২০১৯ সালের শেষ দিবসে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানবাসীর ওপর নেমে আসা করোনাভাইরাস নামক নিরাময়-অযোগ্য সংক্রামক রোগটি মাত্র ৬৮ দিনের মধ্যেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২১৩টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপের ধনী ও পরাক্রমশালী দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও স্পেনে যখন এই রোগের তাণ্ডব শুরু হয়েছিল, বিশ্বের ১ নম্বর পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত ভেবে ফুরফুরে মেজাজে থাকায় তখন চীন ও ভারত সফরে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, ইউরোপ ও আমেরিকার মাঝে আটলান্টিক মহাসাগরের পাঁচ হাজার কিলোমিটারের দীর্ঘ জলপথ পাড়ি দিয়ে করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রে হানা দিতে পারবে না। তাই তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শিং জিনপিংয়ের মতো করোনাভাইরাসের থাবা থেকে জাতিকে এবং মন্দার হাত থেকে দেশের অর্থনীতিকে রক্ষার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এর খেসারত দিতে হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কোনো হুঙ্কারই করোনাভাইরাসের তাণ্ডব রুখতে পারছে না। আক্রান্তদেরও মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমল মিলিয়ে গত ৭৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ‘বয়োবৃদ্ধ’ বর্তমান সরকার করোনাভাইরাস চীনে শনাক্ত হওয়ার শুরুর দিকে অতি সতর্কতা প্রদর্শন করে চীনে বিমান পাঠিয়ে সেখানে আটকেপড়া বাংলাদেশীদের ঢাকায় ফিরিয়ে এনে হজ ক্যাম্পে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রেখে দিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। কবে রাজনৈতিক স্বার্থে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ৩০ জানুয়ারি সরস্বতী পূজার সাথেই হবে, না এসএসসি পরীক্ষা ও বইমেলা দুই দিন পিছিয়ে দিয়ে ১ ফেব্রুয়ারি ভোট গ্রহণ করা হবে- এই কূটতর্কে উচ্চ আদালত পর্যন্ত জড়িত করে পুরো প্রশাসন ব্যস্ত রাখে।
ফেব্রুয়ারি ও মার্চে এসএসসি পরীক্ষা, ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার কাজে এবং ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের কর্মসূচি ২১ মার্চ ধানমন্ডি ও গাইবান্ধার সংসদ উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ নিয়ে সরকার ও পুরো প্রশাসন অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকায় করোনাভাইরাসের কারণে ও আতঙ্কে ইতালি, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে যে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে দেশে ফিরে এসেছিলেন, তাদের বেলায় উহানফেরতদের মতো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী ঢাকায় আগমন শনাক্ত হলেও ১৪ মার্চ পর্যন্ত খবরটি চেপে রাখা হয়েছিল। ১৭ ও ২৬ মার্চের সব অনুষ্ঠান বাতিল করা হলেও নির্বাচন কমিশন তার ‘স্বাধীনতার’ প্রমাণ রাখতে ২১ মার্চের উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ স্থগিত না করায় ৯৫ শতাংশ ভোটারের বর্জনের মুখেও প্রধানমন্ত্রীকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে হয়েছিল যা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে জনগণকে হতাশ করেছিল। উপনির্বাচনের ‘খেসারত’ ধানমন্ডি ও সাদুল্লøাপুরবাসীকে পরের দিন থেকেই দিতে হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে পাঁচ বছর পরপর জনতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় বিধায় তিনি করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে ২১ মার্চ দেশব্যাপী ‘জনতার কারফিউ’ জারি করেছিলেন। অথচ উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন পার্টির আজীবন চেয়ারম্যান ও বংশানুক্রমিক শাসক কিম জং উনকে জনতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় না বিধায় তিনি ২১ মার্চ বিধ্বংসী মারণাস্ত্র ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষমূলক উড্ডয়ন অবলোকনে ব্যস্ত ছিলেন। আর বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনে জয় শতভাগ নিশ্চিত থাকায় ২১ মার্চ তার প্রার্থীর পক্ষে ভোটদানে ব্যস্ত থাকায় ভাবতেও পারেননি ক্ষমতাসীনরা, মাত্র ৯৬ ঘণ্টা পরই তাকেও করোনাভাইরাসের থাবা থেকে জনগণকে বাঁচাতে দেশব্যাপী লকডাউন পালনের ঘোষণা দিতে হবে। উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার খবর বিশ্ববাসী জানতে পারলেও করোনাভাইরাসে কতজন উত্তর কোরীয় আক্রান্ত এবং কতজন মৃত্যুবরণ করেছেন আজো তা জানা যায়নি। তবে দৈনিক কতজন বাঙালি আক্রান্ত হচ্ছে এবং কতজন মৃত্যুবরণ করছে তা বিশ্ববাসী জানতে পারছে এটাই উত্তর কোরিয়ার সাথে বাংলাদেশের পার্থক্য।
