রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২৪ অপরাহ্ন

‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ শ্লোগানে উত্থাল ব্রিটেন

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ৮ জুন, ২০২০
  • ২২৪ বার

মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড হত্যার বিচার ও আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্ণবাদী আচরণের প্রতিবাদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে পর পর দু’দিন হাজার হাজার মানুষের বিক্ষোভ ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। লকডাউনের নিয়ম ভঙ্গ করে অনুষ্ঠিত ওই বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে তিন শ’ বছর আগের এক দাস ব্যবসায়ীর মুর্তি ভেঙ্গে ফেলেছে বিক্ষোভকারীরা। রাজধানী লন্ডনে বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে ১৭ পুলিশ অফিসার আহত হয় এবং বিক্ষোভ চলাকালে আইন অমান্য করায় ১৪ জনকে আটক করে পুলিশ।

ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার শ্লোগানে ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডন ছাড়াও অন্যান্য স্টেটে বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভ করেছে হাজার বিক্ষোভকারীরা। ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড ব্রিটেনের এই চারটি স্টেটে শনিবার ও রোববার ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেয়। ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম, ব্রিস্টল, ম্যানচেস্টার, লেস্টার, শেফিল্ড, ওলভারাম্পটন ও নটিংহামে, ওয়েলসের কার্ডিফে , স্কটল্যান্ডের এডিনবরা ও গ্ল্যাসগোতে এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টে হাজার হাজার মানুষ লকডাউনের মধ্যেই বিক্ষোভ করে। রাজধানী লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কোয়ার, মার্কিন দূতাবাস ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও অফিস টেন ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে বিক্ষোভ হয়। শনি ও রোববার দু’দিনেই লন্ডনের রাস্তায় প্রায় ১৫ হাজার বিক্ষোভকারী অংশ নেয়। ওই বিক্ষোভের ছবি দেখলে বোঝার উপায় নেই- এই লন্ডনেই করোনার কারণে ব্রিটেনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে, আর করোনার লকডাউন পুরোপুরি উঠে যায়নি। বিক্ষোভকারীদের অধিকাংশ মাস্ক ব্যবহার করলেও সামাজিত দূরত্বের নিয়ম কেউ পালন করেনি।

শনিবার বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ চলাকালীন ১৪ জন পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন লন্ডনের পুলিশ প্রধান ক্রেসিদা ডিক। রোববার এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছেন ডিক। শনিবার লন্ডনে হোয়াইটহলের সামনে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার ক্যাম্পেইনারের সময় এক বিক্ষোভকারী সাইকেল ছুড়ে দেয় ঘোড়ায় চড়া এক পুলিশ কর্মকর্তার দিকে। ফলে ঘোড়ার উপর থেকে পড়ে আহত হয় ওই পুলিশ অফিসার। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারর্স লন্ডনের বিক্ষোভে অন্তত ১৭ জন পুলিশ অফিসার আহত হয়েছেন। আর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং বেআইনী কাজ করার দায়ে অন্তত ১৪ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মেট্রোপলিটন পুলিশ সার্ভিসের কমিশনার এক বিবৃতিতে জানান, শনিবার সন্ধ্যায় মধ্য লন্ডনে প্রতিবাদকারীদের একটি অংশ সংখ্যালঘু কর্মকর্তাদের প্রতি সহিংস হয়ে উঠে। এর ফলে ১৪ জন কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও এক টুইট বার্তায় পুলিশের উপর হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন, বিক্ষোভকারীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করার অধিকার আছে । কিন্তু তাদের কোনোভাবেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মীদের উপর হামলার অধিকার নেই।

এদিকে ব্রিস্টলের রাস্তায় নেমেছিল অন্তত ১০ হাজারের বেশি বিক্ষোভকারী। ব্রিস্টলে নির্মিত সতের শতকের ইংরেজ দাস ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কলস্টনের মূর্তি ভেঙ্গে পার্শ্ববর্তী হাবার নদীতে ফেলে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। ১৬৩৬ সালে ব্রিস্টলের ধনাঢ্য পরিবারের জন্ম নেয়া কলস্টন কর্মজীবনে রয়েল আফ্রিকান কোম্পানির ডেপুটি গভর্নর হিসেবে কাজ করতো। সে সময় ওই কোম্পানির অধীনে অন্তত ৮০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানকে আমেরিকায় দাস হিসেবে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পাচারের সময় ৩ হাজার শিশুসহ অন্তত ২০ হাজার আফ্রিকানের মৃত্যু হয়েছে।

জীবনের শেষ দিকে এসে অর্থাৎ ১৭১০ সালে তিনি কনজারভেটিভ পার্টির এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৭২১ সালে মারা যান তিনি । ১৮৯৫ সালে ব্রিস্টল সিটি সেন্টারের সামনে তার মৃর্তি স্থাপন করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দাস ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কলস্টনের মূর্তি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়। মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলার জন্য এরই মধ্যে প্রায় ১১ হাজার স্বাক্ষর পড়েছে একটি পিটিশনে। অবশেষে রোববার বিক্ষোভকারীরা মূর্তিটি টেনে নামিয়ে উল্লাস করেছে এবং সেটির ঘাড়ের ওপর এক বিক্ষোভকারীকে হাঁটু চেপে থাকতেও দেখা গেছে, ঠিক যে কায়দায় পুলিশ ফ্লয়েডের ঘাড়ে হাঁটু চাপা দিয়েছিল। পরে মূর্তিটি টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে নদীতে ফেলা হয়।

