শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২৫, ০৪:১৫ অপরাহ্ন

নিউ ইয়র্কের দিনরাত মজার কারফিউ!

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ৮ জুন, ২০২০
  • ২২৬ বার

রাস্তায় ছুটছে অগণিত গাড়ি। মহাসড়ক থেকে শুরু করে নেইবারহুড স্ট্রিট সর্বত্রই। যথারীতিই আছে পথচারিদের চলাচল। অত্যাবশ্যকীয় পন্যের দোকানগুলো খোলা। বেচাকেনাও আছে বেশ। অথচ সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী তখন শহরটিতে কারফিউ চলছে। এমনই অদ্ভুত কারফিউ দেখা গেছে গত এক সপ্তাহ ধরে দুনিয়ার অন্যতম শীর্ষ নগরী নিউ ইয়র্কে। অথচ কারফিউ বলতে আমরা বুঝি জনমানবহীন রাস্তাঘাট।

যাত্রীবাহী ও পন্যবাহী যানবাহন, ব্যাক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, সাইকেল ইত্যাদির চলাচল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। রাস্তায় কেবল সামরিক যানবাহন, পুলিশের গাড়ি , সেইসঙ্গে বড়জোর সংবাদকর্মীদের বাহন কিংবা হুঁইসেল বাজিয়ে চলা অ্যাম্বুলেন্স’র উপস্থিতি। কিন্তু নিউ ইয়র্কে তথা যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো বড় শহরে গত কয়েকদিন ধরে চলা কারফিউ চিরাচরিত সেই ধারণা একেবারে পাল্টে দিয়েছে। এমন নয় যে, অহরহ এখানে কারফিউ দেয়া হয়, সে কারণে এমন ঢিলেঢালা ভাব। নিউ ইয়র্ক নগরী এবার কারফিউ দেখলো ৭৭ বছর পর। তার মানে এই শহরের বাসিন্দাদের অন্তত ৮০ ভাগ কারফিউ ব্যাপারটার সঙ্গেই অপরিচিত।

