শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১১ পূর্বাহ্ন

দুঃসংবাদ এবং সুসংবাদ

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৫ মে, ২০২০
  • ২৬৪ বার
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: করোনা নিয়ে দুঃসংবাদ এবং সুসংবাদ দুই-ই আছে। সুসংবাদটা যেমন দিয়েছেন একজন বিজ্ঞানী। তেমনি দুঃসংবাদটাও দিয়েছেন আরেক শ্রেণির বিজ্ঞানীই। যাঁরা সুসংবাদ দিয়েছেন, তাঁরা বলেছেন, লকডাউন উঠে যাওয়া এবং মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু করলে করোনাভাইরাস প্রথম দিকে একটু বাড়লেও আগামী জুলাই-আগস্ট মাসে তার প্রকোপ সারা পৃথিবীতেই কমে যাবে। কিন্তু করোনাভাইরাস দুনিয়া থেকে লুপ্ত হবে না। যক্ষ্মা, ক্যান্সার, এইচআইভি রোগগুলোর তালিকাভুক্ত হবে। মানুষ যেমন প্রতিবছর কলেরা, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া ইত্যাদি প্রাণঘাতী রোগ প্রতিরোধের জন্য টিকা, ইনজেকশন ইত্যাদি নেয়, করোনার জন্যও অনুরূপ টিকা বা ইনজেকশন বছর বছর নিতে হবে এবং তা শিগগিরই আবিষ্কৃত হবে।

এই সুসংবাদদাতা বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এই বছর শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই কভিড-১৯-এর প্রতিষেধক টিকা বা ইনজেকশন বেরিয়ে যাবে। এবং এই ভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ করা সম্ভব হবে। সুসংবাদদাতা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সহমত পোষণ করা সত্ত্বেও তাঁদেরই স্বগোত্র আরেক দল বিজ্ঞানী দুঃসংবাদ দিয়েছেন, কভিড-১৯-এর পর তার একটা সেকেন্ড ওয়েভ আসতে পারে আরো মারাত্মকভাবে। এই ওয়েভ আসার আগে যদি এর প্রতিষেধক আবিষ্কার এবং বিশ্বময় ব্যবহার নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে আরো অকল্পনীয় বিপর্যয়ের জন্য বিশ্ববাসীকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

তাঁরা আরো বলছেন, এই মহামারি থেকে সারা বিশ্বে খাদ্যাভাব থেকে অর্থনৈতিক মন্দার যে ধাক্কাটা আসছে তার পরিমাপ আমরা এখনো করে উঠতে পারিনি। বড় ঝড়ে যেমন বড় বড় গাছ পড়ে যায়, কিছু ছোট গাছ ছোট বলেই ঝড়ের দাপট থেকে বেঁচে যায়, তেমনি এবারের মন্দা ইউরোপ-আমেরিকার মতো বড় দেশগুলোতেই বড় আঘাত হানবে। আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দারোধে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবার তেমন কোনো বড় ভূমিকা পালন করতে পারবে না।

সংকট ঠেকানোর জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রা সরবরাহ এত বাড়ানো হবে যে তাতে আন্তর্জাতিকভাবে বিরাট মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে। তার ধাক্কা উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কৃষিনির্ভর কিছু উন্নয়নশীল দেশ যাদের মজুদ খাদ্যের সুব্যবস্থাপনা দ্বারা ঝড়ের বড় দাপট অনেকটা ভালোভাবে সামলাবে। তবে মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কা কতটা সামলাতে পারবে তা নির্ভর করবে বিশ্ববাজারে মুদ্রা সরবরাহ পরিস্থিতির ওপর। পাউন্ড-ডলার বিশেষ করে ডলারের দাম উঠানামার ওপর।

এক মার্কিন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্তমান লম্ফঝম্পের দুটি উদ্দেশ্য। আন্তর্জাতিক মন্দা ঠেকানো এবং আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার জন্য অভ্যন্তরীণভাবে অশ্বেতাঙ্গ বহিরাগতদের আক্রমণের টার্গেট করা আর আন্তর্জাতিকভাবে চীনের বিরুদ্ধে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু করা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একটি দল বলেছে, ট্রাম্পের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। রেসিজম ও উগ্র জাতীয়তাদের আশ্রয় গ্রহণ এবং চীনা জুজুর ভয় সৃষ্টি করে তিনি হয়তো আগামী প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে পার হয়ে যাবেনও, কিন্তু এবারের অর্থনৈতিক মন্দা তাঁর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সামলাতে পারবেন না। তাঁকে স্টেট ইন্টারভেনশনসহ মুক্তবাজারবিরোধী সমাজতন্ত্রী ধাঁচের বহু ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হতে হবে।

