বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া তথ্য বলছে, বিদেশী ঋণ এক শ’ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে গত ডিসেম্বরেই। অর্থাৎ ডলার প্রতি মূল্য ১১০ টাকা করে হিসেব করলে বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশী ঋণের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র গণমাধ্যমকে বলেছেন, ঋণের পরিমাণ এক শ’ বিলিয়ন ডলার ছাড়ালেও তা জিডিপির তুলনায় বেশি নয়, বরং আরো ঋণ নেয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিডিপির তুলনায় এক শ’ বিলিয়ন ডলার ঋণ বেশি না হলেও রাজস্ব আয়, রফতানি এবং রেমিট্যান্স না বাড়াতে পারলে এবং একইসাথে বিদেশী ঋণের প্রবাহ কমিয়ে না আনতে পারলে এ ঋণই বিশাল চাপ তৈরি করতে পারে আগামী কয়েক বছরে।
বিশেষ করে ডলার সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এমনিতেই চাপের মধ্যে রয়েছে এবং এর মধ্যেই চলতি বছর থেকেই বড় বড় কিছু প্রকল্পের ঋণের কিস্তি শোধ করাও শুরু হয়েছে।
পাশাপাশি রফতানি ও রেমিট্যান্সও কাঙ্ক্ষিত আকারে বাড়ানো যাচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতিতে ডলারের সরবরাহ না বাড়ানো গেলে বিদেশী ঋণকে ঘিরে সঙ্কট জোরালো হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে বলছেন বিশ্লেষকরা।
বিশেষ করে যখন মেগা প্রকল্পগুলোর মূল অর্থ পরিশোধ শুরু হবে তখন পরিস্থিতি কেমন হয় তা নিয়েই উদ্বিগ্ন অনেকে।
ঋণের মূল অর্থ দিতে হবে কখন
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, কিছু মেগা প্রকল্পের মূল অর্থ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৬-২৭ অর্থবছরে এবং সেই বছরে ৫৩১ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করার কথা রয়েছে।
এরপর ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ৫১৯ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৮-২৯ সালে ৫০৭ মিলিয়ন ডলার শোধ করার আশা করছে সরকার।
অন্যদিকে, ২০২২-২৩ বছর থেকেই যে বৈদেশিক ঋণ শোধ করা শুরু হয়েছে সেগুলো মূলত ঋণের সুদ।
সরকারি হিসেব মতে, আগামী জুলাই থেকে শুরু হওয়া অর্থবছরে বিদেশী ঋণ হিসেবে চার দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার শোধের পরিকল্পনা আছে সরকারের।
এরপর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সুদসহ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়াবে কমপক্ষে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে মূলত ভারত, চীন এবং রাশিয়ার কাছ থেকেই ঋণ নিয়েছে বেশি। এসব প্রকল্প সময়মত শেষ না করতে পারলে ঋণ আরো বাড়তে পারে।
তবে সব মিলিয়ে একটি দেশের বিদেশী ঋণ হচ্ছে, ওই দেশটি বিভিন্ন দেশ, বিদেশী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যে ঋণ নেয় সেটি।
বাংলাদেশ সাধারণত বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে।
‘এটি সঙ্কট নয়, তবে অস্বস্তির’
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, জিডিপির অনুপাতে বিদেশী ঋণ এখনো কম- এটি সত্যি, কিন্তু এ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার কোনো অবকাশ নেই।
‘মনে রাখতে হবে ঋণের ব্যবহার কেমন হচ্ছে এবং সেখান থেকে ডলারের অংকে উৎপাদনশীলতা আসছে কি না- এটি নিশ্চিত করতে না পারলে সামনে সঙ্কট তৈরি হবে,’ বলছিলেন তিনি।
অর্থনীতিবিদদের হিসেবে জিডিপির অনুপাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ এখন ২৩ থেকে ২৫ শতাংশের মতো। আবার বিদেশী ঋণ হিসেবে যে অর্থ বাংলাদেশ নিয়েছে তার মধ্যে বিভিন্ন ধরণের ঋণ আছে।
জাহিদ হোসেন বলছেন, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক ঋণ বেশি বেড়েছে। এগুলোর মেয়াদ কম কিন্তু খরচ বেশি।
