সৈয়দ মুহম্মদ জুলকর নাইন:
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্লাস্টিক জড়িয়ে পড়ছে। আরামদায়ক ও সুলভ মূল্যের হওয়ায় এর ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বহুমুখী ব্যবহারে সুবিধাজনক বলে প্লাস্টিক মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করে আছে। অথচ পরিবেশ দূষণের জন্য যেসব বস্তু দায়ী তার অন্যতম প্রধান হচ্ছে পলিথিন বা প্লাস্টিক। এর কারণে ধ্বংস হচ্ছে প্রাণ প্রকৃতি। কোথায় নেই পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে শীর্ষস্থানীয়, প্লাস্টিকের ব্যবহার? মুদি দোকানের বেশির ভাগ জিনিস যেমনÑ বিস্কুট, চানাচুর, দুধ, চা-পাতা, চকলেট, পানি, তেল- সব কিছুতে প্লাস্টিক বা পলিথিনের উপস্থিতি। এ ছাড়া কটন বাড, স্ট্র, ওয়ানটাইম গ্লাস ইত্যাদি রয়েছে অনেক কিছুই। ১৮৬২ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার পার্কস প্রথম জনসমক্ষে প্লাস্টিকের প্রদর্শন করলেও ব্যবহারিকভাবে ১৯৬০ সাল থেকে এর অধিক প্রচলন শুরু হয়। তবে বর্তমান বিশ্বে বিশেষত পরিবেশ বিজ্ঞানীরা প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে সোচ্চার। প্লাস্টিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার সম্পর্কে সতর্কবাণী দিয়ে যাচ্ছেন তারা। প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন।
কিন্তু সে দিকে তেমন কারো লক্ষ নেই। বরং অত্যন্ত ক্ষতিকর প্লাস্টিকের ব্যবহার কিভাবে বাড়ানো যায়, সে দিকেই যেন অনেকে মনোযোগী। এর খারাপ পরিণতি বিষয়ে ধারণা থাকার পরও আমরা নির্বিকার। পলিথিন বা প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। গত পাঁচ দশকে প্লাস্টিক উৎপাদন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীব্যাপী প্রতি মিনিটে এক মিলিয়ন মানুষ বছরে গড়ে ৪০০টি ব্যাগ ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দৈনিক এক কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগসহ প্লাস্টিক থেকে তৈরি করা টিস্যু ব্যাগের ব্যবহার ৩০ লাখেরও বেশি। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডক্টর আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বাংলাদেশে প্লাস্টিক ব্যবহারের ওপর গবেষণা করে বলেছেন, দেশে যে হারে প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালে প্লাস্টিক ব্যবহারের দৈনিক পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ হাজার টনে যা খুবই বিপজ্জনক। প্লাস্টিক ওসেনস বলেছেÑ প্রতি বছর বিশ্বে ৩০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন করা হচ্ছে এবং প্রতি দশকেই তা বেড়ে চলেছে।
সারা বিশ্বে বছরে ৩৫ মিলিয়নের বেশি প্লাস্টিক দূষণ সৃষ্টি হচ্ছে যার এক-চতুর্থাংশ সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। সমুদ্রভিত্তিক প্লাস্টিক দূষণকে পরিবেশগত সমস্যার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, এ দূষণের হার যেভাবে বাড়ছে তাতে বিশ্বে নেমে আসবে বিপর্যয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, প্রতি বছর আট মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সমুদ্রে ফেলা হচ্ছে। এ ধারা চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রে প্লাস্টিকের ওজন হবে মাছের ওজনের চেয়েও বেশি। সমুদ্রবিজ্ঞানী শেরি লিপ্পিয়াট বলেছেন, আমরা এক পাউন্ড টুনা মাছ সংগ্রহের বিপরীতে দুই পাউন্ড করে প্লাস্টিক সমুদ্রে ফেলছি। এটি সত্যিকারভাবেই একটি বৃহৎ সমস্যা। পানিতে ঠাঁই নেয়া প্লাস্টিক বর্জ্যচক্র ঘুরে আমাদের শরীরেই প্রবেশ করছে। এর মূল্য দিতে হচ্ছে দুরারোগ্য রোগ ভোগ করার মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, সামুদ্রিক জীব ও পাখিদেরও জীবনহানি ঘটছে প্লাস্টিকের কারণে। প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরি করতে যে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়, পরিবেশে তার অনুপ্রবেশ ঘটছে। এটা বিষাক্ত করে তুলছে ভূগর্ভস্থ পানি ও খাদ্যশৃঙ্খলকে।
