১৯৬২ সালের রমজান মাস। হাড়কাঁপানো শীত। এক দিকে শীত আরেক দিকে মহামারী আকারে শুরু হয়ে গেছে কলেরা। ভয়ঙ্কর রোগ কলেরা আর বসন্ত। পাড়াগাঁয়ে স্যালাইনের নামগন্ধও ছিল না। তখন কারো কলেরা দেখা দেয়ার অর্থ, নির্ঘাত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া। চার দিকে কলেরার হুলস্থুল কাণ্ড। তখন একদিন বাবার সাথে নৌকায় করে বাজারে যাই। আমাকে নৌকায় বসিয়ে রেখে বাবা বাজার করছিলেন। ইফতারের জন্য ছোলা ও ডালপুরি কিনে নৌকায় রেখে যান। ছাতার তলায় বসে কয়েকটি ডালপুরি খাই। ইফতারের আগেই বাড়ি পৌঁছে যাই। মা ইফতারের জন্য প্রতিদিনের মতো কাঞ্জির পিঠা তৈরি করেছিলেন। বিশেষভাবে বানানো মচমচে কাঞ্জির পিঠা বাবা ও আমার দু’জনেরই প্রিয়। প্রতিদিন পিঠা বানানো শুরু করতেই মা আমাকে ডাকতেন। তাওয়া থেকে নামানো গরম পিঠা হাতে দিয়ে বলতেনÑ ‘দেখ তো বাজান, লবণটা ঠিকমতো হইছে কি না!’
মা আজো ডাকাডাকি শুরু করেছিলেন। আমার পেটের ভেতরটা কেমন যেন করছিল, ফলে প্রিয় খাবারের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ ছিল নাÑ তাই মায়ের ডাকাডাকিতে সাড়া দিতে পারছিলাম না।
আমার মুখে বারবার পানি উঠছিল। বমিবমি ভাবসহ মুখে পানি ওঠা ক্রমেই বাড়ছিল। ডাকাডাকি করেও সাড়া না পেয়ে পিঠা হাতে করে মা আমার কাছে চলে আসেন। পিঠা না খাওয়ার কারণ জানতে চান। বললাম, ‘মা আমার ভালো লাগছে না। কেমন যে লাগছে। বলতে পারছি না।’ এ কথা শোনার পর মায়ের ঠোঁট কাপতে শুরু করে। ঠোঁট কাঁপুনির ফলে ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলেন না।
ইফতার শুরু হয়েছে। আমার অস্বস্তির কথা শোনার পর থেকেই ইফতারসহ মায়ের কাজকর্ম ওলটপালট হতে শুরু করে। সবাই যখন রাতের খাবার খেতে বসেন, তখন জড়োসড়ো অবস্থায় কাঁথামুড়ি দিয়ে বিছানার এক কোণে আমি শুয়ে। মা সারা দিন রোজা রেখে এক ঢোক পানি গিলেই চলে আসেন আমার কাছে। কম্পিত হস্তে আমাকে জড়িয়ে ধরে, ‘বাবারে তোর কাছে কেমন লাগছে, একবার আমার কাছে বল। আমার যে দম বন্ধ হয়ে আসছে।’
‘মা তুমি ভয় পেয়ো না। মা, তুমি আমার পাশে শোও, আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ো, তোমায় জড়িয়ে ধরে আমিও ঘুমিয়ে পড়ব।’
(মা ভেজা গলায়), ‘কী বলছিস বাজান তুই! তোর বমিবমি ভাব দেখে আমার শোয়াটা (প্রাণ) বের হয়ে আসতে চাইছে। আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।’
রাত ৮টার দিকে আমার প্রথম বমি হলো। বমির সাথে অজীর্ণ ডালপুরিসহ সারা দিন যা খেয়েছি সব বের হয়ে আসে। আমাকে বমি করতে দেখে মা দিশেহারা হয়ে পড়েন। মিনিট দশেক পর আবারো বমি। কয়েকবার বমি করার পর ক্লান্ত হয়ে পড়ি। ‘অঁ অঁ’ শব্দসহ পেট থেকে ঘোলা পানি বের হতে থাকে। বারবার বমি করতে দেখে অত্যধিক কম্পনের জন্য মা ঠিকমতো কান্নাও করতে পারছিলেন না। ভারী একজোড়া কাঁথা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে নানারকম দোয়া-দরুদ পাঠ করতে থাকেন। মা তার সাধ্যমতো ‘আইলা’র উত্তাপ থেকে কাপড় গরম করে আমার শরীর গরম রাখার চেষ্টা করছেন। রাত ১০টার দিকে আমার পায়খানার বেগ পায়। ‘পায়খানার বেগ পেয়েছে’ বলতেই মা হাউমাউ কান্না শুরু করে দেন। কাঁদতে কাঁদতে, ‘ও আল্লাহ, কী শুনলাম আমি, এখন কী করব?’
