কুয়েত থেকে দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন প্রায় সাড়ে চার হাজার বাংলাদেশী। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর তারা ২০-২৫ দিন ধরে দেশটির সিভদী, আবদালী, মাঙ্গাফ ও কসর নামে চারটি ক্যাম্পে হোম কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন। তাদের মধ্যে ইতিমধ্যে দুইজন স্ট্রোক করে মারা গেছেন। দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পে থাকার পরও দেশে ফিরতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন এসব প্রবাসী। রোববার দেশটির স্থানীয় সময় মধ্যরাতে সিভদী ও আবদালী ক্যাম্পে থাকা প্রবাসীরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। মারা গেছেন তিনজন। সর্বশেষ গতকাল সিভদী ক্যাম্পে দেশে ফেরার অপেক্ষায় থাকা চাঁদপুরের হাজিগঞ্জের কাজিগাঁও গ্রামের আমরান (৪৩) স্ট্রোক করে মারা গেছেন। এর কয়েকদিন আগে একই ক্যাম্পে আরো একজন মারা যান বলে জানা যায়। গত ২ মে মারা দেশটির আবদালি ক্যাম্পে মারা গেছেন কুমিল্লার রবিউল ইসলাম।
কুয়েত সরকার গত ১ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সে দেশে অবস্থিত অবৈধ প্রবাসীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। এরপর বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে চার হাজার অবৈধ প্রবাসী সাধারণ ক্ষমার জন্য আবেদন করেন। যারা আবেদন করবে তাদের দেশে ফেরানোর বিমানভাড়াসহ যাবতীয় খরচ বহন করবে কুয়েত সরকার। কিন্তু প্রায় এক মাস ক্যাম্পে থেকেও দেশে ফিরতে না পেরে ক্ষুব্ধ প্রবাসীরা দেশটির সিভদী ও আবদালী ক্যাম্প থেকে রাস্তায় বের হয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। রোববার দেশটির স্থানীয় সময় মধ্যরাতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভসহ দেশে ফেরত আসার জন্য বিভিন্ন সেøাগান দেন হাজারো প্রবাসী বাংলাদেশী। কুয়েতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণ করে।
সিভদী-ক্যাম্পে থাকা কুমিল্লার রিফাত এই প্রতিবেদককে বলেন, কুয়েতে আছি তিন বছর ধরে। সাধারণ ক্ষমায় আত্মসমর্পণ করার পর হোম কোয়ারেন্টিনে আছি ২২ দিন ধরে। আমাদের ক্যাম্পে দুই হাজারেরও বেশি লোক রয়েছেন। প্রথম যেদিন আত্মসমর্পণ করি, বলা হয়েছিল পাঁচ দিন পরই ফ্লাইট দেয়া হবে। এরপর বলে ৩০ এপ্রিল। কিন্তু এখন দূতাবাসের পক্ষ থেকে কোনো খোঁজই নেয়া হয় না। আমাদের এখানে ইতোমধ্যে দুইজন স্ট্রোক করে মারা গেছেন। প্রত্যেক দিন একই খাবার আমাদের দেয়া হচ্ছে। গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। গতকাল রাতে সবাই বিক্ষুব্ধ হয়ে ক্যাম্পের গেটে গিয়ে বিক্ষোভ করেছি। পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুড়েছে। প্রায় ৩ ঘণ্টা ওখানে ছিলাম আমরা।
কুয়েতের আবদালি ক্যাম্পে থাকা আশরাফুল বলেন, দুই বছর আগে কুয়েতে এসেছি। আমাদের কোম্পানির নাম আল কোর্তাস। এখানে আসার পর প্রাথমিকভাবে বৈধতা পাই। তারপর আর আকামা দেয়নি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমরা জানতে পেরেছি আল কোর্তাস নামে যে কোম্পানিতে এসেছি তাদের নামে কুয়েত সরকার ৭০টি ভিসার অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্তু তারা জালিয়াতি করে ৭০০ লোক নিয়ে আসে। ধরা পড়ার পর ওই কোম্পানি নিষিদ্ধ করা হয়। এই কোম্পানির দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বারেক নামের একজন। তার মাধ্যমেই বেশির ভাগ লোক কুয়েতে আসি। কুয়েতে তার ১০ বছর জেল হয়েছে। তিনি পালিয়ে চলে গেছেন। আবদালি ক্যাম্পে আমরা প্রায় দুই হাজার মানুষ রয়েছি। কুয়েত সরকার আমাদের ক্ষমা করে দিয়েছে। অনেক দিন অপেক্ষায় আছি বাড়ি যাব। করোনাভাইরাসের এই সময় এখানে কত সমস্যা। কিন্তু আমাদের দেশে নেয়ার কোনো লক্ষণ নেই। দূতাবাসের নম্বরে ফোন দিলে ধরে না।
