বেড়েই চলেছে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ। চলতি অর্থবছরে এ ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করে যেতে পারে বলে শঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ ৮১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই ঋণ নেয়া হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। যার পুরোটাই নতুন করে ছাপানো টাকা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে হয়তো আগামীতে সরকারকে বাজেট ঘাটতি পূরণ ও দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রতিদিন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। মূলত রাজস্ব আয়ের হতাশাজনক পরিস্থিতির কারণে সরকারকে বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে অধিক হারে ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। রাজস্ব আয় আশানুরূপ না হওয়ায় অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে সরকার ব্যাংক থেকে এর বেশি ঋণ নিয়ে ফেলে। ছয় মাসে ব্যাংক থেকে ঋণ করা হয় ৪৯ হাজার ১৫ কোটি টাকা। এ পরিস্থিতিতে মার্চ মাসে এসে ঋণ নেয়ার পরিমাণ সংশোধন করে নির্ধারণ করা হয় ৭২ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা। কিন্তু এখন সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও অতিক্রম করে গেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, চলতি মাসের ১৩ মে পর্যন্ত সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৮১ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা কি না বাজেটে রক্ষিত মূল টার্গেট থেকে ৩৭ হাজার কোটি টাকা এবং সংশোধিত টার্গেট থেকে ৯ হাজার কোটি টাকা বেশি।
কেন বাড়ছে সরকারের ব্যাংকঋণ? এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অর্থ বিভাগের এক অতিরিক্ত সচিব জানান, সরকারের ব্যয়ের হিসাবটাই বাজেট। এ ব্যয় মেটানোর জন্য সরকারকে আয় করতে হয়। এ আয় করতে হয় রাজস্ব খাত থেকে। কিছু আসে বৈদেশিক সহায়তা খাত থেকে। কিন্তু এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাজস্ব আয়ের অবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু সরকারের ব্যয় করতেই হচ্ছে এবং তা বেড়েও যাচ্ছে। এখন সরকারকে বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। কারণ অন্যবার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার ঋণ নিতো। কিন্তু বিধিনিষেধ আরোপের কারণে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেক কমে গেছে। তাই বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকেই ঋণ নিতে হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের হিসাবে দেখা যায়, গত ১০ বছরের মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের সবচেয়ে বেশি ধার করার রেকর্ডটি ছিল বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। ওই বছর ধারের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। কিন্তু এবার ছয় মাসেই সেই রেকর্ড ভেঙে গেছে। এখনতো প্রতিনিয়তই ধারের রেকর্ড হচ্ছে। গত ১৩ মে পর্যন্ত ব্যাংকব্যবস্থার কাছে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। অথচ গত জুনেই এ পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ৯৫ কোটি টাকা। সাধারণত অর্থবছরের শেষ দিকে সরকারের টাকায় টান পড়ে বেশি।
অর্থ বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে সরকারকে ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেয়ার প্রয়োজন পড়েনি। উল্টো সে বছর বকেয়া ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। এর পরের অর্থবছর ২০১০-১১ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয় ২৫ হাজার ২১০ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৭ হাজার ১৯১ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৭ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১৮ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫১৪ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১০ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেয়া হয়নি, উল্টো পরিশোধ করা হয়েছে ৮ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঋণ নেয়া হয় ২৮ হাজার ২০৮ কোটি টাকা।