বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৪ অপরাহ্ন

ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস আজ

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ১৬ মে, ২০২০
  • ১৯৮ বার

আজ শনিবার, ১৬ মে। ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস। ৪৪ বছর আগে ১৯৭৬ সালের এই দিনে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দান থেকে মারণ বাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লাখো জনতার লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ওই দিন বাংলার সর্বস্তরের মানুষের বজ্রকণ্ঠ দিল্লির মসনদ পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়। আধিপত্যবাদী শক্তি ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী সেদিন ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব ও এর বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে যে প্রতিবাদ করেছিলেন, তার সেই সাহসী উচ্চারণ বাংলাদেশের মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস্য হয়ে আছে আজও।
উপমহাদেশের জনপ্রিয় শিল্পী ভূপেন হাজারিকার একটি গান আজও ভারতীয় পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানুষকে আন্দোলিত করে, অনুপ্রেরণা জোগায়। তিনি গেয়েছেন :

বিস্তীর্ণ দু’পারের অসংখ্য মানুষের
হাহাকার শুনেও
নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা তুমি
গঙ্গা বইছ কেন?
জানা যায়, ১৯৭৬ সালের ১৬ মে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দান থেকে লংমার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়। দিনটি ছিল রোববার। সকাল ১০টায় রাজশাহী থেকে শুরু হয় জনতার পদযাত্রা। হাতে ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের ঢল নামে রাজশাহীর রাজপথে। ভারত বিরোধী নানা সেøাগানে সেøাগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। দুপুর দুইটায় হাজার হাজার মানুষের স্রোত জেলার গোদাগাড়ীর প্রেমতলী গ্রামে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে মধ্যাহ্ন বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যা ছয়টায় লংমার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়ে রাতযাপনের জন্য সে দিনের মতো শেষ হয়। মাঠেই রাত যাপন করার পরদিন সোমবার সকাল আটটায় আবার যাত্রা শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে।

ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেয় এই লংমার্চে। তারা নিজেরাই নৌকা দিয়ে সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হয়। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। মওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না। তিনি বলেন, আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’ মওলানা ভাসানী এখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে লংমার্চ সমাপ্ত হলেও সেদিন জনতার ভয়ে ভীত ভারতীয়রা সীমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে।

প্রতিবেশী দেশ হয়েও ভারতের একতরফা ও আগ্রাসী মনোভাবের কারণে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের বৃহৎ একটি অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চল ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। দেশের বৃহত্তম নদী পদ্মা আজ পানির অভাবে শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত ৩০টি নদী আজ বিলুপ্তির পথে। অন্য দিকে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন পানির স্তর স্থান ভেদে ১০০ থেকে ১৩০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। আর নগরীতে অন্তত ৬০ থেকে ৭০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে।

সূত্র জানায়, ইতঃপূর্বে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি বারবার উত্থাপন করা হলেও কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি। দীর্ঘ দিন ধরে শুধু আশ্বাসের বাণী শোনানো হয়। এ ব্যাপারে ভারতের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভারত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদান করছে না।

সরেজমিন দেখা গেছে, রাজশাহীর পদ্মার সেই অপরূপ যৌবন ও সৌন্দর্য আর নেই। এ ছাড়া জেলার বাঘা, চারঘাট ও গোদাগাড়ীতে পদ্মার শাখা নদীতেও একই চিত্র বিদ্যমান। রাজশাহীর পদ্মা নদীর বুকে বিশাল বিশাল বালুচর পড়েছে। সেখানে ঘুড়ি উড়ানো হচ্ছে, গরুর গাড়ি চলছে। ফল ও ফসলের আবাদ হচ্ছে। পায়ে হেঁটেই এখন নদী পার হওয়া যায়। পদ্মার মূল নদী রাজশাহী শহর থেকে অনেক দূরে (প্রায় পাঁচ কিলোমিটার) সরে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থা চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যে দেশের বৃহৎ এ অঞ্চলটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। মরুকরণ দেখা দেবে। অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বৃহৎ একটি অংশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। আগ্রাসী ভারতের একগুঁয়েমি ও অপ্রতিবেশীসুলভ আচরণের কারণে বাংলাদেশ আজ চরম ক্ষতির শিকার। এর ফলে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ জিইয়ে রয়েছে। বছর আটেক আগে থেকে দাবি উঠেছে, ফারাক্কা বাঁধের কারণে দেশের যে ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতিপূরণ ভারতের কাছ থেকে আদায় করতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারকে সেই ক্ষতিপূরণ আদায়ে ভারত সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তারা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন বাংলাদেশের সভাপতি অ্যাডভোকেট এনামুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, ভারত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে পানি দেবে না, এটা এখন অনেকটা পরিষ্কার। কারণ এত দিনেও তারা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে পানির প্রাপ্যতা বুঝিয়ে দেয়নি। ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতিপূরণ ভারতের কাছ থেকে আদায়ে বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, জাতিসঙ্ঘের পানিপ্রবাহ আইন ১৯৯৭ এর বিধান অনুযায়ী এবং জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমেই বিষয়টির সুরাহা করতে হবে। এজন্য সরকারকে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে।
এদিকে বর্তমানে মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে রাজশাহীতে লকডাউন চলছে। এই রোগ থেকে মুক্তি পেতে শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকেই এবার রাজশাহীতে ফারাক্কা দিবসে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে।