করোনাভাইরাসে পৃথিবীব্যাপী ভ্রমণের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে পৌঁছা পর্যন্ত তার বিস্তার রোধে লকডাউনে যাওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণের জন্য চার হাজার ১৫০ দিন বয়সী প্রবীণ সরকার ৪৩ হাজার ২০০ মিনিট সময় পেলেও করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনে মাসব্যাপী গৃহবন্দী থাকাকালে প্রয়োজনীয় যে চাল, ডাল, তেল, লবণ, শিশুখাদ্য ও ওষুধপত্র তা সংগ্রহ করার জন্য জনগণকে প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েনি। ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ২৬ মার্চ লকডাউনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সরকার ১৮ দিন সময় পেলেও লকডাউন চলাকালীন, দুই কোটি শ্রমজীবী ও কলকারখানায় কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীর তথ্যাদি সরকারের তথ্যভাণ্ডারে থাকা সত্ত্বেও সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় ভাতাভোগীদের জানু-মার্চ ত্রৈমাসিক ভাতা লকডাউনে যাওয়ার আগেই দেয়ার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে ৩০ কেজি করে চাল প্রাপকদের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়নি। কারখানার ও দোকান মালিকদের কর্মচারীদের মার্চ মাসের বেতন-ভাতা ২৫ তারিখের মধ্যে দেয়ার নির্দেশনা জারি করা হয়নি। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের নেতা সরকারের বর্তমান এমপি ও সাবেক মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কর্মরত ৭০-৮০ লাখ পরিবহন শ্রমিকদের এক
মাসের মজুরি অগ্রিম দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি কেন? মাছ, গোশত, ডিম, দুগ্ধ ও শাকসবজি উৎপাদনকারীদের সংখ্যা ও দৈনিক উৎপাদনের পরিমাণের সব তথ্য উপজেলা কৃষি ও পশুপালন অফিসে থাকা সত্ত্বেও লকডাউন চলাকালে তাদের পণ্যের বাজারজাতকরণের বিকল্প ব্যবস্থা না করায় তারাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের রোল মডেল হওয়ার দাবিদার ‘প্রবীণ’ সরকার লকডাউনে যাওয়ার আগে এসব প্রস্তুতি গ্রহণ না করেই ২৬ মার্চ থেকে লকডাউনে যাওয়ার ঘোষণা আগের দিন দেয়ায় দুই কোটি পরিবারের আট কোটি জনগোষ্ঠীর ১১ বছরের গড় আয় বৃদ্ধির সঞ্চয় ১১ দিনেই ফুরিয়ে যাওয়ায় জীবনের চেয়ে জীবিকার দাবি মুখ্য হয়ে ওঠে। এতে তারা খাদ্যের দাবিতে রাস্তায় নেমে পড়ায় করোনা ভাইরাসের দেশব্যাপী বিস্তার হয় ত্বরান্বিত। গত ১১ বছরের উন্নয়নের জোয়ারে দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিক যাদের কর্মদাতা বলা হয়, তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির এবং বিত্তহীন, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের গড় আয় বৃদ্ধি পেয়ে দুই হাজার ১০০ ডলারে উন্নীত হওয়ার যে প্রচার করা হচ্ছিল লকডাউনের প্রথম ১১ দিনেই তা কর্পূরের মতো উবে যায়। সরকারের কোষাগারে অঢেল অর্থ থাকলে লকলাউনে যাওয়ার আগেই হতদরিদ্রের ভাতা প্রদান ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ করা হতো।
ফলে লকডাউনের পর প্রথম এক মাস নির্বিঘেœ অতিবাহিত হলে করোনাভাইরাসের দেশব্যাপী বিস্তার ঘটত না এবং লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রয়োজন পড়লে ৩০ দিন সময় হাতে পাওয়া যেত। তখন ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া সহজ হতো। এই ব্যবস্থা ভিয়েতনামের অনুরূপ হলে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হওয়ায় জনগণের দুঃখকষ্ট ও দেশের অর্থনীতির ক্ষতিও কম হতো। সরকার ও তাদের সমর্থক শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিকদের অব্যবস্থাপনা ও আর্থিক সঙ্কটের কারণে লকডাউন পালনের নামে যা চলেছিল তাতে রোগের বিস্তার ঠেকানো এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়নি। বিত্তহীন, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের লকডাউন চলাকালে এক মাস ঘরে বসে খাওয়ার মতো সক্ষমতা অর্জিত হতো। শেয়ার বাজার লুট, ঋণের নামে ব্যাংক লুট, একেক বছর একেকটি নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে জনগণের পকেট কেটে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটিপতি প্রধানত গত ১১ বছরে সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়াও টেন্ডারবাজি, ঠিকাবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ক্যাসিনোবাজি, নিয়োগবাণিজ্যের মাধ্যমে দলে হাজারো লোক কোটিপতি বনে যাওয়ায় দেশের উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে। এই কারণেই মাথাপিছু গড় আয় দুই হাজার ১০০ ডলারে উন্নীত হলেও এতে দুই হাজার ডলারের নিচে আয়কারীদের কোনো লাভ হয়নি। গড় আয়ু বৃদ্ধি ৭৩ বছর হলেও যিনি ৫৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করছেন তার কোনো লাভ হয়নি, যিনি ৯৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করছেন তারও হয়নি তেমন ক্ষতি ।
গত ১১ বছরে উন্নয়ন ব্যয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজেটের আকার পাঁচ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছলেও রাজস্ব আয় আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি না পাওয়ায় বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধি পেতে পেতে এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তা পূরণ করতে গিয়ে প্রতি বছর ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বছরে সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা বাজেটের মোট ব্যয় প্রায় ২৫ শতাংশ। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য ভ্যাট আরোপের আর কোনো খাত বাকি না থাকায় নবজাতকের কিটস ও মৃত্যুযাত্রীর কাফনের কাপড়ের উপরেও ভ্যাট আরোপ করতে হয়েছে। ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে বাজেট ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব না হওয়ায় বিভিন্ন সংস্থার সংরক্ষিত তহবিলের অর্থও আইন করে সরকারি কোষাগারে নিতে হয়েছে। ‘ব্যবসাবান্ধব’ সরকার একটানা ১৩৮ মাস ধরে ক্ষমতায় থাকায় সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের ঋণ গ্রহণের পরিমাণও তেমন বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১১ বছরে ব্যাংকগুলো যে ১০ লক্ষাধিক কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে তার ৮০ শতাংশই পেয়েছেন এই ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। কিন্তু ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধির আনুপাতিক হারে শিল্পে বা ব্যবসায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পাওয়ায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়নি। ফলে বেকারত্ব বেড়েছে। ঋণ গ্রহণকারীদের দৃশ্যমান আয়-উপার্জনের চেয়ে অদৃশ্য রোজগার বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে এ পর্যন্ত সাত লক্ষাধিক কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ায় দেশে তাদের সম্পদের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেশি। ফলে তারা ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় দুই লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে, যার মধ্যে ৫৪ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করে হিসাবের খাতা থেকে উধাও করা হয়েছে। ৫০ হাজার কোটি টাকা ১০-১৫ বছরের জন্য পুনঃতফসিল করা হলেও এর কিস্তি নিয়মিত আদায় হচ্ছিল না। এই খেলাপি ঋণের ভাইরাসে ব্যাংকগুলোর ফুসফুসতুল্য নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দেয়ার মধ্যে করোনাভাইরাসে বাংলাদেশ ব্যাংক জুন পর্যন্ত সব ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত ঘোষণা করলেও হয়তো তা ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করতে হবে। ফলে ব্যাংকগুলোর ভল্ট খেলাপি ঋণের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত লাখো কোটি টাকার প্রণোদনা কর্মসূচি নতুন নোট ছাপানো ছাড়া বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। সরকার, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিকরা গত ১১ বছরে অতিরিক্ত ঋণভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন করোনাভাইরাসের থাবায় তাদের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় এখন দেখার বিষয়।