সবচেয়ে ভালো হয়, যদি আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তিগুলো চীনের সঙ্গে কনফ্রন্টেশনের নীতি গ্রহণ না করে তাকে কভিড-১৯ তথা করোনাভাইরাসকে দমন করার ব্যাপারে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক উদ্যোগে টেনে আনা যায় এবং আমেরিকাও তাতে যোগ দেয়। এটাও জানা দরকার, চীনের উহান প্রদেশে কী কারণে এই মৃত্যুদূতের জন্ম এবং কী করে তা সারা বিশ্বে ছড়াল? চীনের সহযোগিতা ছাড়া করোনা-সংক্রান্ত সব তদন্ত করা যাবে না। অন্যদিকে চীন সহযোগিতা দিলে শুধু এই মহামারি প্রতিরোধ নয়, অর্থনৈতিক মন্দা দমনেও বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারবে।

প্রশ্ন হলো, এই সুস্থ নীতি আমেরিকা গ্রহণ করতে চাইবে কি না? শুধু ট্রাম্প নন, অতীতেও দেখা গেছে মার্কিন পুঁজিবাদ নিজেদের স্বার্থে বিশ্বে দানব সৃষ্টি করেছে এবং এই দানব যখন ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে উঠেছে, তখন তাকে দমনের জন্য মাঠে নামতে বাধ্য হয়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানিতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। অনাহারী মানুষের ক্ষোভকে পুঁজি করে এবং ইহুদি-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে জার্মানিতে হিটলারের ফ্যাসিবাদের জন্ম। দুর্ভিক্ষগ্রস্ত মানুষের যখন প্রয়োজন ছিল খাদ্য ও অর্থনৈতিক সাহায্য তখন আমেরিকা তা না করে নাৎসি পার্টিকে সংগঠিত হওয়ার জন্য গোপনে অর্থ সাহায্য দিয়েছে। জার্মানিকে সামরিক শক্তি পুনর্গঠনে সাহায্য দিয়েছে।

সেই সময় জার্মানিতে নাৎসিরা ‘টার্কিতে রপ্তানির জন্য তোয়ালে তৈরির কারখানা’ এই সাইনবোর্ড লাগিয়ে বহু কারখানায় শুধু যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করেছে। এই যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণের কারখানায় জার্মান বেকার শ্রমিকরা চাকরি পেয়ে হিটলারের নামে জয়ধ্বনি দিয়েছে। হিটলার তখন ছিলেন ন্যাশনালিস্ট সোশ্যালিস্ট এবং শ্রমিক নেতা। পরে এই হিটলারই হয়ে উঠলেন মহাশক্তিশালী ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটরে। ইহুদি নির্যাতনে হাত পাকিয়ে সারা ইউরোপে অভিযান চালিয়েছিলেন। এই দানবকে দমনের জন্য অনেক গড়িমসির পর নিরপেক্ষ থাকার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে জার্মানি ও জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হয়েছিল। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, জাপান আকস্মিকভাবে পার্লহারবারে হামলা না চালালে রুজভেল্ট যুদ্ধে নামতেন না। বিশ্বকে ফ্যাসিবাদের গ্রাস থেকে রক্ষার জন্য আমেরিকাকে তার চিরশত্রু সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার নায়ক স্তালিনের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়েছিল। বর্তমানে করোনা দানবের গ্রাস এবং বিশ্বমন্দা থেকে বিশ্বকে রক্ষার জন্য ট্রাম্প সাহেবকেও কি তাদের ঘোষিত শত্রু কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে না? এটা দেখার রইল।

বাংলাদেশে হাসিনা-সরকার ক্ষমতায় থাকায় আশা করা হয় দেশটি যেকোনো দুর্যোগের মুখে পড়ুক, তা সামাল দিয়ে উঠতে পারবে। দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকায় যে প্রান্তিক গরিব মানুষ চরম দুর্দশায় পড়তে পারে, তাদের দুই কোটির জন্য নগদ টাকা সাহায্য দানের ব্যবস্থা করেছে সরকার। মোট বরাদ্দ এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। পরিবারপ্রতি বরাদ্দ হয়েছে দুই হাজার ৪০০ টাকা। এই টাকা সরাসরি যাবে সাহায্য পাচ্ছে যারা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। যাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, তাদের অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হবে। এই অর্থ বণ্টনে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কর্তৃত্ব নেই। জনজীবনের বর্তমান এবং আগামী সংকটের কথা মনে রেখে শেখ হাসিনা দ্রুত এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এরই মধ্যেই এ জন্য দেশের অনেকে শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। ভারত ও পাকিস্তানে একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