যুক্তরাষ্ট্রের মিনোসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনেয়াপলিস শহরে গত ২৫ মে পুলিশের নিমর্ম নির্যাতনে নিহত হয় কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড। তার হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে দেশজুড়ে সৃষ্টি হওয়া তুমুল প্রতিবাদ-বিক্ষোভের এক পর্যায়ে কোথাও কোথাও লুটপাটের মতো নৈরাজ্য শুরু হয়। এ কারণে গত সোমবার থেকে নিউ ইয়র্কসহ অনেকগুলো শহরে জারি করা হয় কারফিউ। তবে ডনাল্ড ট্রাম্পের ফেডারেল সরকার নয়, এসব কারফিউ জারি করে স্থানীয় রাজ্য সরকার ও শহর কর্তৃপক্ষ। প্রথমদিন কারফিউয়ের সময়সীমা ছিল রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত। কিন্তু প্রথমদিন দেখা গেছে যে, কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই নিউ ইয়র্কের বেশ কয়েকটি এলাকায় লুটপাট চলেছে। একইসঙ্গে চলছে প্রতিবাদকারীদের বিক্ষোভ-সমাবেশও। তবে বিক্ষোভকারীদের পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হয়েছে যে, এসব লুটপাটের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। লুটপাট বন্ধ করা সরকারের দায়িত্ব। ওই পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার থেকে কারফিউ শুরুর সময় নির্ধারণ করা হয় বিকাল ৮টায়। এমন পটভূমিতে কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সেসব সংঘর্ষের জেরে গ্রেফতার করা হয় শতশত বিক্ষোভকারীকে। তবে গ্রেফতারকৃতদের ওপর কোনো ধরণের নির্যাতন বা জবরদস্তির খবর পাওয়া যায়নি। অবশ্য পরের কয়েকদিন কারফিউ’র মধ্যেই বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়েছে অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবে। শুরু থেকেই প্রতিবাদী সমাবেশে ও বিক্ষোভ র‌্যালিতে যোগ দেয়া হাজার হাজার মানুষের প্রায় অর্ধেকই ছিলেন শ্বেতাঙ্গ। এছাড়া এশীয়-আমেরিকান, আরব-আমেরিকান এবং ল্যাটিন আমেরিকানরাও অংশ নেয় এসব প্রতিবাদী কর্মসূচিতে। কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে তারাও আওয়াজ তোলেন, “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” কিংবা “নো জাস্টিস নো পিস” ইত্যাদি শ্লোগান। বিশেষত, গত তিনদিন ধরে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন ও ব্রুকলিনের কয়েকটি স্থানে বিক্ষোভকারীরা কারফিউর মধ্যেই শান্তিপূর্ণভাবে গভীর রাত পর্যন্ত প্রতিবাদ সমাবেশ করে। পুলিশও তাদের বাধা দেয়নি। নগরীর মেয়র বিল ডি ব্লাজিও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের প্রশংসা করেন। সেইসঙ্গে নির্ধারিত সময়ের একদিন আগেই, আজ সোমবার ভোর থেকে কারফিউ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন তিনি। আগের ঘোষণায় বলা হয়েছিল, কারফিউ চলবে মঙ্গলবার ভোর ৫টা পর্যন্ত।
শুধু নিউ ইয়র্ক নয়, জর্জ ফ্লয়েড হত্যার বিচার এবং বর্ণবাদী নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে ক্রমশ: সহিংস হয়ে ওঠা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আমেরিকার অন্য যেসব শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছিল সবজায়গার দৃশ্যই ছিল অভিন্ন। কারফিউয়ের মধ্যেই অব্যাহত ছিল বিক্ষোভ-সমাবেশ। চলেছে যানবাহন। অত্যাবশ্যকীয় পন্যের দোকানগুলো ছিল খোলা। পুলিশ তৎপর ছিল প্রধানত বিক্ষোভ-সমাবেশের জায়গাগুলোতে। প্রথমদিকে কিছু কিছু জায়গায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের অল্পস্বল্প সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলেও শেষের কয়েকদিন পরিবেশ ছিল অনেকটা শান্ত। এমনকি যে মিনেয়াপলিস শহরে নিহত হয়েছিলেন জর্জ ফ্লয়েড সেখানকার পরিবেশও এখন অনেকটা শান্ত। যদিও প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে প্রতিদিনই।
এমন অদ্ভুত কারফিউর ব্যাপারে জানতে চাইলে নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের বাংলাদেশি-আমেরিকান অফিসার হুমায়ন কবীর মানবজমিনকে বলেন, প্রথমত আমেরিকার সরকার ব্যবস্থা অনেক বেশি জবাবদিহিমূলক। মানুষের চলাচল, মতপ্রকাশ এবং প্রতিবাদ জানানোর অধিকার এখানে সর্বোচ্চ সম্মানের সঙ্গে রক্ষা করা হয়। ফলে এখানে কোনো অবস্থাতেই জনজীবনের ওপর কারফিউর মতো চুড়ান্ত বিধিনিষেধ আরোপের চিন্তা করা হয় না। যে কারণে গত ৭৭ বছরে কখনোই কারফিউ জারি করা হয়নি। দ্বিতীয়ত নিতান্ত বাধ্য হয়ে কারফিউ জারি করা হলেও সেটা বাস্তবায়নে সামরিক বাহিনী ডাকা হয় না। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমেই এটা বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। এ পর্যায়ে বিক্ষোভ চলাকালে কিছু কিছু এলাকায় লুটপাট শুরু হলে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে কারফিউ জারি করলেও প্রকৃত বিক্ষোভকারীদের প্রতি সহিংস বা আক্রমানত্বক না হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। যে কারণে কারফিউ ভেঙ্গে প্রতিবাদ সমাবেশ চললেও সেটা ছত্রভঙ্গ করার জন্য কোনো রকম বল প্রয়োগ করা হয়নি। কিছু বিক্ষোভকারী অতিমাত্রায় সহিংস হয়ে উঠলে তাদেরকে স্বাভাবিক নিয়মে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু শেষের কয়েকদিন প্রতিবাদকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে। যে কারণে পুলিশও তাদের সেভাবে বাধা দেয়নি। এটাই আমেরিকার সত্যিকার মূল্যবোধ। এখানে মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার গুরুত্বই সর্বোচ্চ। যে কারণে এই দেশকে বলা হয় ল্যান্ড অব লিবার্টি।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com