উচ্চহারে মূল্যবৃদ্ধির চাপে এমনিতেই দিশাহারা অবস্থা ভোক্তাদের; এর মধ্যে নানা অজুহাতে নানা কায়দায় পকেট কাটতে তৎপর অসাধু ব্যবসায়ীরা। ঘরের বাইরে পদে পদে প্রতারণার ফাঁদ। চলছে ভোক্তা ঠকানোর মচ্ছব। এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ বিক্রিতেও চলছে প্রতারণা। নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল পণ্যে বাজার সয়লাব। চলছে মিথ্যা ও চটকদার বিজ্ঞাপন এবং তথ্য দিয়ে পণ্য বিক্রি। সাম্প্রতিক বাজার তদারকির অভিযানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। কিন্তু পরিত্রাণ মিলছে না। ভোক্তাদের অধিকার এখনো কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার থেকে শুরু করে অনলাইন প্ল্যাটফরমে কেনাকাটা, ই-কমার্স সেবা, গণপরিবহনের ভাড়া, ই-টিকিটিং, ডিজিটাল আর্থিক খাতে প্রতারণা, ওষুধের বাজার, মিথ্যা বিজ্ঞাপন ও মনগড়া সার্ভিস চার্জসহ বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিনিয়ত ভোক্তা অধিকার ক্ষুণœ হচ্ছে।
এমন বাস্তবতার মধ্যেই আজ ১৫ মার্চ সারাদেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ি, ভোক্তার স্বার্থে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করি’। ১৯৮৩ সাল থেকে প্রতিবছর এ দিনটি বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে আসছে। দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ও ভোক্তা অধিকার বিরোধী কাজ প্রতিরোধে ২০০৯ সালে প্রণীত হয় ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন’। ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করার রূপকল্প নিয়ে একই বছর যাত্রা শুরু করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর ১৫ বছর পার হলেও সংস্থাটির সক্ষমতা উল্লেখ করার মতো বাড়েনি। জনবলের স্বল্পতায় কার্যক্রম পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছে সংস্থাটি। তবে বাজার তদারকি অভিযানসহ সংস্থাটির বিভিন্ন পদক্ষেপে ভোক্তা অধিকার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এখনো অভিযোগ জানানোর প্রক্রিয়া জানেন না বেশিরভাগ ভোক্তা।
এদিকে দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত কয়েক বছরে ভোক্তা অধিদপ্তর অনেকটাই সক্রিয়। এতে সংস্থাটির কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বেড়েছে। তবে সংস্থাটিতে জনবলের সংকটসহ নানা সমস্যা রয়েছে। তা ছাড়া একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এত বড় জনসংখ্যার ভোক্তা স্বার্থরক্ষা করাটাও কঠিন। তাই ভোক্তা স্বার্থরক্ষায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা আরও বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনটি ২০০৭-২০০৯ সালের প্রেক্ষাপটে করা হয়। কিন্তু ২০২৪ সালে অনেক প্রেক্ষাপট বদলেছে। সুতরাং আইনটি যুগোপযোগী করা
সময়ের দাবি।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে আইন আছে। কিন্তু বাস্তবে অধিকার সংরক্ষণ নয়, পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে। আইন হয়েছে, কিন্তু সেটি প্রয়োগে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি হয়নি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ মানে কেবল অভিযোগ নিষ্পত্তি ও অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা নয়। এভাবে হবে না। এটার পরিধি ব্যাপক। এটার সঙ্গে প্রয়োজন সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনেতিক উন্নয়ন, সুষম আয়ের বণ্টন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। তা ছাড়া ভোক্তা অধিদপ্তরে যথেষ্ট জনবল নেই। আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক জনবল বাড়িয়ে ভোক্তা অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করতে হবে। এ ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ভোক্তা স্বার্থবিষয়ক আলাদা একটি বিভাগ গঠন কিংবা পৃথক একটি মন্ত্রণালয় গঠন করা যেতে পারে। যেটা পাশের দেশ ভারতেও রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে সেভাবে গোছানো পদক্ষেপ নেই। বাজারে ভোক্তারা বেশি কষ্টে রয়েছেন। অথচ বাজার নিয়ন্ত্রণে আমাদের দেশে যেটা দেখা যায়- মোবাইল কোর্ট, মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়াসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ। এগুলোয় খুব একটা সমাধান মেলে না। সমস্যার গোড়ায় হাত দিতে হবে। আমাদের আমদানিতে খরচ, সরবরাহ ও বিক্রিতে কত খরচ হচ্ছে, অবৈধ মজুদ হচ্ছে কিনা, পণ্যটিতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার রয়েছে কিনা ইত্যাদি মনিটরিং করতে হবে। এসব তথ্য সরকারের কাছেই আছে।
