করোনাভাইরাসের কারণে চলমান সাধারণ ছুটির মধ্যে নগদ টাকার সঙ্কটে ভুগছে ব্যাংকগুলো। তেমন কেউ টাকা জমা দিচ্ছেন না। কিন্তু লেনদেনকারীদের মধ্যে প্রায় সবাই ব্যাংক থেকে নিজেদের প্রয়োজনে টাকা উত্তোলন করছেন। নগদ টাকার সরবরাহ এতে কমে গেছে। অনেক ব্যাংক চাপ কমাতে পালাক্রমে শাখা খোলা রাখছে। কোনো ব্যাংকের দেড় শ’টি শাখা থাকলে খোলা রাখা হচ্ছে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০টি। ফলে সাধারণ ছুটির দিনে টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন অনেক গ্রাহক। ব্যাংকগুলোর এমন সিদ্ধান্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। লেনদেনের আওতা বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে তাই গতকাল বৃহস্পতিবার কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, লকডাউন থাকলেও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে পরামর্শ করে কমপক্ষে একটি শাখা খোলা রাখতে হবে। আর অনলাইন সিস্টেম না থাকলে সবজায়গায় সীমিত পরিসরে শাখা খোলা রাখতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো: সিরাজুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, সীমিত পরিসরে ব্যাংক লেনদেনের আগে ব্যাংকগুলোকে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকার নগদ টাকার জোগান দেয়া হয়েছিল। সাধারণ ছুটির মধ্যেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিস খোলা রাখা হয়েছে। কোনো ব্যাংক নগদ টাকার সঙ্কটে পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা নিতে পারবে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দেয়া হচ্ছে। এর পরেও কারো নগদ টাকা না থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করার সিস্টেম তথা রেপো সিস্টেম চালু রাখা হয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে যারা অফিস করছেন ওইসব ব্যাংকারের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চালু করা হয়েছে ব্যাংকারদের স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থা। এরপরেও কোনো ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে শাখা বন্ধ রাখাটা মোটেও ঠিক হয়নি। আমরা এ কারণেই ব্যাংকগুলোকে আবারো কঠোর নির্দেশনা দিয়েছি।
তবে ব্যাংকারদের সাথে আলোচনা করে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের এখন অনেকটা পিকটাইম চলছে। এ কারণে অনেকেই আতঙ্কে ঘর থেকে বের হতে চাচ্ছেন না। এর পাশাপাশি বড় সঙ্কট হলো নগদ টাকার। প্রায় তিন সপ্তাহ হলেও করোনাভাইরাসের কারণে সাধারণ ছুটি চলছে। এ সময়ে সাধারণ গ্রাহক তাদের প্রয়োজনে কেনাকাটা করতে ব্যাংক থেকে শুধু টাকাই উত্তোলন করছেন। কেউ আর নগদ টাকা জমা দিচ্ছেন না। এমনকি মাসিক যেসব সঞ্চয়স্কিম ছিল ওইসব স্কিমেও কেউ টাকা জমা দিচ্ছেন না। আর ব্যবসায়ীরাতো কোনো ঋণের কিস্তিই পরিশোধ করছেন না। এতে ব্যাংকগুলোতে ক্যাশ ইনফ্লো নেই, শুধু আউট ফ্লোই হচ্ছে। ফলে প্রতিটি ব্যাংকেরই নগদ টাকার সঙ্কট চলছে। এসব কারণেই ব্যাংকগুলো সীমিত পরিসরে শাখা খোলা রাখছে। যেমন, আজ মিরপুরে শাখা খোলা রাখলে আগামীকাল মীরপুরে বন্ধ রেখে উত্তরায় শাখা খোলা রাখা হচ্ছে। সাধারণ গ্রাহক তাদের চাহিদা অনুযায়ী যেদিন যে এলাকায় শাখা খোলা রাখা হচ্ছে ওইদিন তারা প্রয়োজনে টাকা উত্তোলন করতে পারছেন। এভাবে কোনো ব্যাংকের ২০০ শাখা থাকলে ৪০টি খোলা রাখা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলোর নিজেদের এমন সিদ্ধান্তে বেকায়দায় পড়েছেন সাধারণ গ্রাহক, ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা। কারণ, সাধারণ গ্রাহক তো জানছেন না কবে কোন এলাকায় শাখা খোলা থাকবে। এ কারণে তার প্রয়োজনের দিন না পেলে বিভিন্ন এলাকায় ছোটাছুটি করছেন। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। প্রতিদিন শ্রমিকদের বেতনভাতা দিতে হচ্ছে। কিন্তু শাখা বন্ধ থাকায় তারা শ্রমিকদের বেতনভাতা দিতে পারছেন না।
এসব সমস্যার কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকের লেনদেনের আওতা বাড়িয়ে কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারি করা এক সার্কুলারে বলা হয়েছে, প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি শাখা খোলা রাখতে হবে। আর যেসব ব্যাংকের অনলাইন সিস্টেম নেই তাদের প্রতিটি শাখাই সীমিত পর্যায়ে খোলা রাখতে হবে। মালিকরা যেন শ্রমিকদের বেতন দিতে পারেন এ কারণে প্রতিটি শ্রমঘন এলাকায়ই প্রতিটি ব্যাংকের শাখা খোলা রাখতে হবে। এমনকি কোনো এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন লকডাউন করলেও সেখানেও স্থানীয় প্রশাসনের সাথে আলোচনা করে কমপক্ষে প্রতিটি ব্যাংকের একটি শাখা সীমিত পর্যায়ে হলেও খোলা রাখতে হবে। একই সাথে মহানগর ও বিভাগীয় পর্যায়ে সব এডি শাখা (যেখানে বৈদেশিক লেনেদেন সম্পূর্ণ হয়) খোলা রাখতে হবে। তবে দেশের অন্যান্য এলাকায় স্বীয় বিবেচনায় নির্বাচিত এডি শাখা খোলা রাখতে হবে। এ ছাড়া স্থানীয় প্রশাসন ও বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে সমুদ্র, স্থল, বিমান বন্দর এলাকায় ব্যাংক শাখা খোলা রাখতে হবে।
উল্লেখ্য, ১৯ এপ্রিল থেকে ব্যাংক লেনদেনের সময়সীমাও আধা ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত লেনদেন করা হয়। কিন্তু আগামী ১৯ এপ্রিল থেকে আরো আধঘণ্টা বাড়িয়ে ১টা পর্যন্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক লেনদেন তিন ঘণ্টা করতে হবে। এরপরেও কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে কোনো গ্রাহক অভিযোগ করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।