কচুর ক্যাম্পে থাকা মোহাম্মাদ শামীম নামের এক প্রবাসী- বলেন, ২৫ দিন ধরে ক্যাম্পে রয়েছি। প্রথম দিকে খাওয়া দাওয়া ছিল ঠিকভাবে। প্রথম রমজান থেকে সমস্যা। অন্যান্য রাষ্ট্রের লোকজনকে ফ্লাইট দিয়েছে। আমাদের কেন দেশে নেয়া হচ্ছে না? এখানে কী যে সমস্যা তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। ইতিমধ্যে ৩ জন মারা গেছেন বিভিন্ন ক্যাম্পে। আর সপ্তাহ খানেক থাকলে আমাদের অনেকেই মারা যাবে। কারণ এখানে অনেক বয়স্ক লোকও রয়েছেন। তিনি বলেন, ডাক্তারি পরীক্ষা হচ্ছে নিয়মিত। আমরা করোনামুক্ত। আমাদের ক্যাম্প ৮শ’র মতো লোক আছে, যার মধ্যে বাংলাদেশী ৭শ’র মতো। একই ক্যাম্পে রয়েছেন ফেনীর দাগনভূঁইয়ার আব্দুল খালেক। তিনি বলেন, ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে কুয়েত প্রবাসী আমি। অবৈধ হয়েছি গত ২৫ মার্চ থেকে। সরকার যেহেতু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে, তাই দেশে ফেরার জন্য আত্মসমর্পণ করেছি। গত ১২ এপ্রিল থেকে ক্যাম্পে আছি। কিন্তু, আমাদের ফ্লাইট দেয়া হচ্ছে না।
কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, কুয়েতে এক লাখ ৬০ হাজার অবৈধ অভিবাসী রয়েছে। এবার ২০২০ এর সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়েছেন ২৫ হাজার অবৈধ অভিবাসী। অর্থাৎ এখনো এক লাখ ৩৫ হাজার অবৈধ অভিবাসী সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নেয়া থেকে বিরত রয়েছেন। তবে এর মধ্যে বাংলাদেশী কত জানা যায়নি। অবশ্য কুয়েতে প্রায় ১৫ থেকে ১৭ হাজার অবৈধ অভিবাসী বাংলাদেশী রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। এর মধ্যে ২০১৮ সালের সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়েছিলেন আট হাজার বাংলাদেশী। এবার ২০২০ সালের সাধারণ ক্ষমায় এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার অবৈধ অভিবাসী বাংলাদেশী সাধারণ ক্ষমার আবেদন করেছেন। রাজধানী কুয়েত সিটির বাইরে চারটি ক্যাম্পে তাদের রাখা হয়েছে। ক্যাম্প গুলো হলো, আব্দালীয়া, সেভদি, মাঙ্গাফ ও কসর।
ক্যাম্পে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশীরা জানান, সাধারণ ক্ষমার অধীনে যেসব কর্মী দেশে ফিরে আসবে তাদের কোনো জেল/জরিমানা হবে না বরং তাদের বিনামূল্যে টিকিট দেয়া হবে এমন প্রতিশ্রুতিতে তারা আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু এখন তাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, কুয়েত প্রবাসীরা আমাদের সাথেও যোগাযোগ করছেন। সাধারণ ক্ষমার বিয়ষটি আমরা অবগত। তবে করোনার এই সঙ্কটকালীন সময়ে যেহেতু ফ্লাইট চলাচল বন্ধ কাজেই হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া সবার জন্যই কঠিন। তবে সাধারণ ক্ষমতায় নিবন্ধিতদের মধ্যে ১২৬ জন গত ২৭ এবং ১২১ জন গত ২৮ এপ্রিল আলজাজিরা এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে দেশে ফেরত আনা হয়েছে। বাকিদের বিষয়েও সরকার ও দূতাবাস অবগত বলেই আমরা মনে করছি। দূতাবাস এই প্রবাসীদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের আশ্বস্ত করতে পারে। এ ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নবনিযুক্ত সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, সেদেশ থেকে জেলমুক্তদের দেশে ফেরানোর বিষয়টি চূড়ান্ত হলেও যারা সাধারণ ক্ষমায় আত্মসমর্পণ করেছেন তাদের দেশে ফেরানোর বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আলোচনার মাধ্যমেই তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে বলে জানান তিনি।