পদে পদে ভোক্তাদের ঠকতে হচ্ছে
দেশের পণ্য বাজারে দেখা যাচ্ছে, অতিমুনাফা করতে বছরের নির্ধারিত সময় অসাধু ব্যবসায়ীরা সক্রিয় হয়ে উঠছে। রমজান মাসসহ সারা বছরের বিভিন্ন সময় নানা অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট কাটছে তারা। নিরুপায় হয়ে ভোক্তারাও বাধ্য হচ্ছেন বেশি দামে পণ্য কিনতে। এর পর নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য কিনে প্রতারিত হচ্ছেন অনেকেই। ই-কমার্স খাতে পণ্য কেনাবেচায় প্রতারণা থেমে নেই। ভোক্তাদের অভিযোগ, ই-কমার্সের নানা প্রতারণার অভিযোগ দিয়েও সমাধান পাননি তারা। অসংখ্য ভোক্তা আটকেপড়া টাকা ফেরত পাননি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের একটি বাণিজ্যিক পেইজ থেকে জামা কিনে প্রতারিত হয়েছেন রাজধানীর কদমতলীর বাসিন্দা মো. বিপ্লব হোসেন রানা। তিনি বলেন, ফেসবুক পেইজে যা দেখেছি তা হাতে পাইনি। নকল ডিজাইন ও নিম্ন মানের কাপড়ে তৈরি জামা ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ ডেলিভারিম্যান কিংবা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দায় এড়িয়ে গেছে। বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানকে বারবার চেষ্টা করলে নাম্বার ব্লক করে দিয়েছে।
রান্নার এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের অতিরিক্ত দাম নিয়ে বেসরকারি চাকরিজীবী মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এমনিতেই সিলিন্ডারের দাম আগের চেয়ে বেশি। তার ওপর সরবরাহকারীদের কাছ থেকে আরও বেশি দামে কিনতে হয়। এ থেকে পরিত্রাণ কোথায়?
প্রতিদিনের যাতায়াতে অতিরিক্ত বাস ভাড়া নিয়ে আক্ষেপ করে বেসরকারি চাকরিজীবী মো. কৌশিক আহমেদ বলেন, দূরত্ব অনুযায়ী নয়, বরং সিটিং, ওয়েবিল ইত্যাদি নানা অজুহাতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। বাসে উঠলেই ১০ টাকা ভাড়া। এভাবে ভোক্তা ঠকিয়ে প্রতিদিন বিপুল টাকা লুটে নেওয়া হচ্ছে, কেউ দেখার নেই।
রাজধানীর বাসাবো এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, রোজা আসার সঙ্গে সঙ্গে শসা, লেবু, বেগুন, শরবতের পাউডার, ইসুবগুলের ভুসি, খেজুরসহ সব পণ্যের দাম এক লাফে বাড়িয়ে দেওয়া হলো, সেটি দেখার কি কেউ নেই? বাজারে জিম্মি আমাদের মতো ক্রেতারা প্রতিদিন বেশি দামে কিনে ঠকছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার অন ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকের (সিআইআরডিএপি) পরিচালক (গবেষণা) ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন মনে করেন, নীতি প্রণয়নে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি না থাকায় এবং সমন্বয়হীন সিদ্ধান্তের ফলে সমাধান মিলছে না। এতে শুধু ভোক্তা নয়, উৎপাদনকারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
অভিযোগ ও নিষ্পত্তি
আইন অনুযায়ী, প্রতারিত ব্যক্তি আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নির্দিষ্ট ফরমে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করতে হবে। কিন্তু বাস্তবচিত্র হচ্ছে বেশির ভাগ ভোক্তাই জানেন না কীভাবে অভিযোগ করতে হয় কিংবা অধিদপ্তরের হটলাইন নাম্বার কত।
তবে ভোক্তা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, অতীতের চেয়ে অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে। গত অর্থবছরে (১ জুলাই ২০২৩ থেকে ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত) অধিদপ্তরে মোট ২২ হাজার ২৫৫টি অভিযোগ দাখিল হয়েছে। যার মধ্যে ১৮ হাজার ১১৫টির নিষ্পত্তি করা হয়েছে। আগের ২০২২-২৩ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে অভিযোগের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৫ হাজার ৬০৫ ও ২৫ হাজার ৩৪৬টি।
চলতি অর্থবছরে (গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) অধিদপ্তর ৬ হাজার ৯৬১টি বাজার অভিযান পরিচালনা করেছে। এতে ১৫ হাজার ২৯৬টি প্রতিষ্ঠানকে ১১ কোটি ১২ লাখ ৯১ হাজার ৭০০ টাকা জরিমানা ও আদায় করা হয়েছে। একই সময়কালে নিষ্পত্তির মাধ্যমে দ-িত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৪৯০টি। সব মিলিয়ে মোট ১১ কোটি ৪০ লাখ ৮১ হাজার ৮০০ টাকা জারিমানা করা হয়েছে।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, জনবল সংকট থাকা স্বত্বেও মানুষের আস্থা অর্জনে নিরলসভাবে কাজ চলছে। আইন প্রয়োগে অধিদপ্তর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। ভোক্তার প্রতিটোগ আমলে নেওয়া হচ্ছে। সেগুলো নিয়মিত নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। বর্তমানে আমরা সমন্বিত মনিটরিং করছি। আগামীতে মনিটরিং আরও জোরদার হবে।