এই সময়োচিত পদক্ষেপের জন্য সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামও শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু একটি ব্যাপারে তিনি সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছেন; বলেছেন, ‘গরিব মানুষদের তালিকা প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে যেন ফাঁকফোকর না থাকে।’ এই ফাঁকফোকর বলতে তিনি বুঝিয়েছেন, মেম্বার-চেয়ারম্যানরা যাতে তালিকা তৈরির দায়িত্ব পেয়ে নিজেদের অনুচর ও আত্মীয়-স্বজনের নামের দ্বারা তা পূর্ণ না করেন সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রাখা।

এই অর্থ বণ্টনের ব্যাপারে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন এই বলে যে গরিব মানুষকে এই অর্থ সাহায্য দান অবশ্যই আবশ্যক। কিন্তু বেশি দিন এই সাহায্য দান অব্যাহত রাখা হলে গরিব মানুষরা সরকারি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে পারে। তাঁর মতে প্রথমে তিন মাস, তারপর ছয় মাস পর্যন্ত এই সাহায্য দেওয়া যেতে পারে। ড. মনসুর সরকারকে একটি সুপরামর্শ দিয়েছেন। সরকার এমনিতেই সংকট সমাধানে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির কথা বলেছে। দরিদ্রদের জন্য নগদ সাহায্যদান অবশ্যই চালু রাখতে হবে। কিন্তু অনুৎপাদনশীল খাতে এই মুদ্রা সরবরাহ অনির্দিষ্টকাল অব্যাহত রাখা হলে তা মুদ্রাস্ফীতি আরো বাড়াবে।

বিশ্বমন্দার আঘাত বাংলাদেশ অনেকটাই সামলে উঠতে পারবে বলে আশা করা যায়। কারণ এবার শস্য উৎপাদন ভালো হয়েছে। কৃষি দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, হাওর এলাকার জমির ৭০ শতাংশের বেশি ধান কেটে কৃষকরা ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, সিপিবি প্রভৃতি দলের কর্মীরা বিভিন্ন জেলায় কৃষি শ্রমিকদের সঙ্গে মিলে ধান কাটা ও ধান মাড়াইয়ের কাজে কৃষকদের সাহায্য জোগাচ্ছে। চলতি মাসের মধ্যে জমির ধান সর্বত্র ঘরে তুলতে পারলে বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতির মোকাবেলা করতে পারবে।

এ ব্যাপারে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কৃষিমন্ত্রীকে সবিনয়ে একটি কথা জানাই, বাংলাদেশের কৃষকদের একটি বড় অংশ নানা কারণে সচ্ছল নয়। জমির ফসল ঘরে তোলার পর ভালো দাম পাওয়ার জন্য ধরে রাখার সক্ষমতা তাদের নেই। ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ নিয়ে অল্প দামে কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল কেনে এবং বড় ধরনের মুনাফার জন্য সেই খাদ্যশস্য বাজারে না ছেড়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। তারা কৃষককে ঠকায় এবং দেশকেও সংকটে ফেলে দেয়। এ জন্যই ধানকাটা শেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষককে ন্যায্য দাম দিয়ে ধান-চাল কিনে সরকার যেন মজুদ খাদ্যের পরিমাণ যথাসম্ভব বাড়ায়, তাহলে আপৎকালে সরকারকে ভিক্ষার হাত বাড়াতে হবে না।

আমাদের এই আশাবাদ ‘ইকোনমিস্ট’ কাগজেও সম্প্রতি ব্যক্ত হয়েছে। তারা বলেছে, ‘কভিড-১৯ সংকটে শক্ত ভিত্তির অর্থনীতির শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশ। ইকোনমিস্টের জরিপে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস সংকটে সবচেয়ে কম ঝুঁকিতে থাকা দশ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ৬৬টি দেশের এই তালিকায় বাংলাদেশের স্থান নবম। চীন ও ভারতের চেয়েও বাংলাদেশের অবস্থা ভালো।’

ইকোনমিস্টের এই তালিকা বাংলাদেশের মানুষের মনে আশা ও সাহস জোগাবে। কিন্তু বিদেশি পত্রিকার জরিপ আমাদের জন্য যত সুসংবাদই বহন করে আনুক, দুঃসংবাদে যা বলা হয়েছে, অর্থাৎ একটি অর্থনৈতিক মন্দা ও খাদ্যাভাব দ্রুতবেগে ধেয়ে আসছে, তাকে প্রতিহত করার জন্য জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সরকারকে আরো কঠোর হতে হবে, আরো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com