কয়েকবার দাস্ত করার পর নিজে নিজে দাঁড়ানোর শক্তিও হারিয়ে ফেলি। মায়ের কান্নার ভয়ে, শরীরের সব শক্তি একত্র করে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াই। মায়ের কাঁধে ভর করে পায়খানা করতে বের হই। পিচকারির মতো সশব্দে চাল ধোয়া পানির মতো কিছুক্ষণ পরপর দাস্ত-বমি হওয়ার একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়লাম। চোখ বসে যায়। দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে যায় একেবারেই। আমার শরীরের যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠাণ্ডা হওয়া শুরু করেছিল মা দুধামণি গাছের পাতা গরম করে সেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গরম রাখার চেষ্টা করছিলেন। আমার দৈহিক শক্তি কমতে থাকলেও মানসিক শক্তি ও চেতনা ছিল টনটনে। দৈহিক শক্তি দ্রুত কমে আসার পরিণাম কী হতে পারে তা আমি ঠিকই আন্দাজ করতে পারছিলাম। সবকিছু আন্দাজ করতে পারার পরও, মরণভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়িনি। কারণ, তা হতে গেলে আমি মরে যাওয়ার আগেই মা মরে যাবেন। তাকে মরতে দেয়া যাবে না।
মনে হলো, আমার দুই পা ঠাণ্ডায় জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। মনে হয়, জমাট বাঁধার কাজটা পা থেকে মাথার দিকে যাত্রা করে বুক পর্যন্ত গেলেই ভবলীলা সাঙ্গ। মাঝে মাঝে পায়ের আঙুল নেড়ে পরীক্ষা করে দেখি, পা দুটো মরে গেছে কি না। কেউ কেউ বলেন, রূহ কোনো শরীর থেকেই ইচ্ছে করে বের হয় না। আজরাইল দেহের ভেতর থেকে রূহকে জোরপূর্বক বের করে আনেন। রন্ধনশালায় মহিলারা বাইন মাছের চামড়ার ভেতর থেকে যেভাবে বাইন মাছের শরীরকে বের করে আনেন- আজরাইলও ঠিক সেভাবে দেহের ভেতর থেকে রূহ বের করে আনেন। আমার বিশ্বাস, আমার শরীর থেকে রূহ বের করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কই, আমার কাছে তেমন কষ্টকর কিছু মনে হচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে, তেল ফুরিয়ে গেলে প্রদীপ যেভাবে নিভে যায়, শরীরের শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেলেও প্রাণভোমরা সেভাবেই উড়ে যায়। শরীরের শক্তি প্রদীপের তেলের মতো কাজ করে। একটা বিষয় নিশ্চিত, আমি মরে গেলে মা-ও মরে যাবেন। আমার মা-ও তার সমস্ত শরীর তুষারশীতল যন্ত্রণায় ডুবিয়ে রেখে দূরের ক্ষীণ আলোকরশ্মির দিকে তাকিয়ে বুকের ক্ষীণ স্পন্দন ধরে রেখেছেন। কোনো অপ্রত্যাশিত দমকা হাওয়া যদি ক্ষীণ আলোকরশ্মিখানা নিভিয়ে দেয় তখন মায়ের বুকের ক্ষীণ স্পন্দনটুকুও থেমে যাবে। মায়ের ‘প্রত্যাশিত আলোকরশ্মি’ তার একমাত্র পুত্র। তাই আমার হাত-পা অসাড় হয়ে পড়াসহ দুই চোয়ালে খিঁচুনি শুরু হয়ে গেলেও মাকে বুঝতে দিচ্ছি না। মাকে বুঝতে দিচ্ছি না যে, আমার কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কে যেন আমার দুই চোয়াল চেপে ধরে কণ্ঠস্বর বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে।