জেনোপিস নিউজিল্যান্ডের ভাষ্য হচ্ছে, মানুষের কারণেই আশঙ্কাজনকভাবে প্লাস্টিক গিয়ে মিশছে সমুদ্রে। যথাস্থানে না ফেলে যত্রতত্র আবর্জনা ফেলাই সমুদ্রগর্ভে এত বেশি প্লাস্টিক পৌঁছে যাওয়ার বড় কারণ। আবর্জনা ফেলার ব্যাপারে আমাদের উদাসীনতা এবং দেশের আবর্জনা ব্যবস্থাপনা এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের দিকে তাকালেই প্রত্যক্ষ করা যায়, কী পরিমাণ প্লাস্টিক পণ্য বা আর্বজনা ফেলা হচ্ছে সমুদ্রে। পর্যটকরা চিপস, চানাচুর, বিস্কুট, চা-কফির কাপ এবং আইসক্রিমের প্যাকেট সৈকতে ফেলে চলে যাচ্ছেন। একপর্যায়ে এ আর্বজনাই বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ওই আবর্জনার একটি বৃহৎ অংশ সমুদ্রে গিয়ে মিশছে। আমরা প্রাত্যহিক জীবনে যে পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যবহার করি, তার অর্ধেকাংশ মাত্র একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেই। এটি আসলে হঠকারী অভ্যাস। এতে প্রমাণিত হয়, আমরা প্লাস্টিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে অভ্যস্ত। এ অভ্যাস পাল্টাতে পারলে বিরাট সুফল বয়ে আনবে।
বিশ্বের বিকশিত শহরগুলো নদ-নদী ও সমুদ্র উপকূলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। একইভাবে ‘প্রাচ্যের রানী’ খ্যাত চট্টগ্রামেরও গড়ে উঠা কর্ণফুলী নদীকে কেন্দ্র করে। আমাদের দেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ কর্ণফুলী। বাণিজ্যিক সমৃদ্ধিতে যে নদীর ভূমিকা অপরিসীম, সে কর্ণফুলী আজ মৃত্যুযন্ত্রণায় ভুগছে। প্লাস্টিক ও পলিথিনসহ বিভিন্ন দূষণ আর অবৈধ দখলদারিত্বে কর্ণফুলী হারাচ্ছে নাব্যতা ও প্রস্থ।
২০১৯ সালের ১১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বদেশ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়, ‘বন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন আধুনিক ড্রেজার মেশিনের সাহায্যে নদীর তলদেশ খননের কাজ করছে। ড্রেজিংয়ের সময় নদীর তলদেশ থেকে মাটি-বালুর চেয়েও বেশি উঠেছে অপচনশীল ‘প্লাস্টিক বর্জ্য’। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্লাস্টিক বর্জ্য এখন বড় বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে। এ ধরনের কঠিন বর্জ্যরে কারণে টানা ২০ মিনিটও ড্রেজার সচল রাখা যাচ্ছে না।’
চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন খাল যেমন- রাজাখালি, মহেশখাল, মনোহরখালি, বামুনি, গুপ্ত, গয়না, চাক্তাই, ফিরিঙ্গিবাজারের মতো খালগুলো দিয়ে প্রতিদিন অপচনশীল ও অপরিশোধিত বিপুল বর্জ্য কর্ণফুলীতে গিয়ে পড়ছে। নগরীর গৃহস্থালীর প্রায় ৪০ শতাংশ বর্জ্য ও পাহাড় ধসের মাধ্যমে কর্ণফুলী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। কর্ণফুলীর তীরবর্তী ছোট-বড় ৪০টি বাজারের আবর্জনা ও উচ্ছিষ্ট উদাসীন বেপরোয়াভাবে নদীটিতে ফেলা হচ্ছে। এতে লাখ লাখ টন ময়লা নদীর তলদেশে জমা হওয়ার পাশাপাশি প্লাস্টিক বা পলিথিনের বিশালকায় আস্তরণ তৈরি হয়েছে। পলিথিন-প্লাস্টিকজাতীয় পণ্যের লাগামহীন ব্যবহার এবং আমাদের অসাবধানতায় কর্ণফুলী আজ বিপন্ন।
কর্ণফুলী বাংলাদেশের ‘প্রাণভোমরা’। কারণ এ নদীর ওপরই চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিষ্ঠিত। চট্টগ্রাম বন্দরকে সচল রাখতে হলে কর্ণফুলীকে যেকোনো মূল্যে বাঁচাতে হবে। দখল দূষণমুক্ত করে বহমান রাখতে হবে তার প্রবাহকে। কর্ণফুলীর স্রোত, নাব্যতা ও পানি আমাদের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখে। এ নদীর যতœ নেয়া, নদীকে জীবন্ত রাখা দেশের সমৃদ্ধির জন্য অতীব জরুরি।
পরিশেষে ইংরেজি ভাষার কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের কবিতার ‘ঞযব জরসব ড়ভ ঃযব অহপরবহঃ গধৎরহবৎ’ একটি বিখ্যাত লাইন দিয়ে শেষ করব। ডধঃবৎ ডধঃবৎ বাবৎুযিবৎব, ঘড়ঃ ধহু ফৎড়ঢ় ঃড় ফৎরহশ. সমুদ্রে এত পানি, অথচÑ এক ফোঁটাও পানযোগ্য নয়।