আজ রমজানের প্রথম জুমা। বরকতময় জুমা। সওয়াবের বসন্তপ্রবাহ। জুমার দিনে সুরা কাহাফের তেলাওয়াত করা, দান-সদকা করা ও দরুদ শরিফের আমল করার কথা আছে। এ ছাড়াও দিনটির বিশেষ গুরুত্ব কোরআন হাদিসে এসেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, হে মুমিনরা! জুমার দিন যখন নামাজের আজান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে এসো এবং বেচাকেনা বন্ধ করো, এটা তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বোঝ। এরপর নামাজ শেষ হলে জমিনে ছড়িয়ে পড়ো, আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ করো এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো যাতে তোমরা সফলকাম হও। সূরা জুমা : ৯-১০
জুমার দিনের ফজিলত বিষয়ে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সকল দিনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিন হলো জুমার দিন। এই দিনেই আদম (আলাইহিস সালাম)কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এদিনেই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে। এই দিনেই তাকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছে। আর এই জুমার দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। বুখারি-১৫০২
আজ রোজার চতুর্থদিন। চারদিকে রহমতের উৎসব। রমজানের অবারিত রহমতে ভরে যাক আমাদের জীবন। যে কোরআনের প্রেমময়তায় আজ রমজান রহমতে ভরপুর, কোরআনের মুগ্ধতায় লাইলাতুল কদর হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ রাত! কোরআন এসেছিল বলে মক্কা-মদিনা পৃথিবীর মর্যাদাবান শহর! কোরআনের নবী হজরত মুহাম্মদ নবীদের সরদার! কোরআনের সেই প্রেম, মুগ্ধতা ও মর্যাদা আমাদের কতটা আলোকিত করেছে?
মাস, রাত আর মক্কা-মদিনার মর্যাদা বাড়াতে কোরআন আসেনি পৃথিবীতে। কোরআন এসেছে মানুষের জীবন রাঙাতে। শুধু রাত শ্রেষ্ঠ হবে না; কোরআনের মানুষেরাও হবে আশরাফুল মাখলুকাত। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষ। কোরআন সে তো আল্লাহ প্রেমের চিঠি। পাঠে পাঠে সজীব হয় দেহমন। জোগায় আত্মিক শক্তিও। প্রেমের চিঠি প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালাও বলেন, যারা ঈমানদার, তারা যখন আল্লাহর নাম নেয়, নরম হয় তাদের অন্তর। আর যখন তাদের সামনে কোরআন পাঠ করা হয়, তাদের ঈমান সজীব হয়ে ওঠে। তারা মওলার প্রেমে আত্মনিবেদিত হয়। সূরা আনফাল : ২
পবিত্র রমজানে পৃথিবীর ২৫ লাখ মসজিদে কোরআনুল কারিমের তেলাওয়াত হয়। এদেশের প্রায় ৫ লক্ষ মসজিদে তারাবির নামাজেও ভাব আবেগ ও মুগ্ধতায় পাঠ হয় পবিত্র কোরআন। হজরত রাসুল সা. বলেন, কোরআন তেলাওয়াতকারী প্রতিটি বর্ণে দশটি সওয়াব পায়। আমি বলছি না, ‘আলিফ লাম মিম’ এর মধ্যে একটি অক্ষর। বরং আলিফ আলাদা, লাম আলাদা, মিম আলাদ বর্ণ। সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ৩০৭৫ প্রতিটির জন্য ভিন্ন সওয়াব।
সওয়াবের নেশায় রাতজাগা চোখ-কান শুনবে তেলাওয়াত। বরাবরের মতো হাফেজ সাহেবরা কোরআন পাঠ করবেন। আমরা শুনব। মনভরে উপভোগ করব কোরআনের সুর। নেকি লাভ করব। কিন্তু আমরা যদি কোরআনের চর্চায় আত্মনিয়োগ করি; বিশুদ্ধ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে কোরআনের ভাব ভাষা অনুধাবন করি; দীর্ঘ জীবনে আমিও হয়ে উঠতে পারি কোরআনের একজন ছাত্র। কোরআনের অলিগলি ভ্রমণকারী শিক্ষার্থী। আমাদের যাপিতজীবনে কোরআন হয়ে উঠবে আরাধ্য।
