমিট্যান্স আহরণ করে আবার বেশি দামে বিক্রি করছে। কিন্তু সমস্যায় পড়েছে যারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম যথাযথভাবে পরিপালন করে ওইসব ব্যাংকগুলো। তারা বাফেদা ও এবিবির সিদ্ধান্ত মানতে গিয়ে রেমিট্যান্স আহরণে পিছি পড়ে। যেমন, সোনালী ব্যাংক। তারা আগে রেমিট্যান্স আহরণে দুই তিনটি ব্যাংকের মধ্যে থাকতো। কিন্তু তারা এখন শীর্ষ ১০ ব্যাংকের মধ্যেও থাকতে পারছে না, শুধু নিয়ম পরিপালন করতে গিয়ে। এতে তাদের এলসির দায় পরিশোধে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন আরো অনেক ব্যাংকই এ সমস্যায় পড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন বিষয়টি কঠোরভাবে তদারকি করে তখনই রেমিট্যান্স কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত জুন মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২২০ কোটি ডলার। জুলাই মাসে এসেছিল প্রায় ২০০ কোটি ডলার। কিন্তু আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে তা ১৬০ ও ১৩৩ কোটি ডলারে নেমে যায়। কারণ ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিষয়টি কঠোরভাবে তদারকি করা। এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রায় ডজন খানেক ব্যাংকের কর্মকর্তাকে জরিমানাও করা হয়েছিল। কিন্তু যে জরিমানাও আদায় করতে পারেনি। গত অক্টোবরে অনেকটা ফ্রি স্টাইলে বেশি দর দিয়ে রেমিট্যান্স আহরণ করা হয়েছিল। এতে দেখা যায়, এক মাসের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যায় ৬৫০ মিলিয়ন বা ৬৫ কোটি ডলার। অক্টোবরে যেখানে ছিল ১৩৩ কোটি ডলার, নভেম্বরে তা হয় প্রায় ১৯৮ কোটি ডলার। এক মাসের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ এত বিপুল পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আবারো তদারকি জোরদার করেছে। গত মাসে রেমিট্যান্সের দর নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতেই দেখা যায় আবারো রেমিট্যান্স প্রবাহ নিম্নগতির দিকে ধাবিত হয়েছে। নভেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ আগের মাসের চেয়ে পাঁচ কোটি ডলার কম এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বেশি দামে রেমিট্যান্স আহরণ করলে বেশি দামে বিক্রি করতে হবে। এতে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যায়, যা মূল্যস্ফীতি বাড়তে সরাসরি প্রভাব ফেলে। এ কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজার শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে বাজার তদারকি জোরদার করে থাকে।
এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের রেমিট্যান্সের পরে অন্যতম খাত রফতানি আয়ও গত দুই মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে। গত মাসে দেশে ৪৭৮ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এ রফতানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬ দশমিক ৫ শতাংশ কম। এর আগে গত অক্টোবর মাসেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গতকাল পণ্য রফতানি আয়ের এ হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। নভেম্বর মাসে ৫২৫ কোটি ডলার রফতানি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রফতানি হয়েছে ৪৭৮ কোটি ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ কম। অন্যদিকে ২০২২ সালের অক্টোবরে আয় হয়েছিল ৫০৯ কোটি ডলার। টানা দুই মাস পণ্য রফতানি কমে যাওয়ায় সামগ্রিক পণ্য রফতানি বৃদ্ধির গতিও কমে গেছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাস শেষে (জুলাই-অক্টোবর) পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ৩ শতাংশ। তবে নভেম্বর মাসে রফতানি কমায় পাঁচ মাসের হিসাবে (জুলাই-নভেম্বর) প্রবৃদ্ধি মাত্র ১ দশমিক ৩০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। জুলাই-নভেম্বর সময়ে রফতানি হয়েছে দুই হাজার ২২৩ কোটি ডলারের পণ্য।