জেগে আছি না মরে গেছি, ঠিক উপলব্ধি করতে পারছি না। আমি মাটিতে না আকাশে তাও বুঝতে পারছি না। আমার শরীর তুলার মতো হালকা হয়ে গেছে। কখনো মনে হয়, তরঙ্গময় সমুদ্রে ছোট্ট একটা ডিঙ্গির মতো আমি দুলছি। মেঘের দেশে ভাসতে যেমন লাগে আমার কাছেও তেমন হালকা লাগছিল। মা কী করছেন তাও দেখছিÑ মায়ের রোদনের শব্দ আমার কানে প্রবেশ করছে। স্বপ্নাবিষ্টের মতো চেতন আর অবচেতনের দোলাচালে দুলছিলাম। আমার কাছে সবকিছুই ভাসা ভাসা ও এলোমেলো হয়ে পড়ছে। মায়ের চোখের পানি গণ্ড বেয়ে নামছে; তাও দেখতে পাচ্ছি। মা পাগলের মতো কখনো আমাকে জড়িয়ে ধরছেন, কখনো হাত-পায়ের তালুতে গরম তেল মাখছেন কিংবা দুধামণি গাছের পাতা গরম করে বুকে চেপে ধরছেন। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় সবকিছুই অনুভব করতে পারলেও কথা বলতে পারছি না। মায়ের কণ্ঠ থেকে কান্নাজড়িত, ‘আলীর হাতে জুলফিকার মার হাতে তীর যেইখান থে আইছো, বালাই সেইখানে ফিরা, আল্লাহ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।’
একসময় দরুদের শব্দ ক’খান ছাড়া বাইরের কোনো শব্দই আমার কানে পৌঁছেনি। দরুদ পাঠ করে করে মা আমার দুই কানে ফুঁ দিচ্ছিলেন। দরুদ পাঠ ও ফুঁ শেষে কয়েকবার ডাকাডাকি করেও আমার দিক থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে মা পশ্চিম দিক মুখ করে সিজদায় মাথা ঠেকিয়ে পরম করুণাময় স্রষ্টার কাছে সৃষ্টির আত্মনিবেদনের পর রোদনসহ দু’হাত তুলে, ‘হে আমার আল্লাহ, দ্বীনদুনিয়ার মালিক, তুই এইটা কী করলি? আমার সারা জীবনের একমাত্র সাধনার ধন তুই নিয়ে গেলি? হে মালিকুল মউত, আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির, আমি যদি জীবনে কোনো একটা ভালো কাজ করে থাকি, তবে সেই কাজের ফজিলতের বিনিময়ে অভাগা মায়ের নাড়িছেঁড়া ধনকে ফিরিয়ে দিয়া যা। ইয়া রাব্বুল আলামিন, আমার এ নাড়িছেঁড়া ধন থেকে কামাই খাওয়ার দরকার নেই, শুধু চরণ দর্শন করার জন্য হতভাগীর ছেলেটাকে ফেলে রেখে যা।’
এই মর্মে মা মুনাজাত করছিলেন। জ্ঞান হারানোর পূর্ব অবধি মায়ের হৃদয় নিষ্কাশিত দরুদ ও তপস্যার ভাঙাছেঁড়া শব্দ ছাড়া আর কিছুই আমার মনে নেই। যখন চেতনা ফিরে পাই তখন, ‘আসসালাতু খায়রুম মিনন্নাউম’ ধ্বনি কানে প্রবেশ করতে শুরু করে। আমার দুই চোয়ালের খিঁচুনি আলগা হয়ে আরাম বোধ শুরু হয়। অর্ধচেতন মায়ের ক্ষীণ কণ্ঠ থেকে কান্নাসহ দরুদের শব্দগুলো পুনরায় শুনতে শুরু করি। মায়ের কান্না শুনে বললাম আমি, ‘মা তুমি কাঁদছ? মা আমি মরিনি, মরিনি মা। আমার ভীষণ তেষ্টা, আমাকে পানি দাও।’ আমার কণ্ঠের শব্দ শুনে, আমাকে জড়িয়ে ধরে সজোরে হাউমাউ কান্না। মায়ের এ কান্না আনন্দের। দুঃখ সীমা অতিক্রম করে গেলে মানুষ হাসে, তেমনি আনন্দ সীমা অতিক্রম করে গেলেও মানুষ হাসতে পারে না। আমার কণ্ঠের শব্দ শুনে আনন্দের আতিশয্যে হাসতে ভুলে গিয়ে শুরু করেছেন কান্না।
আজানের পর, একজন দু’জন মানুষ নিদ্রা ত্যাগ করে ঘরের দরজা খুলতে শুরু করেছে। প্রতিদিনের মতো আজো অনেকে আতঙ্কিত কান খাড়া করে রেখেছেন। আজ আবার কারো বাড়ি থেকে কান্নার রোল ভেসে আসছে কি না শোনার জন্য। এমন সময় মায়ের কান্না সবাইকে বিচলিত করে তোলে।
মায়ের কান্নার শব্দে আশপাশের সবাই ধরেই নিয়েছিল, তার একমাত্র ছেলেটিও শেষ হয়ে গেল। সমবেদনা জানানোর জন্য ছুটে আসেন পড়শিরা। বিস্তারিত শোনার পর সবাই বলতে শুরু করেন,
‘সন্তানের জন্য মায়ের হৃদয় নিংড়ানো দোয়ার চেয়ে বড় দাওয়া খোদার দুনিয়ায় নেই। মায়ের খাস দোয়া সৃষ্টিকর্তাও উপেক্ষা করতে পারেন না। এ গাঁয়ে কলেরা আক্রান্ত হয়ে আজ পর্যন্ত একজনও বাঁচেননি। ওষুধ-পথ্য ডাক্তার-বদ্যি ছাড়া শুধু মায়ের তপস্যার জোরে মালিকুল মউত অভাগীর পোলাখান ছোঁ মেরেও নিতে পারেননি, রূহটাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেছেন।’ লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক