প্রায় ৬শ বছর আগে ভট্টাচার্য পরিবার শরীয়তপুর পৌরসভার ধানুকা এলাকায় ২৮ শতক জমির ওপর নির্মাণ করে একটি বাড়ি। বাড়িটি ‘ময়ূরভট্টের বাড়ি’ বা ‘মনসাবাড়ি’ নামে পরিচিত। পাতলা ইটের সাথে চুন, সুরকির গাঁথুনি ও পলেস্তরা দিয়ে নানা কারুকার্যখচিত বাড়িটির পূর্ব-পশ্চিমে ৫৭ ফুট লম্বা, ৩২ ফুট প্রস্থ। সীমানার ভেতর পাঁচটি ইমারত। নির্মাণশৈলী দেখে মনে হচ্ছে, ইমারতগুলোর একটি দুর্গা মন্দির, একটি মনসা মন্দির, একটি কালি মন্দির, একটি নহবতখানা ও একটি আবাসিক গৃহ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
বাড়ির পাশেই একটি দীঘি। স্বচ্ছ পানির দীঘিটি প্রাচীন বাড়িটিকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। দিয়েছে নতুন মাত্রা। কিন্তু সংস্কারের অভাবে প্রাচীন এ স্থাপত্য বিলুপ্ত হওয়ার পথে। পাঁচটি ইমারতের মধ্যে কোনোটি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আবার কোনোটি কালের আঘাত সহ্য করে এখনো অনেকটা সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে।
বাড়ির বেশিরভাগ সম্পত্তি ইতোমধ্যে বেহাত হয়ে গেছে। ভগ্নপ্রায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা দালানগুলো এখনো ধরে রেখেছেন বাড়ির সর্বশেষ পুরুষ শ্যামপদ চক্রবর্তী। শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে ধানুকা গ্রাম। এ গ্রামেই মধ্যযুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল তার ইতিহাসকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে।
‘ময়ূরভট্টের বাড়ি’ বা ‘মনসাবাড়ি’ নামকে ঘিরে লোকমুখে প্রচলিত আছে নানা কাহিনি। প্রথমত, তৎকালীন ভারতবর্ষের কনৌজ থেকে একসময় ভট্টাচার্য পরিবার ধানুকা গ্রামে এসে বাস শুরু করে। তাদের পূর্বপুরুষ ছিল ময়ূরভট্ট। ময়ূরভট্ট যখন মাতৃগর্ভে; তখন একবার তার মা-বাবা তীর্থ করার জন্য কাশিধামের উদ্দেশে যাত্রা করেন। পথে এক বনের ভেতর ভট্টাচার্যের স্ত্রী পুত্রসন্তান প্রসব করেন। নবজাতককে একটি শাল পাতায় ঢেকে রেখে তীর্থের উদ্দেশ্যে আবার যাত্রা শুরু করেন। তীর্থ শেষে ভট্টাচার্য পরিবার স্বপ্নে দেখে দেবতা তাদের পূজা গ্রহণ করেননি। সদ্যজাত পুত্রকে বনে অরক্ষিত রেখে আসা তাদের অন্যায় হয়েছে। নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তারা সেই বনে ফিরে এলেন। এসে দেখতে পান, একটি ময়ূর পাখা দিয়ে ঢেকে রেখেছে তাদের পুত্রকে। নবজাতক ময়ূরের আশ্রয়ে বেঁচে ছিল বলে পুত্রের নাম রাখা হয় ময়ূরভট্ট। এ থেকে বাড়ির নাম রাখা হয় ময়ূরভট্টের বাড়ি।
দ্বিতীয়ত, ময়ূরভট্টের বাড়ির এক কিশোরের অভ্যাস ছিল প্রতিদিন ভোরবেলা বাগানে গিয়ে ফুল কুড়ানো। একদিন ভোরবেলা ফুল কুড়াতে গেলে বাগানে এক বিশাল সাপ দেখে ওই কিশোর ভয় পেয়ে ছুটে আসে বাড়িতে। তবে পরদিন আবার ভোরে ফুল কুড়াতে যায় এবং সাপের মুখোমুখি হয়। সাপ কিশোরের পিছু পিছু বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করে কিশোরকে ঘিরে নাচতে থাকে। বাড়ির মানুষ ভয় পেয়ে যায়। রাতে স্বপ্নে তাদের কাছে আর্বিভুত হন দেবী মনসা। তিনি মনসা পূজা করার নির্দেশ দেন। এরপর থেকে এ বাড়ির নাম রাখা হয় মনসাবাড়ি।
সরেজমিনে জানা যায়, পাঁচটি ইমারতের নির্মাণশৈলী বা উপকরণ দেখে মনে হয়, এগুলো সুলতানি বা মোগল যুগের তৈরি। গবেষক বা যেকোনো কৌতূহলী মানুষের মনসাবাড়ির প্রতি আকর্ষণ জন্মাবে স্থাপনাগুলো দেখে। শরীয়তপুর সদর রাস্তা থেকে উত্তর-দক্ষিণে ধানুকা গ্রামে যেতে কাঁচা রাস্তা ছিল। বর্তমানে রাস্তাটি পাকা করা হয়েছে। প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে এগিয়ে পশ্চিম দিকে মনসাবাড়ি বা ময়ূরভট্টের বাড়ির অবস্থান। রাস্তা থেকে বাড়ির দূরত্ব মাত্র ২শ গজ। বাড়িটির প্রবেশমুখে একটি বড় দীঘি রয়েছে। দীঘির পশ্চিমপাড় থেকে শুরু হয়েছে মূল বাড়ির সীমানা। একটি বড় আঙিনার তিন দিকে তিনটি ইমারত স্বাভাবিক ভারসাম্য রক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে।
মনসাবাড়িকে দুটো অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। বর্তমান অংশটি ১ম অঞ্চল, একে মন্দির বাড়ি বলা হয়। মন্দির বাড়ির উত্তর সীমায় দক্ষিণ দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সাদা ইমারত। বাংলা প্যাটার্নের দোচালা ছাদ বিশিষ্ট ইমারত। এটি দুর্গা মন্দির হিসেবে চিহ্নিত। এখানেই বর্তমানে পূজা হয়। পশ্চিম সীমানা মাঝামাঝি পূর্ব দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলো প্যাটার্নের দোচালা ছাদ বিশিষ্ট ইমারত। এটি একসময় মনসা মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দক্ষিণ সীমায় উত্তর দিকে মুখ করে একটু ভিন্ন ডিজাইনের একটি ইমারত রয়েছে। এটি একসময় দ্বিতল ইমারত ছিল। দ্বিতলটি এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত। এটি ছিল নহবতখানা। মন্দির বাড়ির সাজানো চত্বরের বাইরে রয়েছে কালী মন্দির। এটি ছিল দ্বিতল ইমারত। দ্বিতলটি এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত অনেকটা এবং নিচতলার একটি অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। দক্ষিণে নহবতখানার পেছনে পূর্ব-পশ্চিমে প্রলম্বিত ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশাল একটি ইমারত। বহুকক্ষ বিশিষ্ট এটিও ছিল দ্বিতল। এই ইমারতের দক্ষিণ-পশ্চিমের একাংশ টিকে আছে। এ অংশটি টোল বা শিক্ষায়তন হিসেবে চিহ্নিত ছিল। ইমারতটির পুরোটাই একসময় হয়তো দ্বিতল ছিল। পূর্ব দিকে ছাদ ধসে গেছে। তাই দ্বিতলের অস্তিত্ব নেই। তবে পশ্চিমাংশে দ্বিতলের একটি প্রকোষ্ট এখনো অস্তিত্ব বজায় রয়েছে। ভবনে চুনের সাথে অথবা চুনের বিকল্প ঝিনুক চুর্ণ ব্যবহৃত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ইমারতটির নির্মাণশৈলীতে মুসলিম স্থাপত্যের প্রভাব স্পষ্ট।
জনশ্রুতি রয়েছে, ইমারতটিতে ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ট রয়েছে। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ছাড়া সত্যতা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এ ইমারতের সাথেই আচার্যদের বসত বাড়ি ছিল। বর্তমানে তা চিহ্নিত করার কোনো উপায় নেই। বর্তমানে বাংলা প্যাটার্নের দোচালা ছাদ বিশিষ্ট ইমারতটি দুর্গা মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাকি চারটি ভবন তাদের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। এ বাড়ির টোল বা শিক্ষায়তন হিসেবে চিহ্নিত ভবন থেকে শরীয়তপুরের ইতিহাসবিদ ভাষা সৈনিক জালাল উদ্দিন আহমেদ সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ৩৫ খণ্ড পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করেছেন। পাণ্ডুলিপিতে সাহিত্য, ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে লেখা রয়েছে।
লোকমুখে শোনা যায়, প্রথমে যে ভবনটি খনন শুরু করা হয়েছিল, তাতে একটি সোনার নৌকা ছিল। তাতে ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্টের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাড়ির প্রবেশদ্বারের নহবতখানায় সাপের ভয়ে ইমারতটির ভেতরে প্রবেশ করা হয়নি অনেক দিন। এ ছাড়া আর কোনো কাজ হয়নি বলে জানা যায়। বাড়িটির সর্বশেষ পুরুষ শ্যামাপদ চক্রবর্তী ওরফে তিনু ঠাকুর। স্থানীয় ইতিহাসবিদগণ মনে করেন, সরকারিভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে প্রাচীন কালের এ বাড়ির ভূগর্ভস্থ প্রত্নমহল অনুসন্ধান করে বাড়ির ইমারতগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করে ইতিহাসে নতুনভাবে সংযোজন করা হলে পরবর্তী প্রজন্ম এ ইতিহাস থেকে অনেক কিছুই জানতে পারবে।
ভাষাসৈনিক জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাড়ির পাঁচটি ভবনের মধ্যে একটি টোল ছিল। সেখানে সংস্কৃত ভাষা ছাড়াও বহু বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষা দেওয়া হতো। আমি এ বাড়িতে সরকারি উদ্যোগে একটি জাদুঘর নির্মাণের ওপর গুরুত্বারোপ করছি।’
শরীয়তপুর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি অ্যাডভোকেট মুরাদ হোসেন মুন্সী বলেন, ‘মনসাবাড়িটি শরীয়তপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে। কিছুদিন আগে এ ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে এসেছিলেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি এ নিদর্শন সংস্কার করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জানাবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। সরকারিভাবে বাড়িটি দ্রুত সংস্কার করলে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হবে।’
জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, ‘ধানুকা মনসাবাড়িটি সংস্কারের জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরে কয়েকবার আবেদন করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখনো পর্যন্ত সাড়া পাওয়া যায়নি।’
কীভাবে আসবেন: যদি সড়কপথে আসতে চান, তাহলে ঢাকার যেকোনো বাসস্ট্যান্ট থেকে মাওয়া হয়ে শরীয়তপুর শহরের কোর্ট বাসস্ট্যান্ড চলে আসবেন। সেখান থেকে রিকশা বা অটোরিকশায় চলে আসবেন ধানুকা মনসাবাড়িতে। আর নৌপথে আসতে চাইলে ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চযোগে নড়িয়া লঞ্চঘাটে এসে নামবেন। সেখান থেকে বাস, মোটরসাইকেল, রিকশা কিংবা অটোরিকশায় চলে আসবেন ধানুকা মনসাবাড়ি।