স্থায়ী কমিটির ৪ ঘণ্টা বৈঠকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা
– প্রচারণামূলক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত
– হরতাল থাকবে তবে সহিংসতার পক্ষপাতী নয় দলটি
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বয়কট করে হরতাল-অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করলেও ‘বাস্তবতা বিবেচনায়’ ভোট ঠেকানোর কঠোর আন্দোলনে যাচ্ছে না বিএনপি। বরং জনগণকে ‘একতরফা’ নির্বাচনে ভোট প্রদানে নিরুৎসাহিত করার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। এর অংশ হিসেবে চলমান গণসংযোগ কর্মসূচি আরো বাড়ানো হয়েছে।
গত রোববার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দীর্ঘ ভার্চুয়াল বৈঠকে পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা-পর্যালোচনার পর বাস্তবতার নিরিখে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলটির হাইকমান্ড। চার ঘণ্টার এই বৈঠকে দলটির সাংগঠনিক সম্পাদকরাও ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে অন্যপক্ষকে কোনো অপকর্ম-নাশকতা করার সুযোগ দিতে চায় না বিএনপি। তা ছাড়া নেতাকর্মীদের আর নতুন করে ধরপাকড়ের মুখেও ঠেলে দিতে চায় না। তাই সহিংসতা তৈরি হতে পারে, এমন কর্মসূচিতে যাবে না দলটি। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএনপি এখন ধৈর্য সহকারে সতর্কতার সাথে সামনে এগুনোর কৌশল গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে।
বিএনপির নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ‘একতরফা’ ভোট বর্জনের আহ্বানে আগামী শুক্রবার পর্যন্ত ফের দেশব্যাপী গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করা হবে। এর মধ্যে গতকাল সোমবার আরো তিন দিনের লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভোটের আগের দিন ও ভোটের দিন দেশব্যাপী হরতালের ডাক দিতে পারে বিএনপি। এ ছাড়া নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ভোটের পরদিনও হরতাল অব্যাহত রাখা হতে পারে। এরপর ‘একতরফা’ নির্বাচনের ফল বাতিল এবং একদফা দাবিতে নতুন করে জনগণকে সংগঠিত করতে সভা-সমাবেশের মতো জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হবে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত যা চলবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান এ প্রসঙ্গে বলেন, বিএনপি বরাবরই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির পথে হেঁটেছে। কখনো কোনো নাশকতা বা সাংঘর্ষিক ঘটনায় জড়ায়নি। আগামীতেও সব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ থাকবে। বিএনপি মনে করে, তাদের এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে জনগণ সাড়া দিবে এবং এই সরকারের আয়োজিত আগামী ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনের ভোট বর্জন করবে।
এ ছাড়া বিএনপি নেতারা মনে করছেন, আগামী ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে তামাশা মঞ্চস্থ হতে যাচ্ছে- দেশবাসীর কাছে তা স্পষ্ট। নির্বাচনে নৌকা ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের, বিদ্রোহী প্রার্থীও আওয়ামী লীগের। ১৪ দলের প্রার্থীরাও নৌকা প্রতীকে ভোট করছেন। ২৬ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা সমঝোতার ভিত্তিতে ভোট করছেন। সরকারের সাথে সমঝোতা করে ভোট করছেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী অন্য ছোট দলগুলোও। বিদেশীরাও এই নির্বাচনী তামাশা সম্পর্কে অবগত। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো ইতোমধ্যে এই ডামি, পাতানো নির্বাচন বয়কট করেছে। জনগণকেও ভোট বর্জনের আহ্বান জানিয়ে গণসংযোগ কর্মসূচি করা হচ্ছে। তাদের বিশ্বাস, এমন পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের স্বার্থে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট বর্জন করবে। সরকার ও সরকারি দল জোর না করলে নির্বাচনে ৫ শতাংশের কম ভোট পড়বে। একতরফা এই ভোটের এমন ফলাফল পশ্চিমারাসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ, তারা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে।
বিএনপি নেতাদের ধারণা, নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র কঠোরভাবে ভিসানীতির প্রয়োগ ও ধাপে ধাপে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। এ জন্য নির্বাচনের পর জনগণকে সম্পৃক্ত করে কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হবে। এমন পরিস্থিতিতে দেশী-বিদেশী চাপে সরকার আলোচনার ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গত ১২ জুলাই থেকে একদফার আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। এরপর নির্বাচন বয়কট করে আন্দোলন অব্যাহত রাখে দলটি। প্রায় দুই মাস ধরে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি পালন করা হয়। গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল এবং ১২ দফায় ২৩ দিন অবরোধ কর্মসূচি করে দলটি। এরপর ভোটের তারিখ ঘনিয়ে আসায় আন্দোলন জোরদার করার উদ্যোগ নেয়া হয়। ভোট ঠেকাতে জনগণকে ভোট বর্জনের পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়। জনগণকে ভোট প্রদানে নিরুৎসাহিত করতে দেশব্যাপী গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণের টানা কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি।
জানা গেছে, এমন পরিস্থিতিতে ৭ জানুয়ারির ভোট এবং আন্দোলন সামনে রেখে করণীয় নির্ধারণে গত রোববার সাংগঠনিক সম্পাদকদের নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়ালি দীর্ঘ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কেউ কেউ ভোট ঠেকাতে হরতাল-অবরোধের টানা কর্মসূচি দেয়ার পরামর্শ দিলেও বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে দলের হাইকমান্ড তা আমলে নেয়নি। দলটির পর্যবেক্ষণ, প্রায় দুই মাস ধরে চলা হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি অনেকটাই শিথিল হয়ে পড়েছে। ঝটিকা মিছিলে পালিত হওয়ায় কর্মসূচি দিলেও তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
পাশাপাশি হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে অন্যপক্ষ নাশকতা-সহিংসতা করার সুযোগ পায়। এরপর বিএনপির ওপর তার দায় চাপিয়ে সরকারসহ কোনো কোনো মহল থেকে বিরূপ প্রচারণা চালানো হয়। তা ছাড়া আন্দোলনকে ঘিরে গত ২৮ জুলাই থেকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ২৭ হাজারের অধিক নেতাকর্মী কারাগারে। এমন অবস্থায় কঠোর কর্মসূচি দিলে নতুন করে গ্রেফতার শুরু হতে পারে। তাই বিএনপির কোনো কোনো পক্ষ থেকে ভোট রুখে দেয়া কিংবা প্রতিহত করার কথা আসলেও বাস্তবতা বিবেচনায় সে পথে হাঁটছে না দলটির হাইকমান্ড। এর পরিবর্তে ভোট বর্জনের প্রচারণা জোরদার করবে বিএনপি। দলটি মনে করছে, গণসংযোগ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে যাওয়া যায়। জনগণ ভোট বর্জন করলে নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না।
তিন দিন বাড়ল গণসংযোগ কর্মসূচি : ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জনে দেশব্যাপী চলমান গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণের কর্মসূচি আরো তিন দিন বাড়িয়েছে বিএনপি। আজ মঙ্গলবার থেকে আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলবে। গতকাল সোমবার বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কর্মসূচি বাড়ানোর এ কথা জানান।