রোববার ব্রিস্টলের রাস্তায় মিছিল করেছে প্রায় ৫ হাজার মানুষ। দক্ষিণ লন্ডনের মার্কিন দূতাবাসের সামনেও কয়েক হাজার মানুষ হাঁটু গেড়ে বসে প্রতিবাদ করেছে। ‘বিচার নেই, শান্তি নেই’, ‘ কৃষ্ণাঙ্গ জীবন মূল্যবান ’ স্লোগানসহ বর্নবাদ বিরোধী নানা শ্লোগান দেয় তারা।

পরে পার্লামেন্ট চত্বর এবং ডাউনিং স্ট্রিট অভিমুখে পদযাত্রা করে বিক্ষোভকারীরা। লন্ডনের মেয়র সাদিক খান এক টুইটে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে, ম্যানচেস্টারে কয়েকশ’ মানুষ সেন্ট পিটারস স্কয়ারে জড়ো হয়ে ফ্লয়েডকে শ্রদ্ধা জানাতে হাঁটু গেড়ে বসে এবং নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ করেছে। অন্য স্থানগুলোতেও শত শত মানুষ পদযাত্রা করেছে। উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডে আরো অনেক মানুষ অনলাইন প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নিয়েছে

বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভে যোগ না দেয়ার আহ্বান ব্রিটিশ মন্ত্রীর
কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকা-ের প্রতিবাদে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে বিক্ষোভে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্র। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়; বরং দুনিয়ার নানা প্রান্তে নৃশংস এ খুনের প্রতিবাদে বর্ণবাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছে পৃথিবীর বিবেকবান মানুষেরা। তবে বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভে অংশ না নিতে নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ব্রিটেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক। শনিবার এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন।

ম্যাট হ্যানকক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনায় তিনি নিজেও হতবাক হয়ে গেছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের হুমকি এখনো রয়ে গেছে। তাই বর্ণবাদবিরোধী যে বিক্ষোভের পরিকল্পনা করা হয়েছে; লোকজন যেন তাতে অংশ না নেয়।তিনি বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে আপনাদের প্রতি আমার কিছু কথা আছে। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু অন্য অনেকের মতো আমাকেও হতবাক করে দিয়েছে।

ম্যাট হ্যানকক আরো বলেন, জনগণের গভীরভাবে মর্মাহত হওয়ার কারণ আমি অনুধাবন করতে পারছি। কিন্তু এখনও আমরা একটি স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি। করোনাভাইরাস এখনও একটি বাস্তব ঝুঁকি। এর ঝুঁকি থেকে নিজেকে ও পরিবারের সদস্যদের সুরক্ষা নিশ্চিতে নিয়ম মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে আপনার প্রিয়জনদের সুরক্ষার জন্য দয়া করে বিশাল সমাবেশে অংশ নেবেন না।

বাংলাদেশী অধ্যূষিত আলতাব আলী পার্কে বর্ণবাদ বিরোধী সমাবেশ
২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ হেফাজতে মারা যান জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক মারা যাওয়ার প্রতিবাদে গত বুধবার লন্ডনের বিভিন্ন স্থানের মতো পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কেও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। শান্তিপূর্ণ ওই সমাবেশ থেকে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানানো হয়। বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে বক্তারা বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ব্রিটেনেও বহু ক্ষেত্রে বর্ণ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বহু মানুষ, বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার এখনই সময়। এর মাধ্যমেই সমাজে বর্ণবৈষম্য দূর হয়ে আলোকিত সমাজ তৈরী হবে।

স্ট্রান্ডআপ টু রেসিজম এর ব্যানারে আয়োজিত ওই সমাবেশে মানবাধিকার কর্মী ও সমাজকর্মীরা অংশ নেয়। সেখানে ইকুয়াল রাইটস ইন্টারন্যাশনাল, ইউনাইটেড ইস্টসহ বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন অংশ নেয়। উল্লেখ্য ১৯৭৮ সালের ৪ মে এই পূর্ব লন্ডনের এক পার্কে বর্ণবাদের শিকার হয়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত আলতাব আলী মারা যান। পরে তার নামানুসারে ওই পার্কের নামকরণ করা হয় আলতাব আলী পার্ক। ২০১৮ সালে ওই পার্কের পাশে একটি বাস স্টপেইজের নাম আলতাব আলী বাসস্টপ করে স্থানীয় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলর ।

গত ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ হেফাজতে মারা যান জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক। সেইদিনই পুলিশ তাকে আটক করেছিল। এরপর হাঁটু দিয়ে জর্জের গলা চেপে ধরেন পুলিশ। এভাবে অন্তত আট মিনিট তাকে মাটিতে চেপে ধরে রাখা হয়।এক প্রত্যক্ষদর্শীর তোলা ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, জর্জ ফ্লয়েড নিঃশ্বাস না নিতে পেরে কাতরাচ্ছেন এবং বারবার একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তাকে বলছেন, ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।’ এই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয় মুহূর্তেই। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ। প্রথম দিকে বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ থাকলেও ধীরে ধীরে তা সহিংসতায় রূপ নেয়।এই সহিংস আন্দোলন ঠেকাতে বিতর্কিত কার্যকলাপ শুরু করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আন্দোলনকারীদের ভয় কখনো বাঙ্কারে গিয়ে লুকিয়েছেন ট্রাম্প, আবার কখনো হিংস্র কুকুর এবং ভয়ঙ্কর অস্ত্র দিয়ে আন্দোলন দমানোর কথা শুনিয়েছেন তিনি। এছাড়াও আন্দোলন দমাতে ওয়াশিংটনে সেনাও নামান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com