সরকারের বয়সের চেয়ে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের ব্যবসার বয়স দ্বিগুণ হলেও একটানা ১১ বছর নির্বিঘেœ ব্যবসা করার পরও তাদের নেয়া ঋণের আনুপাতিক হারে নিজস্ব মূলধনের পরিমাণ বৃদ্ধি না পাওয়ায় তাদের সক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়নি। ফলে বেশির ভাগ কারখানার মালিক মার্চ মাসের বেতন পরিশোধের জন্য সরকারি অনুদান পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। তাদের কর্মীরা দীর্ঘ ১২০ মাস থেকে ২৪০ মাস ধরে শ্রম দিয়ে তাদের মুনাফা বৃদ্ধিতে অবদান রাখলেও করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন চলাকালে এক মাসের বেতন অগ্রিম দেয়ার সক্ষমতাও তারা দেখাতে পারেননি কী কারণে? মনে হচ্ছে, কর্মীদের চেয়ে তারাই বেশি অভাব-অনটনের মধ্যে দিন গুজরান করছেন। লকডাউনে যাওয়ার আগে সরকারের প্রস্তুতি গ্রহণে অব্যবস্থাপনার কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এবং ১১ বছরে দারিদ্র্যসীমা উপরে উঠে আসা ২২ শতাংশ, একুনে ৪২ শতাংশ জনগোষ্ঠীর যে হাল হয়েছে, তেমনি কর্মদাতাদের লাগামহীন ঋণ গ্রহণের ফলে সুদ পরিশোধে তাদের অক্ষমতার কারণে মাসকাবারি আনে ‘মাসকাবারি খায়’দের অনুরূপ হাল হয়েছে।
আর কোনো ব্যাপারে সরকারের ও ব্যবসায়ীদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি না পেলেও ভোটারবিহীন ও মধ্যরাতে ভোট গ্রহণের নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের ৯৭.৩৩ শতাংশ আসনে, কাস্টিং ভোটের ৯৭.৩৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হওয়ার ‘দক্ষতা’ তারা অর্জন করেছেন ঠিকই। ৩০ ডিসেম্বরের ‘জিরো আওয়ার’ নির্বাচনে পুলিশ ও দলীয় ক্যাডারবাহিনী নামিয়ে ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৪০ হাজার কেন্দ্র দখল করে, ভোট দিতে আসা আট কোটি নাগরিকদের ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও লকডাউন চলাকালে পেটের দায়ে রাস্তায় নেমে আসা চার কোটি ক্ষুধার্ত মানুষকে নানান বাহিনী নামিয়েও বাগে আনা যাচ্ছে না কেন? কারণ ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে গত ১৩৮ মাস ধরে দলীয় যে হাজার হাজার নেতা টেন্ডারবাজি, ঠিকাবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ক্যাসিনোবাজি, নিয়োগবাণিজ্য ও মনোনয়নবাণিজ্যসহ বিভিন্ন প্রকার জনস্বার্থবিরোধী কাজ করে এনু-রুপন ব্রাদার্স, সম্রাট চৌধুরী ভূঁইয়া, শামীম ও পাপিয়া-সুমনদের মতো কোটি কোটি নগদ টাকা, ডজন ডজন বাড়ি গাড়ি এবং কেজি কেজি স্বর্ণের মালিক বনেছেন। এলাকার জনগণের মুখে মুখে তাদের নাম ছড়িয়ে পড়লেও দুদক ও গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় তাদের নাম আছে। এদিকে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারা ত্রাণের চাল নিতে চালবাজি শুরু করায় জনগণের দুঃখকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুধার জ্বালায় নির্বাক হয়ে পড়া শিশুর মাকে সন্তানের দুধের জন্য মাথার চুল পর্যন্ত বিক্রয় করতে হচ্ছে।
কোটিপতি বাজিকরদের বিবেক জাগ্রত এবং নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করতেই শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার গান্ধিগাঁওয়ের একালের ‘মহাত্মাগান্ধী’ নাজিমুদ্দিন ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে সঞ্চিত ১০ হাজার টাকা সরকারি ত্রাণ তহবিলে দান করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু গত চার হাজার ১৫০ দিনে যে সব বাজিকর ও চোর ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে শত কোটি টাকা কামাই করেছেন, তারা জনাব নাজিমুদ্দিনের দেখানো পথ অনুসরণ করে তাদের গুদামজাত ধনরাশির কিছু অংশ দান করতে এগিয়ে আসবেন বলে মনে হয় না। সম্রাট, ভূঁইয়া ও চৌধুরীদের মতো ধরা খাওয়ার ঝুঁঁকি তারা নেবেন না নিশ্চয়ই। তাই তাদের বিবেক জাগ্রত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কালো টাকা সাদা করার মতো, ত্রাণকাজে দানের কারণে অবৈধভাবে অর্জিত ধনরাশি বৈধ করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। ঈদের সময় বাড়ি যাওয়ার সুযোগ দেয়ায় দেশব্যাপী করোনাভাইরাসের বিস্তার সহজ হয়েছে। করোনাভাইরাসের এই থাবা থেকে দেশবাসীকে রক্ষার জন্য দুই মাস ছয়দিন লকডাউন পরিপালনের সুফল নস্যাৎ হয়ে যায়, যা সামাল দেয়ার ক্ষমতা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেই। উন্নয়নের যে ফিরিস্তি গত চার হাজার ১৫০ দিন টিভি ও পত্রিকায় স্থান পাচ্ছিল তার ৫০ শতাংশ সত্য হলেও লকডাউন মাত্র ১১ দিন পরই অকার্যকর হতো না। প্রবীণ নাগরিকদের ভিক্ষাবৃত্তি করতে হতো না। গড় আয়ু বৃদ্ধির সুফলে তারা বেঁচে থাকলেও গড় আয় বৃদ্ধির সুফল তাদের ভাগ্যে না জোটায় তাদের ভিক্ষা করতে হচ্ছে। দিনে দিনে দেনা অনেক বেড়েছে। এবার শোধ দেয়ার পালা।