যেমন- রূপপুর পরিমাণ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে এবং পদ্মা সেতুতে রেল লাইন সংযোগ প্রকল্পের জন্য চীন বাণিজ্যিক চুক্তিতে শর্তযুক্ত ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ।
‘এখন ধরুন, রূপপুর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ এলো এবং সেটি অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখলো। দেশের রফতানিও বাড়লো। তাহলে সমস্যা হবে না। কিন্তু যদি প্রকল্প পেছাতে থাকে এবং সময়মত রিটার্ন না আসে – তাহলেই ঋণটা চাপ হয়ে উঠবে,’ বলছিলেন জাহিদ হোসেন।
আবার ডলার প্রবাহ না থাকলে সেটাও বহি:বাণিজ্যিক ভারসাম্যে যেমন চাপ তৈরি করবে, তেমনি বাজেটেও চাপ তৈরি করবে।
সেক্ষেত্রে রাজস্ব আদায় না বাড়লেও ঋণ পরিশোধ কিন্তু সরকারকে করতেই হবে। সে কারণে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, বিদেশী ঋণ জিডিপির তুলনায় যেমনই হোক দেখতে হবে সেটি রফতানির বিবেচনায় কেমন।
‘এভাবে দেখলে বিষয়টি হবে অস্বস্তির। কারণ সত্যিকার অর্থে রফতানির প্রবৃদ্ধি এখন কম। অথচ ঋণটা দ্রুত বাড়ছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তবে তা সত্ত্বেও এক শ’ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ হয়ে গেছে বলে এতে ঠিক ‘সঙ্কট’ বলতে চান না তিনি। বরং তার ভাষ্য হলো- ‘এটি অস্বস্তির’।
উত্তরণের উপায় কী
আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বিদেশী ঋণ নিয়ে এ অস্বস্তি মোকাবেলা করতে হলে এখনই ঋণ প্রবাহ কমিয়ে আনতে হবে, বিশেষ করে বাণিজ্যিক শর্তে ঋণ নেয়া অর্থাৎ সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিট কমাতে হবে।
‘রাজস্ব আয়, রফতানি ও রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। তবে বাস্তবতা হলো রফতানি নির্ভরশীল হয়ে আছে একটি পণ্যের ওপর, যা অত্যন্ত ঝুঁকির বিষয়।’
‘আবার রেমিট্যান্স প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না। অর্থ পাচারের কারণে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। তবে আমরা যদি দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারতাম তাহলে এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অনেক বাড়তো,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
জাহিদ হোসেনও বলছেন যে রফতানি ও রেমিট্যান্স না বাড়াতে পারলে বিদেশী ঋণ ভবিষ্যতে সঙ্কটের জন্ম দিতে পারে।
‘রাজস্ব আয় না বাড়ালে সরকারের ব্যয় কমানো একটি বিকল্প হতে পারে। এছাড়া নতুন ঋণ দিয়ে পুরনো ঋণ পরিশোধ অর্থাৎ রিফাইনান্সিংও অন্য একটি বিকল্প হতে পারে। তবে যেসব ব্যয় এখনই দরকার নেই, সেগুলো থেকে সরকার বিরত থাকলে ঋণের চাপ কমবে,’ বলছিলেন তিনি।
এই দু’জন অর্থনীতিবিদই মনে করেন, বিদেশী ঋণের বিপরীতে টাকায় অর্থাৎ স্থানীয় মুদ্রায় রিটার্ন আসার কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ার কারণেও বিদেশী ঋণের ব্যয় বেড়ে যেতে পারে।
সেজন্য বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য যে বিদেশী ঋণ অপেক্ষমাণ আছে সেগুলোর অতিরিক্ত সুদের ব্যয় এড়াতে দ্রুত ব্যবহার দরকার বলেও মনে করেন তারা।
তবে, এত সতর্কতা ও উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও আগামী দু’টি অর্থ বছরে সরকারের বিদেশী ঋণের পরিমাণ আরো বাড়ার সম্ভাবনা আছে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
এর বিপরীতে রাজস্ব আদায়ে যে লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরে নির্ধারণ করা হয়েছিল সেটি কতটা অর্জিত হয় তা নিয়েও অর্থনীতিবিদদের মনে সংশয় আছে।
চলতি অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাঁচ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিলো সরকার।
এ সময়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায় করার কথা। আর বাকি অর্থ অন্য উৎস থেকে সংগ্রহ করার কথা রয়েছে।
সূত্র : বিবিসি