‘ফারাক্কা লংমার্চ পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের প্রথম আন্দোলন’

নদীমাতৃক বাংলাদেশ আজ প্রায় মরুভূমি, বিপর্যয় ঘটেছে পরিবেশের তার জন্য দায়ী প্রধানত প্রতিবেশী ভারতকর্তৃক বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার কারণেই। তাদের অব্যাহত পানি আগ্রাসনের কারণে পানি নেই। পানিশূন্য আজ পদ্মা। এক সময়ের প্রমত্ত পদ্মা আজ ধুধু মরুভূমি। এর প্রধান কারণই হচ্ছে ফারাক্কা বলে অভিমত প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ।
আজ ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের ৪৪তম বার্ষিকী উপলক্ষে গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বাণীতে পার্টির চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি ও মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া এসব কথা বলেন।

তারা বলেন, পানির অভাবে ধীরে ধীরে প্রমত্তা পদ্মা হয়ে ওঠে ধুধু বালুচর। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোটি কোটি মানুষ। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ক্রমান্বয়ে মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। পদ্মা ধীরে ধীরে ধুধু বালুচর এবং বিরানভূমি হয়ে যাচ্ছে, যা মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার প্রাথমিকপর্যায়।
মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তার দূরদৃষ্টি দিয়ে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন এই পরিস্থিতি হবে। আর সে কারণেই ফারাক্কা বাঁধের ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবহিত করতে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
নেতৃদ্বয় বলেন, ভারত উজানের রাষ্ট্র হিসেবে ভাটির দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে সুপ্রতিবেশী হিসেবে যে আচরণ প্রত্যাশা করে তা থেকে সকল সময়ই বঞ্চিত হয়েছে। ভারতের সাথে গত ৫০ বছরেও পানি সমস্যা সমাধান না হওয়ার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর অবহেলা ও ব্যর্থতা। শাসকগোষ্ঠী কেউ জাতিসঙ্ঘে ফারাক্কা উত্থাপন করতে ভুলে যান আবার কেউ দ্বিপক্ষীয় সমাধানের কথা বললেও এই বিষয়ে প্রায়ই নীরবতা অবলম্বন করেন।

ন্যাপ নেতৃদ্বয় বলেন, ৪৪ বছর আগেই স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বিশ্ব বিবেককে পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাগ্রত করতে লংমার্চের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই দিন বাংলার সর্বস্তরের মানুষের বজ্রকণ্ঠ ভারতের শাসক মহলেও কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। যার রেশ উপমহাদেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পৌঁছে যায়।

নেতৃদ্বয় বলেন, ১৯৭৬ সালের এই দিনে আয়োজিত লংমার্চের মূল লক্ষ্য ছিল ফারাক্কা বাঁধ। কিন্তু পদ্মাসহ সব অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সমস্যা আজো অমীমাংসিত থেকে গেছে। ফারাক্কা নিয়ে সম্পাদিত চুক্তিতে শুভঙ্করের ফাঁকি সুস্পষ্ট হলেও এনিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। তিস্তা নিয়ে চুক্তির নামে দীর্ঘমেয়াদি লুকোচুরি খেলা চলছে। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ভারত তার একতরফা নীতির আওতায় গঙ্গা তথা পদ্মায় যে অবৈধ বাঁধ নির্মাণ করে সেই বাঁধ বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য আজ মারণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। এখন সেই ফাঁদ ভারতের জন্যও মারণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। তারা ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের মহানায়ক মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সাংগঠনিক প্রধান জাতীয় নেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়াসহ সকল সংগঠক ও অংশগ্রহণকারী জনতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com