কোরআনের উৎসবমুখর মাস রমজান। মানুষ হেদায়াতের প্রত্যাশায় মুখিয়ে থাকে। রমজানে মসজিদ ভরে যায় মুসল্লিতে। ফরজ নামাজ তো বটেই, তারাবি হয়ে ওঠে কোরআনের উৎসব। ইফতার উপলক্ষেও কানায় কানায় ভরে যায় মসজিদ। রোজার জুমায় মানুষের ঢল। কিয়ামুল লাইল বা শেষ রাতের তাহাজ্জুতেও মসজিদ প্রাণবন্ত থাকে। মসজিদমুখী মানুষেরা কোরআনের আলোয় জীবন রাঙাতে চায়। হেদায়াতের নেশায় ব্যাকুল মানুষেরা শুনতে চায় কুরআনের মর্মকথা। কোরআনের ইতিহাস ও গল্পে ফিরে যেতে চায় আগের নবী-রাসুলদের জীবনে। জান্নাতের হৃদয়কাড়া বর্ণনা ও জাহান্নামের ভয়াবহতা কোরআনের ভাষায় স্বাদ নিতে চায় মানুষেরা। কোরআনের পরিবার ও সমাজ নীতি শিখতে চায় মুসল্লিরা। ইসলামের জীবন সৌন্দর্য কোরআনে কীভাবে আছে? আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনায় কোরআনের মনোভাব কী? এমন সব প্রশ্নের জবাব জানতে আগ্রহী মানুষেরা। আল্লাহর প্রেমে মজে থাকার এই প্রেমপত্র পাঠ করে বুঝতে চায় অভাগারা। কিন্তু কই? কে শোনাবে তাদের কোরআনের গল্প? কে দেবে কোটি পিপাসিত হৃদয়ে কারআনের সবক? দেশের প্রতিটি মসজিদে ইমাম-খতিব, বিজ্ঞ আলেম, মুফতি, মুফাসসিররা যদি মসজিদমুখী মানুষদের এই প্রত্যাশা পূরণে এগিয়ে আসতেন! সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি মানুষকে কোরআনের ছাত্রে পরিণত করতেন! প্রতিদিন তারাবির আগে-পরে বা অন্য কোনো সময় ধারাবাহিক বলতেন আজকের পঠিত আয়াতের তরজম-তাফসির বা কোরআনের বিশেষ আলোচনা! প্রতিদিন যদি বসত কোরআনের উৎসব! মানুষ কোরআন চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে উঠত। যাপিতজীবনে আসত কোরআনিক ছোঁয়া। জীবনে এমন কয়েকটি রমজান পেলে কোরআনময় হয়ে উঠত প্রতিটি মানুষের জীবন। রমজান শেষে মুসল্লিশূন্য হতো না মসজিদগুলো। কোরআনের পরশে বছরব্যাপী প্রাণবন্ত থাকত মানুষের মনদিল। কিন্তু কোরআনের কার্যকর প্রেম, ভালোবাসা, অর্থ ও মর্ম বোঝার গতি ক্রমেই কমে আসছে আমাদের জীবনে। শিল্পনন্দিত মুদ্রিত কোরআন বুকে নয়, আমরা সাজিয়ে রাখি শোকেসে। মাঝেমধ্যে চুমো খেয়ে সম্মান জানাই। এমনো হয়, শ্রদ্ধাভরে ঘরের কোরআনটি পাঠিয়ে দিই মসজিদে। বাসাবাড়িতে এত সামগ্রীর ভিড়ে কোরআন রাখব কোথায়! ওই আদুরে ছেলের মতো, যে মাকে উদ্দেশ করে বলে, বাসায় তোমার কষ্ট হয়, বৃদ্ধাশ্রম ভালো লাগবে। বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমের জীবন্ত কবরে পাঠিয়ে ছেলে যে তৃপ্তি পায়, ঘরের কোরআন মসজিদে পাঠিয়েও আমাদের সে রকম উপলব্ধি। সত্যিই কোরআনের মর্মকথা আমরা বুঝি না। খুব সহজে রঙিন মোড়কে আমরা কোরআন পেয়েছি বলে।
একটি আয়াতের জন্য সাহাবির দিনের পর দিন পথে অপেক্ষার কষ্ট আমরা কি অনুভব করতে পারব? আল্লাহ বলেন, এক কল্যাণময় কিতাব আমি অবতীর্র্ণ করেছি। যাতে মানুষ কোরআন অনুভব করে। বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা তা উপদেশ হিসেবে গ্রহণ করে। সূরা সদ : ২৯
প্রভু! কোরআনের মর্মোপলব্ধি করার শক্তি দাও আমাদের!
শিক্ষক : শেখ জনূরুদ্দীন রহ. দারুল কুরআন মাদরাসা, চৌধুরীপাড়া, ঢাকা